নভেম্বর ২৩, ২০২০ ২১:৫৮ Asia/Dhaka

গত পর্বের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা মনসুর হাল্লাজের বক্তব্য ও রচনাবলীর প্রভাব সম্পর্কে কথা বলব।

মনসুর হাল্লাজের মৃত্যুর পর তার চিন্তাধারার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন বেশিরভাগ প্রখ্যাত সুফি-সাধক ও আরেফরা। মনসুর হাল্লাজ বলে গেছেন, মুমিনের হৃদয় হচ্ছে আয়নার মত, যখনই তাতে দৃষ্টি দেবে তাতে মহান প্রতিপালকের ছায়া বা প্রকাশ দেখা যাবে। অন্যদিকে আত্তারও মনে করতেন, দয়াময় আল্লাহকে হৃদয়ের আয়নায় দেখা উচিত। কেবল পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমেই মহান আল্লাহর উপস্থিতিকে অনুভব করা সম্ভব বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। আত্তার মনে করতেন মহান ও পবিত্র আল্লাহকে চেনা-জানার জন্য জীবনকে আল্লাহর পথে কুরবানি করা উচিত এবং মনসুর হাল্লাজ-এর জীবনই এর সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। মনসুর হাল্লাজ বলেছিলেন, খোদাপ্রেমের রয়েছে দুই রাকাত এবং এর ওজু রক্তদান ছাড়া করা যায় না। অন্যদিকে আত্তার বিশ্বাস করতেন, যা পথ-চলাকে মিষ্টি ও সহজ করে তা হল খোদা-প্রেম এবং এর চেয়ে ভালো আর কিছুই নেই। হাল্লাজ খোদা-প্রেমের বেদনা অনুভব করতেন ও তার সমগ্র সত্তাকে কুরবানি করে তাঁর সন্ধানে ছিলেন এবং এজন্য তার কোনো ভয়ও ছিল না। অন্য দিকে আত্তারও ছিলেন ব্যথিত খোদা-প্রেমিক। তিনি প্রেমের পথের সব ব্যথাকে নেয়ামত ও সম্মান মনে করতেন।

মনসুর হাল্লাজ কখনও তার শত্রু ও বিরোধিদের ভয় পেতেন না। যারা তার প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা করেছিল তাদের সবাইকে তিনি ক্ষমা করে দিয়ে বলেছিলেন, এরা গোঁড়ামির কারণেই আমার ও আমার ধর্মের বিরোধিতা করছে। কোনো এক কাহিনীতে জানা যায় কোনো এক বছরের এক নওরোজ বা ফার্সি নববর্ষের উৎসবের দিনে মনসুর হাল্লাজকে

আহমাদ নামের এক ব্যক্তি স্মরণ করিয়ে দেন যে নওরোজ উপলক্ষে বাঁশি বাজানো হচ্ছে। হাল্লাজ বললেন: আহা! আমাদের নওরোজ কবে ঘটবে?!  তাকে প্রশ্ন করা হল: কোন্‌ দিনটি আপনার নওরুজ? তিনি বললেন: যেদিন আমি ফাঁসির মঞ্চে হাজির হব। এ ঘটনার ১৩ বছর পর মনসুরকে প্রাণদণ্ডের মঞ্চে আনা হয়। এ সময় হাল্লাজ ওই ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে বললেন: হে আহমাদ! এখনই আমাদের নওরোজ এসে গেছে! আহমাদ বলল: এ দিনে আপনি কি উপহার পেলেন?  তিনি বললেন: কাশ‌্ফ্ বা আধ্যাত্মিক বাস্তবতার অবলোকন ও ইয়াক্বিন বা মহান আল্লাহর ওয়াদার ওপর সুনিশ্চিত বিশ্বাস।... আরও আগে আমার এই আনন্দ আসবে বলে আমি আশা করতাম! (বাজনা) 

মনসুর হাল্লাজ বলেছিলেন, সবাই বিশ্ব-জগতের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর অস্তিত্বকে প্রমাণ করেছেন। কিন্তু আমি নিজের দিকে তাকিয়ে ও নিজের মধ্য থেকে বের হয়ে তা প্রমাণ করেছি। আর এটাই হচ্ছে মনসুর হাল্লাজের আনাল-হক্ব বা 'আমিই খোদা'- দর্শনের মূল কথা। অন্যদিকে আত্তারও একই ধরনের কথা বলেছেন।

