ডিসেম্বর ১৭, ২০২০ ১৯:০৪ Asia/Dhaka

বিশাল একটি দেশ ইরান। এ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য,পুরাতত্ত্ব আর সংস্কৃতির বিচিত্র সমৃদ্ধ উপাদান। গত আসরে আমরা ইরানের ঐতিহাসিক প্রদেশ কেরমান সফর করেছি। আশা করি আপনাদের মন্দ লাগে নি।

আগেই বলেছি  ইরান একটি রূপবৈচিত্রময় প্রকৃতির দেশ। এর একেকটি প্রদেশ একেক রকম বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। গত পর্বে আমরা কেরমানের ঐতিহাসিক শহর জিরোফতের দিকে গিয়েছিলাম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশে কিছুটা সময় কাটিয়েছিলাম আমরা। বিশেষ করে এখানকার সবুজ শ্যামল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর ঐতিহাসিক বিচিত্র স্থাপনাগুলো সত্যিই অনন্য।

আশা করি ওই অনন্য সাধারণ স্থাপনাগুলো ভালো লেগেছে আপনাদের। আমরা বলেছিলাম যে কেরমান প্রদেশের এই জিরোফত শহরটি ইরানের বৃহত্তম প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। এই ঐতিহাসিক স্থানটি ঘুরে দেখতে কার না ভালো লাগবে বলুন।  আপনি যদি ইতিহাস এবং প্রত্নতত্ত্বের প্রতি আগ্রহী হয়ে থাকেন তাহলে আপনার অবশ্যই জিরোফত শহরটি ভ্রমণ করা উচিত। এখানে রয়েছে একদিকে যেমন পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো  বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন তেমনি রয়েছে ইরানের যথারীতি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা বৈচিত্রময় পাহাড়। জিরোফতের ঐতিহাসিক প্রত্ন-নিদর্শন বামে মসজিদের ধ্বংসাবশেষের প্রতি ইঙ্গিত করেছিলাম গত আসরে।

জিরোফত সভ্যতা প্রাচীন প্রাচ্যের প্রাচীনতম সভ্যতা। কৌশলগত ভৌগলিক অবস্থান এবং প্রাচীন প্রাচ্যের মহান সংস্কৃতি ও সভ্যতার যোগাযোগের পথে এর অবস্থান। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের শুরু থেকেই জিরোফত হয়ে উঠেছিল শিল্প, সংস্কৃতিসহ কৃষি পণ্য এবং এ সংক্রান্ত কার্যক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ অঞ্চল। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজসহ ঐতিহাসিক ও পুরাতাত্ত্বিক দিক থেকে সমৃদ্ধ এই অঞ্চলটি সম্পর্কে বিস্তৃত গবেষণা এখনও একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তা সত্ত্বেও এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রাচীন জিরোফত শহরের প্রাচীনতম মসজিদ। বলা হয়ে থাকে যে জিরোফত শহর আট শ বছর আগে অর্থাৎ সেলজুক শাসন আমলে গড়ে উঠেছিল। এই শহরের লোকেরা মুসলমান ছিল এবং তাদের ইবাদাতের জন্য এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। পুরানো শহরের মসজিদটির বয়স এক হাজার বছরেরও পুরোণো বলে মনে করা হয়। এই মসজিদটি ইরানের প্রথম মসজিদ এবং ইসলামী বিশ্বের প্রাচীনতম মসজিদগুলির মধ্যে একটি। এই মসজিদটি দেখার জন্য পর্যটকদের মাঝে ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। দর্শনার্থীরাও এই মসজিদের প্রাঙ্গনে হাঁটতে হাঁটতে অন্যরকম একটা অনুভূতির মাঝে হারিয়ে যান।

জিরোফতে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণামূলক খননকাজ চালানোর পর জিরোফতের পাশেই আবিষ্কৃত হয়েছে প্রাচীন একটি স্থান। জিরোফত থেকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই স্থানটির নাম হলো স্যান্ডাল। গত আসরে এ সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছিলাম আমরা।  জিরোফতের পাশেই অবস্থিত প্রাচীন স্থানটি পরিদর্শন না করা হলে কেরমান সফরটা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। ইরানের মতো সমৃদ্ধ সভ্যতার দেশের ইতিহাস এবং এখানকার বিচিত্র ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হওয়ার কোনো সুযোগই হাতছাড়া করা ঠিক নয়। হাজার হাজার বছর আগে এখানে জীবনের যে বিকাশ লাভ করেছিল সেসবের মূল্যবান ঐতিহ্য এখন আমাদের সামনে বিদ্যমান।

