ডিসেম্বর ১৬, ২০২০ ০২:৩০ Asia/Dhaka
  • মাওলানা সাইফ ফারগানির জীবন, রচনা ও অবদান

আজ আমরা হিজরি সপ্তম ও অষ্টম শতকের তথা খ্রিস্টিয় ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকের বিখ্যাত ইরানি কবি মাওলানা সাইফ ফারগানির জীবন, রচনা ও চিন্তাধারা নিয়ে কথা বলব।

হিজরি সপ্তম ও অষ্টম শতকের তথা খ্রিস্টিয় ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকের বিখ্যাত ইরানি কবি মাওলানা  সাইফ ফারগানি একজন বড় মাপের কবি হওয়া সত্ত্বেও নিজ যুগে অখ্যাত ও প্রায় অপরিচিত ছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর কয়েক শতক পর বর্তমান যুগে তিনি ইরানি গবেষকদের সুবাদে এখন একজন বড় কবি হিসেবে শ্রদ্ধা পাচ্ছেন। সাইফ ফারগানিকে গবেষকরা রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ের একজন শীর্ষস্থানীয় বা নেতৃস্থানীয় ইরানি কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছেন।

ইরানের সাহিত্য আকাশের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল হিজরি সপ্তম ও অষ্টম শতক। এ দুই শতকের আকাশকে উজ্জ্বল করে রেখেছেন বিশ্ববিশ্রুত ইরানি কবি রুমি, সাদি ও হাফেজের মত নক্ষত্ররা যাদের জ্যোতি আজও অম্লান ও চির-অম্লান হয়ে থাকবেন তারা বিশ্ব-সাহিত্যের ইতিহাসে। এ যুগের রাজনৈতিক ও সামজিক পরিবেশ নানা সংকটের কারণে সাহিত্য ও জ্ঞান চর্চার জন্য ব্যাপক প্রতিকূল হওয়া সত্ত্বেও এ যুগেই বড় বড় কবি ও সুফি-সাধক জন্ম নিয়েছেন। 

সাইফ ফারগানির পুরো নাম সাইফুদ্দিন আবুল মোহ'মেদ মুহাম্মাদ ফারগানি। তার জীবন ও সাহিত্য-কর্ম সম্পর্কে তেমন বেশি কিছু জানা যায়নি। তার কেবল একটি কাব্য সংকলন পাওয়া গেছে। অতীতের জীবনীগ্রন্থগুলোতে তার নাম ও রচনা সম্পর্কে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। ইরফানি বাস্তবতা তুলে ধরার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বেশ উচ্চ পর্যায়ের ও খানকার অধিকারী সুফি-নেতৃবৃন্দের অন্যতম। ফার্সি ইতিহাস বইগুলোতেও তার নাম আসেনি।

অধ্যাপক জাবিহউল্লাহ সাফা কবি সাইফ-এর অজ্ঞাত থাকার প্রসঙ্গে মনে করেন ফার্সিভাষীদের কাছে অপরিচিত থাকার কারণেই এই মহান সুফি-সাধক ও কবি মৃত্যুর প্রায় সাতশ বছর পর পরিচিতির আলো দেখলেন।  ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আহমদ অতাশ তার একটি প্রবন্ধে প্রথমবারের মত কবি সাইফ ফারগানির নাম উল্লেখ করেছেন। আর এই সুবাদে মুজতাবা মিনুয়ির প্রচেষ্টায় ফারগানির একটি কাব্য সংকলন প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে। এ সংকলনটি সম্পাদনা করেছেন অধ্যাপক জাবিহউল্লাহ সাফা।     

অধ্যাপক জাবিহউল্লাহ সাফা’র মতে কবি, আরেফ ও আলেমদের জীবনীতে কবি ও আরেফ মাওলানা সাইফের নাম না থাকার কারণ হল তিনি ইরান ছেড়ে রুম অঞ্চলে গিয়েছিলেন এবং সেখানেই বসবাস করতেন ও আর কখনও ইরানে ফিরে আসেননি। পশ্চিম এশিয়াতেই তিনি মারা যান। মাওলানা সাইফ যে সময় মারা যান সে সময় পশ্চিম এশিয়ায় মোঙ্গল ও ইলখানি শাসকদের নৈরাজ্যময় কর্তৃত্বের যুগ চলছিল। তাই এ অঞ্চলটি সে সময় দারিদ্র, নৈরাজ্য ও সংকটের কেন্দ্রভূমি হয়ে পড়ে এবং ইরানের সঙ্গে এ অঞ্চলের যোগাযোগ সে সময় খুব দুর্বল হয়ে পড়ে। সাইফ ফারগানি থাকতেনও খুব ছোট এক শহরে। তার মৃত্যুর পরও এ শহরটি কখনও গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে মর্যাদা পায়নি। আকসারা বা আক্‌সারায় নামের এ অঞ্চলেই ইন্তেকাল করেছিলেন কবি সাইফ ফারগানি।

