ডিসেম্বর ০৭, ২০২০ ১৭:৩০ Asia/Dhaka

আজ আমরা ইরানের বিখ্যাত সুফি-সাধক ও আরেফ এবং মরমি কবি নুরউদ্দিন আবদুর রহমান জামি’র জীবন ও অবদান নিয়ে কথা বলব।

গত পর্বের আলোচনায় আমরা জেনেছি, কবি নুরউদ্দিন আবদুর রহমান জামি ছিলেন জগৎ বিখ্যাত মুসলিম কবি। মোল্লা জামি বা মাওলানা জামি নামে খ্যাত এই কবিকে ফার্সি ভাষার শীর্ষস্থানীয় মরমি কবি বলে মনে করা হয়। বিশ্ববিশ্রুত এই কবির জন্ম হয়েছিল তৈমুরি শাসনামলে ইরানের খোরাসান প্রদেশের  জ’ম অঞ্চলে ৮১৭ হিজরি বা ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দের ৭ নভেম্বর।

আমির আলিশির নাওয়ায়ির মত মন্ত্রী ও সুলতান বয়কারোর মত সুলতান এবং মোগল সম্রাট বাবর তাকে সম্মান করতেন জ্ঞানী সাহিত্যিক ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে। বড় বড় জীবনীকাররা শ্রদ্ধাভরে তার নাম লিখে গেছেন। তুর্কি সুলতান জামিকে নিজ দরবারে আনার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অর্থ ও সম্মান বা খ্যাতির কোনো মোহ বা আকর্ষণ তার ছিল না। শাসক শ্রেণী ও ধনীদের আদৌ তোষামদ করতেন না জামি। সম্রাট বাবর লিখেছেন, গুপ্ত ও ব্যক্ত বিদ্যায় সমসাময়িক যুগে জামির সমকক্ষ আর কেউ ছিলেন না। জামি ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দের ৯ নভেম্বর তথা হিজরি ৮৯৮ সনের ১৮ মহররম ৮১ বছর বয়সে হেরাত শহরে ইন্তেকাল করেন।

 জামি ছিলেন একাধারে কবি, আরেফ বা সুফি-সাধক ও পণ্ডিত তথা ইরানের অন্যতম সেরা মনীষী। তার লেখা বইয়ের সংখ্যা অন্তত ৪৬ বলে মনে করা হয়।  বিচ্ছিন্ন অনেক কবিতা ছাড়াও তার রয়েছে দশটি কাব্য। এসবের মধ্যে সাতটি হচ্ছে মাসনাভী বা দ্বিপদী কবিতার কাব্য গ্রন্থ যা একত্রে সাবা বা হাফত্‌ আওরঙ্গ নামে খ্যাত। আর জামির তিনটি স্বতন্ত্র দিওয়ান বা কাব্য সংকলনগুলোর নাম যথাক্রমে ফাতিহাতুস শবাব, সিলসিলাতুল ইক্‌দ্‌ ও খাতিমাতুল হায়াত। এই তিন কাব্যে স্থান পেয়েছে তার খণ্ড কবিতা । জামি তার পদ্য বইগুলো লিখেছেন খ্রিস্টিয় ১৪৮৯ সনের মধ্যে। জামির হাফত্ আওরঙ্গ-এ রয়েছে সিলসিলাতুল দাহাব, সালানম ও আবসাল, তুহফাতুল আহরার, সুবহ্‌তুল আবরার, ইউসুফ ওয়া জুলায়খা, লাইলি ও মজনু এবং খেরাদনামেইয়ে সেকান্দারি।

মাওলানা জামির গদ্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে, তোহফাতুল উনস্, শাওয়াহিদুন-নবুওয়াত, আসিয়াতুল লামায়াত ও লাওয়াহ। মহিউদ্দিন আরাবির বই ফুসসুল হিকাম-এর টিকা সংক্রান্ত বই 'লাওয়ামি', সদ্‌রউদ্দিন কুনাভির 'নসুস' নামক বইয়ের টিকা-গ্রন্থ 'নকদুন নসুস'ও রচনা করেছিলেন জামি। 'বাহরিস্তান' জামির আরেকটি বিখ্যাত বই। বইটি শেখ সাদির গোলেস্তান বইয়ের অনুরূপ। এসব গদ্য বই তিনি লিখেছেন খ্রিস্টিয় ১৪৫৮ থেকে ১৪৯১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।  এ ছাড়াও অনেক ছোট ছোট গদ্য বই লিখেছেন জামি। জামির 'শাওয়াহিদুন্নবুওয়াত' নামক বইয়ের ১৪৩ থেকে ১৪৪ পৃষ্ঠায় বর্ণিত এক হাদিসে বলা হয়েছে, যারা ইরানের খোরাসানে অবস্থিত মহানবীর (সা) আহলে বাইতের সদস্য হযরত  ইমাম রেজা (আ.)'র মাজার জিয়ারত করবে (এই মহান ইমামের উচ্চ সম্মান সম্পর্কে পরিচিতি ও সমীহ নিয়ে) তারা বেহেশতবাসী হবে। মাওলানা আবদুর রহমান জামির লিখিত এ বইটি বহু বছর আগে বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়েছে মাওলানা মহিউদ্দিনের মাধ্যমে। ওই বইয়ের ২৭২ পৃষ্ঠায় ইরানের পবিত্র কোম শহরে অবস্থিত হযরত ফাতিমা মাসুমা (সা.)’র পবিত্র মাজার জিয়ারত সম্পর্কেও একই কথা বলা হয়েছে।  হযরত ফাতিমা মাসুমা হচ্ছেন হযরত ইমাম রেজারই আপন বোন।

জামির কবিতাকে কেউ কেউ নিজামির কবিতার সমকক্ষ বলে মনে করেন। মাধুর্য ও সারল্য ছিল তার কবিতার ভূষণ। তার কবিতা কষ্টকল্পিত বা কৃত্রিম নয়। নিজামির কবিতা বুঝতে ফার্সি ভাষায় গভীর জ্ঞান দরকার। কিন্তু জামির কবিতার জন্য ফার্সি ভাষার সেরকম গভীর জ্ঞান দরকার হয় না। জামি তার আধ্যাত্মিক গুরুদের প্রতি অসাধারণ সম্মান দেখাতেন। তিনি মহাকবি নিজামির প্রতি তার ঋণ স্বীকারেও কুণ্ঠা দেখাননি। জামির ওপর আরবি ভাষার কবি মুতানব্বী ও ইবনে আরাবির প্রভাব লক্ষ্যণীয়। তার ওপর মহাকবি রুমি, হাফেজ ও সাদির প্রভাবও দেখা যায়।

বাংলাদেশের মধ্যযুগের প্রখ্যাত মহাকবি আলাওল জামির কতগুলো কাব্যের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন।

জামিকে অন্য অনেক বড় কবির মত জীবনে তেমন কোনো দুর্ভোগ বা কষ্টের শিকার হতে হয়নি। কাউকে তোষামদ না করেও তিনি জীবনে ব্যাপক ও সুগভীর শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন বিশ্বব্যাপী। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী জামি ১৪৭২ খ্রিস্টাব্দে হজব্রত পালন করেছিলেন এবং এরপর তিনি ইরাকের বাগদাদে আসেন।  তিনি পবিত্র কারবালায় হযরত ইমাম হুসাইনের (আ) মাজার জিয়ারত করেছিলেন। এই পবিত্র মাজার জিয়ারতের আগে তিনি ইমাম হুসাইনের প্রশস্তিমূলক একটি সুন্দর কবিতা লিখেছিলেন।#

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ০৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। 

ট্যাগ