স্যান্ডালের দক্ষিণ পাশে একটি টিলা রয়েছে। ওই টিলাটির উচ্চতা একুশ মিটার। উঁচু এই টিলাটি আসলে একটি বিশাল দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। এর কয়েকটি অংশ প্রত্নতাত্ত্বিক খননবিদরা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। দূর্গের এই কাঠামোটি কাদামাটির বৃহত আকারের ইট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। দূর্গের পশ্চিমাঞ্চলে রাজকীয় আবাসনের একটি বিশাল ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। এখানেই পাওয়া গেছে দুই শ দশ সেন্টিমিটার আকারের একটি মানুষের অর্ধ দেহের একটি ভাষ্কর্য। প্রাথমিক খনন কাজের সময় এর কিছু অংশ নষ্ট হয়ে গেছে। তারপরও এটিই এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে বড় মাটির ভাস্কর্য হিসেবে মনে করা হয়। এই জায়গাযতেই পাওয়া গেছে  চারটি ইটের স্ল্যাব। এগুলোকে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের বলে অনেকেই মনে করেন।

এখানকার হালিলরুদ নামের একটি নদীর পাশে রয়েছে জিরোফত প্রত্নতাত্ত্বিক যাদুঘর। জিরোফতের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির একটি ঐতিহাসিক দলিল যেন এই যাদুঘরটি। কেননা এখানে রয়েছে জিরোফত শহরের সাত হাজার বছরের পুরানো সব নিদর্শন। প্রাচীন এই শহরের ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলির সাথে পরিচিত হওয়ার একটি মোক্ষম সুযোগ সৃষ্টি করেছে এই যাদুঘরটি। এই যাদুঘরে অন্তত পাঁচ শ দুর্লভ ও ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে যার মধ্যে খোদাই করা বিচিত্র তৈজসও বিদ্যমান। এইসব নকশা এবং ডিজাইন এতো বেশি জটিল যে খুব সহজেই রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব নয়। মানুষ, পশুপাখিসহ রূপকথার বহু সামগ্রিও এখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এসবই যে-কোনো দর্শককেই কিছু সময়ের জন্য হলেও ভাবনার জগতের নীরব স্তব্ধ করে দেয়।  

যাদুঘরের অনন্য সাধারণ সব সংগ্রহ নিয়ে কথা বলছিলাম আমরা। এগুলো ছাড়াও এখানে রয়েছে মার্বেল পাথরের তৈরি বিভিন্ন মূর্তি, মানব ও প্রাণীর মূর্তি,  ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য, বিচিত্র নকশা করা মৃৎশিল্প এবং সরল মৃৎশিল্পসহ ছোট বড় আরও বহু জিনিস এই যাদুঘরে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জিরোফত প্রত্নতাত্ত্বিক যাদুঘরের জিনিসগুলি এই অঞ্চলে যা কিছু প্রত্ন নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলোর খুবই ক্ষুদ্র একটা অংশ মাত্র। এখানকার বেশিরভাগ প্রত্ননিদর্শনই তেহরানে এবং কেরমানে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। যাদুঘরের আকার যদিও খুব বেশি বড় নয় তবে ছোট্ট পরিসরে হলেও যে বেশ আকর্ষণীয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বাইরের দর্শকদের জন্য ইংরেজিতে অনূদিত তথ্যেরও ব্যবস্থা লক্ষ্য করা যাবে জাদুঘরের বিভিন্ন বিভাগে।

আমরা জিরোফতের বিখ্যাত উপহারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে এই এলাকায় আমাদের সফরের পরিসমাপ্তি টানবো। লাল গালিচা হলো জিরোফতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপহার। তিন শতাধিক বছরের পুরোণো এখানকার লাল গালিচা সমগ্র বিশ্বে রফতানি করা হয়। এর বাইরেও এখানকার মৃৎশিল্প, মাদুর, গেলিম, আয়নাকাজ, সূচিকর্ম ইত্যাদি এই অঞ্চলের হস্তশিল্পের মধ্যে অন্যতম।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