ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২১ ২১:৩০ Asia/Dhaka

যেসব পশ্চিমা মনীষী পবিত্র ইসলাম ধর্ম ও মহানবীর (সা) মহত্ত্ব নিয়ে প্রশংসাসূচক ও গবেষণাধর্মী বই লিখে খ্যাতি অর্জন করেছেন প্রখ্যাত জার্মান প্রাচ্যবিদ মিসেস অ্যান ম্যারি শিমেল তাঁদের একজন।

বহু ভাষাবিদ অ্যান ম্যারি শিমেল ছিলেন তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, ইসলাম ও সুফিবাদ বিষয়ের বিশেষজ্ঞ। ইসলামী চিত্রকলা, শিল্প-সাহিত্য, ভারতীয় মুসলিম সংস্কৃতি ও ইকবাল বিষয়েও তার ছিল অসাধারণ পাণ্ডিত্য।

কুখ্যাত লেখক সালমান রুশদি ইসলাম, কুরআন ও মহানবীর (সা) প্রতি অবমাননাকর ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ বা শয়তানিপূর্ণ কবিতা শীর্ষক বইটি লেখায় মুসলিম বিশ্বে যে ব্যাপক প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল সে প্রতিবাদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন মিসেস শিমেল। আঙ্কারা ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক মারা যান ২০০৩ সালে। তার জন্ম হয়েছিল প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারী এক পরিবারে ১৯২২ সালে।

জার্মান প্রাচ্যবিদ শিমেল জার্মান ও ইংরেজি ভাষা ছাড়াও আরবি, ফার্সি, তুর্কি, পাঞ্জাবি ও সিন্ধি ভাষায় ব্যাপক দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। 

মিসেস শিমেল মুসলমান হয়েছিলেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। তবে তিনি হয়তো মনে মনে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন কিনা –এ ধরনের প্রশ্ন করা হলে তিনি ঘোরানো-প্যাঁচানো জবাব কিংবা রহস্যময় উত্তর দিতেন। যেমন, এ ধরনের এক প্রশ্নের উত্তরে মিসেস শিমেল একবার বলেছিলেন, যারা ভালো মুসলমান কিনা- এ ব্যাপারে নিশ্চিত নন, কেবল তারাই হচ্ছেন ভালো মুসলমান!

শিমেল মাত্র ১৭ বছর বয়সে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সময় মাওলানা রুমির দিওয়ান নামক কাব্য অধ্যয়ন করে শিমেল ইসলামী সাহিত্য, দর্শন ও কৃষ্টির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। মধ্যযুগের মিশর সম্পর্কে গবেষণা করে তিনি মাত্র ১৯ বছর বয়সে প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। কিন্তু নাৎসী সরকার তাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ে চাকরি করতে বাধ্য করেছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে মিসেস শিমেল ও তার সহকর্মীরা মার্কিন বাহিনীর হাতে বন্দি হন। শিমেল বন্দি শিবিরেই একটি বিশ্ববিদ্যালয় চালু করেন। সেখানে তিনি তার প্রথম লেকচার দিয়েছিলেন ইসলামের বিষয়ে। এ সময়ে তিনি সুফিদের ওপর গবেষণা করে দ্বিতীয় ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।

শিমেল তুর্কি ভাষায় এতটা পারদর্শি ছিলেন যে আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগীয় চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়ে তিনি বিস্ময় সৃষ্টি করেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত তুরস্কে অধ্যাপনাকালে ডক্টর শিমেল মহাকবি ইকবালের দর্শন ও সাহিত্য কর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তিনি ইকবালের জাভিদনামা শীর্ষক আধ্যাত্মিক কাব্যটির অনুবাদ করেন। শিমেল ১৯৬৭ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। এখানে তিনি ভারতীয় মুসলিম সংস্কৃতি বিষয়ে পড়াতেন। মাত্র তিন বছরেই তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। ইসলাম, সুফিবাদ ও ইকবাল বিষয়ে মূল্যবান গবেষণার জন্য পাকিস্তান সরকার শিমেলকে দেশটির সর্বোচ্চ পদক সিতারাই ইমতিয়াজ ও হিলাল ই ইমতিয়াজ পুরস্কার দিয়ে সম্মান জানায়। 

 গত কয়েক পর্বে আমরা মিসেস শিমেলের লেখা ‘মুহাম্মাদ(সা) মহান আল্লাহর প্রেরিতপুরুষ বা রাসুল’ শীর্ষক বইয়ের আলোকে মহানবী (সা) সম্পর্কে শিমেলের কিছু বক্তব্য ও মতামত তুলে ধরেছি। মহানবীর (সা) আচার-আচরণ যে মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য ও শ্রেষ্ঠ আদর্শ তা দৃষ্টান্তসহ উল্লেখ করেছেন মিসেস শিমেল। আজও মহানবীর (সা) শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়ে তাঁর আরও কিছু বক্তব্য ও মন্তব্য তুলে ধরে শেষ করব এই ধারাবাহিক আলোচনা।

