ডিসেম্বর ১৩, ২০২০ ২০:১০ Asia/Dhaka

গত পর্বে আমরা কেরমানের ঐতিহাসিক গ্রাম মেইমান্দে'র দিকে গিয়েছিলাম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেরে এমন মনোমুগ্ধকর গ্রামে কিছুটা সময় কাটিয়েছিলাম আমরা।

আশা করি ওই গ্রামের অনন্য সাধারণ ঘরবাড়িগুলো ভালো লেগেছে আপনাদের। মেইমান্দ গ্রামের একটি আকর্ষণীয় দিক হলো এই পাথুরে গ্রামে কোনও গলি বা রাস্তা নেই। বরং এই গ্রামের গলিগুলো পাহাড়ের ভেতরে একেবারে গভীরে প্রবেশ করে অবশেষে আবাসিকে এলাকায় মানে ঘর-বাড়িতে গিয়ে পৌঁছায়। এরকম চার শ ছয়টি কীচে এবং দুই হাজার পাঁচ শ ষাটটি কামরা এ পর্যন্ত মেইমান্দ গ্রামে তৈরি করা হয়েছে। ওই গলির সাহায্যে প্রতিটি ঘরই পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত। পর্বতবাসী মানুষের জীবনযাপন প্রণালী খুব নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করা যাবে এই মেইমান্দ গ্রামে। গত আসরের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা ঘুরে বেড়াবো এই মেইমান্দ গ্রামে।

মেইমান্দ গ্রামের জনমানুষের জীবনযাত্রা ও জীবনযাপন পদ্ধতি এই গ্রাম দেখতে আসা পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলে। মেইমান্দের লোকজন এখনও তাদের পুরোণো ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতি অনুযায়ীই চলাফেরা বা জীবনযাপন করে। কথা বলার সময় তারা এখনও সাসানী যুগের এমনকি পাহলভি যুগের ফার্সি শব্দ ব্যবহার করে। এখনও তারা প্রাচীন রীতি, আচার-প্রথা, সংস্কৃতি মেনে চলে। মেইমান্দ গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা হ'ল কৃষিকাজ ও পশুপালন। মেইমান্দের মানুষের কৃষিজাত পণ্যের মধ্যে বুনো পেস্তা, বুনো বাদাম, আখরোট এবং জিরার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। বসন্ত এবং গ্রীষ্মকালে মেইমান্দের লোকেরা তাদের পশুগুলোকে সবুজ চারণভূমিতে চরানোর জন্য নিয়ে যায়। আর শীতকালে তারা গেলিম বোণা, গালিচা বোণা, এবং ঝুড়ি বানানোর মতো হস্তশিল্প তৈরির কাজে জড়িয়ে পড়ে।

মেইমান্দ গ্রামের লোকেরা প্রাকৃতিক পরিস্থিতি, আবহাওয়া এবং প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপাদানের সাথে খুব ভালভাবে পরিচিত। এ কারণেই লক্ষ্য করা যাবে তাদের আবাসস্থল কিংবা বাড়িঘর তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি। এই গ্রামে বেড়াতে গেলে আপনি দেখতে পাবেন গ্রামের মানুষজন কীভাবে প্রকৃতির সাথে নিবীড়ভাবে নিজেদের সম্পৃক্ত করে নিয়েছে। মেইমান্দ গ্রামের লোকেরা অত্যন্ত দয়ালু ও অতিথিপরায়ণ। দূর-দূরান্ত থেকে তাদের গ্রামে বেড়াতে আসা দর্শক, পর্যটকদের সাদরে অভিনন্দন জানায়, স্বাগত জানায় তারা। গ্রামের বাড়িতে প্রবেশের পর ঘরবাড়ির বাহ্যিক সাধারণ চেহারা অথচ আকর্ষণীয় বিন্যাস যে-কোনো দর্শকদের দৃষ্টি নিমেষেই আকর্ষণ করে। এই ঘরগুলি গ্রামের মানুষের সাদামাটা তবে আন্তরিকতাপূর্ণ ঘনিষ্ট জীবনযাপনের সাধারণ একটা চিত্র যেমন চোখের সামনে ফুটিয়ে তোলে তেমনি মনের গহীনে জাগিয়ে তোলে  প্রশান্ত এক অনুভূতি।