আত্তার মনে করতেন মনসুর হাল্লাজ তার সমস্ত সত্তাকে খোদার প্রেমে ডুবিয়ে রেখেছিলেন। আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর চিন্তা তিনি করতেন না। আল্লাহর পক্ষ থেকে তার জন্য যা যা হয়েছে নির্ধারিত তা-ই তার দৃষ্টিতে ছিল মঙ্গলময় ও সুন্দর।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কবিদের কবিতায় আত্তারকে বড় ধরনের খোদাপ্রেমিক বা আল্লাহর ওলি হিসেবে স্মরণ করা হয়েছে। খোদাপ্রেমে আত্মহারা অবস্থা'য় আমিই খোদা বা আনাল হক্ব'- বাক্যটি বলার অপরাধে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। আদর্শ খোদাপ্রেমিক হিসেবে আরবি, ফার্সি, তুর্কি, হিন্দি ও মালয়ি ভাষার কাবিতায় তার প্রশংসা দেখা যায়।

হিজরি সপ্তম শতকের ইরানি মরমি কবি মাওলানা রুমি তার কবিতায় বার বার মনসুর হাল্লাজের নাম উচ্চরণ করেছেন। রুমির চিন্তাধারার ওপরও হাল্লাজের ব্যাপক প্রভাব দেখা যায়। তিনি হাল্লাজের ওপর আপতিত কঠিন  বিপদ বা সংকটগুলোকে তার জন্য সৌভাগ্য বলে মনে করতেন। রুমি মনে করতেন মনসুর হাল্লাজ মহান আল্লাহর নাম ও বৈশিষ্ট্যগুলোর কুল-কিনারাহীন সাগরে ডুবে ছিলেন এবং এ জন্যই তার মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল যে, আনাল হক্ব বা আমিই খোদা।

মনসুর হাল্লাজ মনে করতেন আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো কিছুর প্রকৃত বা বাস্তব অস্তিত্ব নেই। রুমিও তার ফিহি মাফিহি-গ্রন্থে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে: মাছির মত ক্ষুদ্র প্রাণী বিশাল পানিতে ডুবে গেলে যেমন তার অস্তিত্ব ও তৎপরতাকে আলাদাভাবে বলার মত কিছু বলা যায় না, বরং তা পানির অস্তিত্ব ও তৎপরতা হিসেবেই গণ্য হয় মনসুর হাল্লাজের অবস্থাও ছিল তেমনই।  

মাওলানা রুমি ফরিদউদ্দিন আত্তারের  মৃত্যুর বহু বছর পর আত্তারের ওপর মনসুর হাল্লাজ-এর গভীর প্রভাব সম্পর্কে লিখেছেন: আমার যাবার ব্যাপারে ভয় পাবেন না ও দুঃখ-ভারাক্রান্ত হবেন না। কারণ মনসুর হাল্লাজ-এর নুর ১৫০ বছর পর ফরিদউদ্দিন আত্তারের রুহের ওপর প্রকাশ পেয়েছে এবং তার পথপ্রদর্শক বা মুর্শিদে পরিণত হয়েছে।

রুমি তার জীবনের শেষের দিকের রচনা ফিহি মাফিহি-গ্রন্থে মনসুর হাল্লাজের কোনো কোনো রহস্যময় বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি আনাল হক্ব প্রসঙ্গে লিখেছেন: মানুষ মনে করে 'আনাল হক্ব' বলাটা বড় ধরনের বিতর্কিত দাবি! আনাল আবদ্‌ বা আমি আল্লাহর বান্দা বলাটাও বড় ধরনের দাবি! 'আনাল হক' বড় ধরনের নম্রতা! যখন  কেউ বলে আমি আল্লাহর দাস তখন তাতে দু'টি সত্ত্বার অস্তিত্ব প্রকাশ পায়: একজনের নিজের ও খোদার অস্তিত্ব! কিন্তু আনাল হক্ব বলে নিজেকে বিলীন ও অস্তিত্বহীন করা হয়েছে! ... মনসুর হাল্লাজ আল্লাহর প্রেমের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে নিজেরই শত্রু হয়ে যান ও নিজেকে অস্তিত্বহীন করে দিয়ে বলেছেন, আনাল হক্ব অর্থাৎ আমি বিলীন হয়ে গেছি, কেবল আল্লাহই রয়েছেন এবং এটা চূড়ান্ত বিনয় ও দাসত্ব। অর্থাৎ কেবল আল্লাহ আছেন, আর এটাই যথেষ্ট!

অধ্যাপক জাররিনকুবের মতে, মনসুর হাল্লাজ খোদাপ্রেমে এমনই মজেছিলেন যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছু তার হৃদয়ের দৃষ্টিতে ধরা পড়ত না, যেদিকে তাকাতেন সেদিকেই আল্লাহর প্রকাশ বা নিদর্শন দেখতে পেতেন। হাল্লাজ নিজের অস্তিত্বকেও খোদাপ্রেমের পথে একটি বাধা বা পর্দা বলে মনে করতেন।

রুমি হাল্লাজের প্রশংসায় লিখেছেন: আমরা সবাই যখন ছিলাম অন্ধকারে তখন মানসুর ছিল আলো! #

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ২৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। 

ট্যাগ