জার্মান প্রাচ্যবিদ মিসেস অ্যান ম্যারি শিমেল মনে করেন ইসলামের মহানবীর মর্যাদা ও মহত্ত্ব তাঁর সুন্দর নামগুলো থেকেও উপলব্ধি করা যায়। মহানবীর (সা) বহুল প্রচলিত দু’টি নাম হল মুহাম্মাদ ও আহমাদ। এসব নামের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। ফরিদউদ্দিন আত্তার নিশাপুরি ও জা’মির মত মহান কবিরা ইসলামের মহানবীর (সা) এইসব নামের মাহাত্ব্য ও সৌন্দর্য খুব সুন্দর ভাষায় বর্ণনা করেছেন। এইসব নামের যে ব্যাপক বরকত রয়েছে মুসলমানরা তা বিশ্বাস করেন। মুসলমানরা মনে করেন মহানবীর নাম (সা) ও এমনকি তাঁর প্রতি ইঙ্গিতও দরুদ পাঠ করা ছাড়া মুখে উচ্চারণ করা উচিত নয়। মহানবীর (সা) প্রতি দরুদ সেই প্রাচীন যুগ থেকেই নামাজের এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মহানবীর প্রতি সালাওয়াত বা দরুদ হচ্ছে এক ধরনের বিশেষ দোয়া যা মহানবীর (সা) সম্মান, মাহাত্ম্য ও মর্যাদার আধিক্য তুলে ধরে।

বিশ্বাসী বা মুমিন মুসলমানরা মনে করেন মহানবী (সা) মুসলমানদের আচার-আচরণ ও তৎপরতা লক্ষ্য করেন। এ বিষয়টি তারা সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে অনুধাবন করেন। আর এই দৃঢ় বিশ্বাসের কারণেই মুসলমানরা মহানবীর ওপর দরুদ পাঠ করে ও তাঁর প্রশংসা করে মজলিস ও মাহফিলগুলোকে সৌন্দর্যের অনন্য অলঙ্কারে সজ্জিত করে থাকেন বলে মিসেস শিমেল মনে করেন।

মিসেস শিমেল ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ব্যাপক পড়াশুনা এবং গবেষণার সুবাদে ইসলামকে মহানবীর সেরা উপহার বলে উল্লেখ করেছেন। ইসলামের বিষয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমের বিষাক্ত প্রচারণার পরিবেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, আমার কাছে এটা খুবই দুঃখজনক বিষয় যে পশ্চিমা মহলগুলো ইসলামকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে থাকে। ইসলাম অত্যন্ত মর্যাদা-সম্পন্ন উচ্চ পর্যায়ের বিষয় যা অবশ্যই আরও গভীর ও নিখুঁত পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে। ইসলাম ধর্ম কোটি কোটি মানুষের হৃদয়কে আকৃষ্ট করেছে এবং এ ধর্ম  শান্তি ও ন্যায়বিচারের ধর্ম। এ ধর্ম সন্ত্রাসবাদ ও মানুষ হত্যা করাকে নিন্দা জানায় বলে শিমেল মন্তব্য করেছেন।

মুহাম্মাদ(সা) মহান আল্লাহর প্রেরিতপুরুষ বা রাসুল’ শীর্ষক বইয়ের উপসংহারে মিসেস শিমেল লিখেছেন, মহান আল্লাহ নিজেই মহানবীর তথা নিজের সর্বশেষ রাসুলের প্রশংসা করেছেন পবিত্র কুরআনে। আর এ বিষয়টি মহানবীর গুণ বর্ণনাকারী ও এ বিষয়ে গবেষণাকারীদের কাজ কঠিন করে দিয়েছে। আর এ জন্যই মিশরের প্রখ্যাত আলেম ও কবি আল্লামা বুসিরি বলেছেন, মহানবীর যথাযথ মর্যদা তুলে ধরা কোনো ভাষাতেই সম্ভব নয়!- আর এটাও মহানবীর (সা) অন্যতম মু’জিজা বা অলৌকিকতা। গোটা বিশ্বচরাচরের জন্য মহান আল্লাহর রহমত হিসেবে প্রেরিত  মহানবীর (সা) শানে পেশ করছি অশেষ সালাম ও দরুদ।

 প্রাচ্যবিদদের চোখে মহানবী (সা) শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনা এখানেই শেষ করছি।# সমাপ্ত

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ১১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