নভেম্বর ১৯, ২০২০ ১৮:৫৮ Asia/Dhaka

গত পর্বের অর্থাৎ দশম পর্বের আলোচনায় আমরা জেনেছি, টমাস কার্লাইল ছিলেন একজন বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখক, দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ।

১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে এক সম্মেলনে দেয়া ভাষণে তিনি দর্শক ও শ্রোতাদের কাছে মহানবী (সা), মুসলিম জাতি ও ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের নানা দিক তুলে ধরেন।  প্রখ্যাত ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ ও ইতিহাস বিশেষজ্ঞ থমাস কার্লাইল মহানবী ও ইসলামের প্রশংসায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং বাস্তবতা-ভিত্তিক বক্তব্য রেখে পশ্চিমা সমাজে ইসলাম ও মহানবী (সা) সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণার অবসান ঘটাতে সহায়তা করেছেন। একইসঙ্গে তার ওইসব বক্তব্য ইসলাম, মহানবী (সা)  ও মুসলমানদের সম্পর্কে পশ্চিমা ইসলাম-বিদ্বেষীদের অনেক মিথ্যাচারের ভিত্তিহীনতা ও অসারতা স্পষ্ট করে দিয়েছে। 

থমাস কার্লাইল মহানবী (সা) সম্পর্কে যারা মিথ্যাচারের ভিত্তিহীন অপবাদ দিয়েছেন তাদের উদ্দেশ করে খুব সুন্দর ও যৌক্তিক ভাষায় লিখেছেন: আপনারা কি কখনও এমনটি দেখেছেন যে একজন মিথ্যাবাদী একটি ধর্ম গড়ে তোলার ক্ষমতা রাখে এবং তা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়? স্রস্টার শপথ! একজন মিথ্যাবাদী ও অজ্ঞ একটি ঘর তৈরির ক্ষমতাও রাখে না। এটা অসম্ভব যে তিনি একটি ঘর তৈরি করবেন যার মধ্যে কোটি কোটি মুসলমান ১৪০০ বছর ধরে জীবন যাপন করছে! যদি কোনো মিথ্যাবাদী এই ঘর তৈরি করতেন তাহলে তা এতদিনে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত... আফসোস! এ ধরনের অলীক কল্পনা কতই না লজ্জাজনক! এ ধরনের চিন্তা-ভাবনার অধিকারীরা কতইনা গোবেচারা ও দুর্বল!... আমি ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিয়ে দেখছি যে মহানবীর জীবনের ভিত্তি বা নীতি এবং সব কাজ ও বৈশিষ্ট্যই পছন্দনীয়।

থমাস কার্লাইল তার পাঠক ও শ্রোতাদের কাছে এটাও তুলে ধরেছেন যে জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মহানবীর(সা) আচরণে কোনো ধরনের বৈপরীত্য দেখা যায়নি। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন বিশ্বস্ত, সত্যবাদী, দয়ালু, হাসি-খুশি, আন্তরিক, উদার, সুবিবেচক ও বিনম্র হিসেবে খ্যাত। মুহাম্মাদ (সা) তার সমগ্র জীবন‌ই কাটিয়েছেন সহিংসতা, অনাচার, অশালীনতা ও নীতিহীনতা, স্বার্থপরতা, খ্যাতির মোহ ও অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে। তিনি সুশীল আইন ও নৈতিক বিধান দিয়ে গেছেন যাতে বর্বরতা ও প্রতিশোধ-প্রবণতা বিলুপ্ত হয়  এবং নৈরাজ্য ও অনাচারের স্থান দখল করে শৃঙ্খলা ও সভ্যতা।

কার্লাইল তার পাঠক ও শ্রোতাদের কাছে এটাও তুলে ধরেছেন যে ইউরোপের প্রচলিত ধর্ম-বিশ্বাসগুলোর বিপরীতে মুহাম্মাদের ধর্মগ্রন্থ কুরআন অনৈতিকতা ও অশালীনতা শেখায় না, বরং কুরআনের দৃষ্টিতে মুসলমানদের মানবিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব হল মহান আল্লাহর ইচ্ছার আলোকে এমন এক সুশৃঙ্খল ও নৈতিক জীবন গড়ে তোলা যা হবে অসাধারণ মাত্রায় নিয়ন্ত্রিত ও সংযত। 

কার্লাইল অস্তিত্বের জগতের নানা বাস্তবতার বিষয়ে মহানবীর অন্তর্দৃষ্টি অর্জন ও এ সম্পর্কিত তার আগ্রহ প্রসঙ্গে লিখেছেন, অতীতের যুগগুলো সম্পর্কে এই ব্যক্তির ছিল উচ্চতর দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি নিজেকে প্রশ্ন করতেন: কে আমি? এই যে কুলকিনারাহীন বিশ্ব-জগত যাতে আমি বসবাস করছি তার স্বরূপ কী? জীবন কী? মৃত্যুই বা কী? হেরা পর্বতের বিশাল প্রস্তরখণ্ডগুলো ও হিজাজের উত্তপ্ত শিলাময় প্রান্তর তার এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। সুনীল আকাশ তার সব গৌরব ও উচ্চতা নিয়ে এবং মাথার ওপর মহাকাশে জ্বলতে থাকা তারকারাজিও তার এইসব প্রশ্নের উত্তর দিত না। এ অবস্থায় নুর ও জ্যোতির্ময়তা মুহাম্মাদের কাছে এল। এইসব বাস্তবতার রহস্য উন্মোচনই হল জীবনের অর্থ ও সেটাই হচ্ছে ইসলাম তথা  স্রস্টার ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ। 

থমাস কার্লাইল তার ভাষায় মহানবীর প্রশান্ত আত্মার ও প্রভাবশালী হৃদয়ের প্রতি তার গভীর আকর্ষণের কথাও তুলে ধরেছেন বিখ্যাত এক বক্তৃতায়। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন: মরুভূমির এই সন্তানের ছিল প্রভাব বিস্তারকারী গভীর হৃদয় ও কালো চোখ এবং তাঁর ছিল ব্যাপক বিস্তৃত ও শাখা-প্রশাখাবহুল সামাজিক চেতনা। সব ধরনের সুচিন্তার সমাহার ছিল তার মধ্যে! কেবল ছিল না পদ বা খ্যাতির মোহ! কি বিশাল উঁচু ও প্রশান্ত আত্মার অধিকারী ছিলেন তিনি! 

উনবিংশ শতকে রাণী ভিক্টোরিয়ার যুগে বহু ব্রিটিশ নারী ও পুরুষ ব্যক্তিত্ব কার্লাইলকে এমন নতুন চিন্তাধারার অধিকারী বলে উল্লেখ করেছেন যে চিন্তাধারা ধর্মীয় চিন্তার জগতকে দিয়েছে নতুন রূপ ও দিক-নির্দেশনা এবং তার এইসব চিন্তাধারা ইউরোপ ও পাশ্চাত্যের একঘেয়ে ও গোঁড়া বিশ্বাসের ভিত্তিগুলোকে কাঁপিয়ে নড়বড়ে করে দিয়েছিল। অবশ্য পাশ্চাত্যের সবাই মুক্ত কণ্ঠে, দৃঢ়-চিত্তে ও প্রকাশ্যে কার্লাইলের প্রশংসা করতে ৫০ বছর সময় নিয়েছিল এবং পবিত্র কুরআন ও মহানবী সম্পর্কে বাস্তবতা-ভিত্তিক গবেষণা তখন থেকেই তারা কার্যকরভাবে শুরু করে।#

পার্সটুডে/আমির/১৯

ট্যাগ