মেইমান্দ গ্রামে ভ্রমণ করার জন্য সবচেয়ে উপযোগী সময় হলো গ্রীষ্ম ও বসন্ত ঋতু। এখানকার আবহাওয়া আধা মরু আঞ্চলিক। এ কারণে এই গ্রামের আবহাওয়া শীতকালে থাকে ঠাণ্ডা এবং পার্বত্য। তবে কীচেগুলোর ভেতরের আবহাওয়ার সঙ্গে বাইরের আবহাওয়ার পার্থক্য রয়েছে। কীচের ভেতরের আবহাওয়া বাইরের আবহাওয়ার চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি নাতিশীতোষ্ণ। গোসলখানা বা হাম্মাম, স্কুল, জরথ্রুস্টদের অগ্নিমন্দির এবং মুসলমানদের মসজিদ ইত্যাদি মেইমান্দের অপরাপর দর্শনীয় নিদর্শন। মেইমান্দ মসজিদ সমগ্র ইরানের মধ্যে অনন্য সাধারণ একটি মসজিদ। এর কারণ হলো মসজিদটি গড়ে উঠেছে পাথরের বুক চিরে।

এই মসজিদের কোনো মিনারা নেই এবং এর উচ্চতা হলো এক শ বিশ বর্গমিটার। মসজিদটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো মেহরাবগুলো। ওই মেহরাবগুলো বানানো হয়েছে পাথর কেটে কেটে। মেইমান্দ মসজিদের ফ্লোরটিও মেইমান্দের হাতে বোণা কার্পেটের মাধ্যমে চমৎকার করে আবৃত করা হয়েছে। এই মসজিদের আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে প্রবেশদ্বারের মাধ্যমে। বারো শ চল্লিশ হিজরিতে মেইমান্দ মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে বলে ইতিহাসে পাওয়া যায়। শ্রোতাবন্ধুরা! কেরমানে দেখার মতো নিদর্শন রয়েছে অনেক। 'শাহদদ' মরুভূমিও তেমনি একটি চমৎকার নিদর্শন। 'কালুত' নামে পরিচিত প্রকৃতির আরেক নিদর্শন এর মাঝে দেখতে পাওয়া যায়। এগুলো হলো বালির টিলা মানে বাতাসের বেগে বালি এক স্থানে স্তুপিকৃত হতে হতে জমে পাহাড়ের মতো মনে হয় দূর থেকে।

এই মরুটি কেরমান শহর থেকে এক শ কিলোমিটারের মতো দূরত্বে অবস্থিত। 'কালুত্‌হা' রুপকথার শহর থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এটি। ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে এটি একটি উষ্ণতাপ্রবণ এলাকা। শাহদদের কাছেই অবস্থিত মরু ফুলদানি যাকে ফার্সিতে বলা হয় নাবকা। এগুলো কোথাও কোথাও দশ মিটারের মতো লম্বাও হয়। আফ্রিকার মতো মরুভূমিতেও সবচেয়ে উঁচু নাবকার উচ্চতা তিন মিটারের বেশি নয়। রুপকথার শহর কালুতহা'র আয়তন এগারো হাজার বর্গ কিলোমিটার। শাহাদাদ প্রান্তরে ফুটন্ত ডিমের মতো দেখতে নুনের একটি জলাভূমি রয়েছে। এক শ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট এই লবণ জলাভূমি পৃথিবীর মধ্যে বিরল। সময় সুযোগ হলো দেখে আসতে ভুলবেন না আশা করি। আসলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা বর্ণনায় যতটুকু তুলে ধরা যায় তারচেয়ে বেশি অদেখাই থেকে যায়।

কেরমান ইরানের সবচেয়ে বড় প্রদেশ। সুতরাং দর্শনীয় নিদর্শনও যে বেশি বেশি থাকবে তাতে আর অবাক হবার কী আছে। তবু আমরা চেষ্টা করবো পরবর্তী আসরেও কেরমানের আরও কিছু নিদর্শনের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে অন্য কোনো প্রদেশে যেতে। #

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ১৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