কবি মাওলানা সাইফ-এর জন্মভূমি ফারগানা ট্রান্স অক্সিয়ানার বিশাল অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। এ অঞ্চলের ঠিক কোন্ প্রান্তে বা কোন্ এলাকায় তার জন্ম হয়েছিল এবং কবে তিনি স্বদেশ ত্যাগ করে পশ্চিমে যান তা স্পষ্ট নয়। তবে যৌবনেই তিনি এ অঞ্চল ত্যাগ করেছেন এমন সম্ভাবনাই বেশি। মাওলানা সাইফ তাব্রিজেও ছিলেন কিছুকাল। এরপর তিনি আকসারায় যান ও সেখানেই বাকি জীবন কাটান। হিজরি সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে সাইফ-এর জন্ম হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। তার কবিতা থেকে বোঝা যায় তিনি ৭০৫ হিজরিতে সম্ভবত শিশু বা কিশোর ছিলেন এবং ৮০ বা ৯০ বছর বয়সে মারা যান। খ্রিস্টিয় ১৩৪৮ সনে সাইফ মারা যান বলে মনে করা হয়।

মুহাম্মাদ বিন আলীর লেখা আকসারায়ি নামক বইয়ে মাওলানা সাইফকে শাইখ ও গবেষকদের নেতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তিনি কোন কোন্ সুফি সাধকদের কাছে সুফি সাধনার তালিম নিয়েছিলেন তা স্পষ্ট নয়।

মাওলানা সাইফ ছিলেন হানাফি মাজহাবের অনুসারী একজন সুন্নি। তিনি মহানবীর (সা) পবিত্র আহলে বাইতের ও আল্লাহর ওলিদের শানে প্রশংসাসূচক কবিতাও লিখেছেন। হযরত আলীর (আ) প্রশংসা করে তিনি বহু পংক্তি রচনা করেছেন। কারবালার মহান শহীদ ও নবী-বংশের মজলুম অবস্থা নিয়েও কবি সাইফ ক্বাসিদা লিখেছেন।

সাইফের কাব্য সংকলনে রয়েছে ক্বাসিদা, গজল, রুবাইয়াত ও ক্ষুদ্র কবিতাসহ ১২ হাজার পংক্তি। দৃশ্যত তার অন্য কোনো কাব্যগ্রন্থ নেই বা থাকলেও তা অজ্ঞাত রয়েছে। সাইফের ক্বাসিদাগুলোয় রয়েছে ইরফানি বক্তব্য এবং সেগুলোকে করা হয়েছে মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ ছাড়াও একত্ববাদ, মহানবীর (সা) প্রশংসা, উপদেশ, গবেষণালব্ধ বক্তব্য এবং সে যুগের নানা সমস্যা ও নানা শ্রেণীর অবস্থা নিয়ে সমালোচনাও রয়েছে সাইফের ক্বাসিদায়। রাজা-বাদশাহ ও আমিরদের প্রশংসা করে তিনি কখনও কবিতা লেখেননি।  

রাজা-বাদশাহ ও আমিরদের প্রশংসা করে সাইফ কবিতা রচনা করতেন না। তবে ইসলাম ধর্মকে শক্তিশালী করায় সম্রাট গ্বাজান খানের প্রশংসা করে কয়েকটি পংক্তি রচনা করেছেন সাইফ।  ইলখানি বংশের রাজা বা সম্রাটরা যে রুম অঞ্চলের জনগণের ওপর অনেক অবিচার করেছিল সেটাও তিনি তার কবিতায় উল্লেখ করেছেন। 

সাইফ ফারগানি বড় বড় কবিদের ক্বাসিদার প্রশংসা করেছেন তার কবিতায়। সে যুগের কবিদের রীতির আলোকে এমন প্রশংসা ছিল স্বাভাবিক। সে যুগে বড় বড় কবিদের কবিতার জবাব দিয়ে বা প্রশংসা করে কবিতা লিখতে না পারলে কোনো কবিকে বড় কবি বলেই ধরা হত না।#

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ২৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। 

ট্যাগ