২২ হাজার পরিবার লুটপাট করছে-ফিরোজ রশীদ: ভোটাধিকার অস্বীকৃত-সাইফুল হক
বাংলাদেশের বিজয়ের এত বছর পর আজকের বাংলাদেশ, প্রত্যাশা- প্রাপ্তি-সম্ভাবনা এবং করণীয় সম্পর্কে বর্তমান জাতীয় সংসদের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ও সিনিয়র রাজনীতিবিদ কাজী ফিরোজ রশীদ রেডিও তেহরানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বললেন, দেশকে মুক্ত করতে পেরেছি এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। তবে দেশে গণতান্ত্রিক ভিত্তি কি সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার জায়গাটিতে আমরা লড়াই করে যাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, পরিপূর্ণভাবে সব মানুষের অধিকার আমরা পুরোপুরিভাবে পূরণ করতে পারি নি। এখন ২২ হাজার পরিবার দেশে লুটপাট করছে। অর্থ বিদেশে পাচার করছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার সাইফুল হক বলেছেন, অবশ্যই স্বাধীনতা সবচেয়ে বড় অর্জন। অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বড় অর্জনও হয়েছে। তবে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার খুবই সংকুচিত হয়েছে। আর ভোটের অধিকার তো কার্যত এখন অস্বীকৃত।
তিনি আরও বলেন, গত ৪৯ বছরে অনেক বেশি দমনমূলক, নিপীড়নমূলক হয়েছে। আজকে একধরনের স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়েছে। ফলশ্রুতিতে বর্তমানে দেশে চুরি, দুর্নীতি,লুটপাট- সন্ত্রাস, জবর-দখল এবং অর্থপাচারের ঘটনা ঘটছে। সমগ্র বিষয়টা বাস্তবে ৪৯ বছরের মাথায় এসে একধরনের সামাজিক নৈরাজ্য দেখছি দেশে এখন।
সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ
রেডিও তেহরান: জনাব কাজী ফিরোজ রশীদ, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৯তম বিজয় বার্ষিকী উদযাপিত হলো। এতদিন পর এসে বাংলাদেশের প্রাপ্তি কি?

কাজী ফিরোজ রশীদ: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমাদের বিজয়ের ৫০ বছরে আমরা পা দিলাম। আজ থেকে ৫০ বছর আগে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে জীবনকে উৎসর্গ করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলাম। আমাদের একটি শর্ত ছিল যে বাঙালি জাতিকে আমরা স্বাধীন করব এবং স্বধীনতার চেয়ে মূল্যবান কোনো বস্তু কিংবা প্রাপ্তি আর কিছু নেই মানুষের জীবনে। বাঙালিরা স্বাধীনতার অর্থ জানে। ত্রিশ লক্ষ মানুষকে আমরা হারিয়েছি স্বাধীনতা যুদ্ধে। আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহসিকতার সাথে জীবন বাজি রেখে নয় মাস প্রাণপণ যুদ্ধ করে। মুক্তিযুদ্ধে প্রায় ২ লক্ষ মা-বোন তাদের সভ্রম হারিয়েছে। এসব ত্যাগের পরই ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় ছিনিয়ে আনলাম।
আপনার প্রশ্ন হচ্ছে বিজয়ের এই ৫০ বছর পর আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে কি না? আমি এককথায় বলব আমাদের প্রত্যাশা ছিল একটি স্বাধীনতা। এদেশে স্বাধীনতার জন্য বারবার লড়াই হয়েছে বিপ্লব হয়েছে। অবশেষে আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ-পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে একটি মরণপণ যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়লাম। সেই যুদ্ধে সকল অপশক্তিকে পরাজিত করে আমরা দেশ স্বাধীন করলাম। দেশ মুক্ত হয়েছে আজকে এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
রেডিও তেহরান: জনাব কাজী ফিরোজ রশীদ বললেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে, মুক্ত হয়েছে এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। প্রাপ্তির বিষয়ে কমরেড সাইফুল হক আপনি কী বলবেন?
সাইফুল হক: আপনার প্রশ্নের জন্য ধন্যবাদ। ১৯৭১ সালে একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্রে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের বিজয়ের একটি পর্ব সেদিন সমাপ্ত হয়েছিল। এটি অবশ্যই বড় অর্জন। আর গত ৫০ বছরে নিশ্চয়ই কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি আছে, আমাদের সাফল্য রয়েছে। কিন্তু যেটা গুরুত্বপূর্ণ –অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতার যে ঘোষণা ছিল-সাম্যের বাংলাদেশ, সামাজিক ন্যায়-বিচার ও মানবিক মর্যাদা এমনকি ১৯৭২ এর সংবিধানে যে চারটি মৌল নীতি ছিল দুভার্গ্যজনকভাবে আজকে ৪৯ বছর পর বাংলাদেশ তার ১৮০ ডিগ্রি উল্টোদিকে যাত্রা করেছে।

বাস্তবে আমরা পাকিস্তানি জামানার মতোই একদেশে দুই সমাজ দুই অর্থনীতি আজকে এখানে কায়েম হয়েছে। আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের অস্বীকৃতির জন্য যে মুক্তিযুদ্ধ এসেছিল আজকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে মানুষের সেই গণতান্ত্রিক অধিকার খুবই সংকুচিত। আর ভোটের অধিকার তো কার্যত এখন অস্বীকৃত।
রেডিও তেহরান: জনাব কাজী ফিরোজ রশীদ, আপনার কাছে জানতে চাইব, এই সুদীর্ঘ সময়ে অপ্রাপ্তিটা কী তাহলে, আপনি কি বলবেন? কোনো অপ্রাপ্তি আছে বলে আপনি মনে করেন?
কাজী ফিরোজ রশীদ: দেখুন, চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে পার্থক্য অনেক আছে। অনেক এমন প্রশ্ন করেন যে আমাদের গণতান্ত্রিক ভিত্তি কি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে? আমরা বলব না; এখনও সে লড়াই আমরা করে যাচ্ছি। পরিপূর্ণভাবে সমস্ত মানুষের যে অধিকার-সে অধিকার আমরা পুরোপুরিভাবে পূরণ করতে পারি নি।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে- একটি বড় বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমরা সে সময় লড়াই করেছিলাম। সেটি হচ্ছে পাকিস্তানের ২২ পরিবারের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন সংগ্রাম করেছিলাম। তারা আমাদের দেশটিকে লুটপাট করে খেত। এখন আমাদের বাংলাদেশে ২২ হাজার পরিবার লুটপাট করে খাচ্ছে। তাদের লুটপাটের টাকাটা আজ বিদেশে চলে যাচ্ছে। আপনারা সবাই দেখছেন যে, কানাডাতে বেগমপাড়া হচ্ছে। আমেরিকাতে বাড়িঘর করছে তারা। এই গরীব দেশের ট্যাক্সের টাকা যদি তারা বিদেশে পাচার করে নিয়ে যায়-তাদের চেয়ে দেশের বড় শক্র কেউ না!
রেডিও তেহরান: জনাব সাইফুল হক: অনেকে বলে থাকেন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির মাঝে অনেক বড় বেশি ব্যবধান রয়েছে। এই বক্তব্যকে আপনি কিভাবে দেখবেন?

সাইফুল হক: দেখুন, আমাদের প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির মধ্যে একটা বিশাল ব্যবধান রয়েছে। বাস্তবে মুক্তি যুদ্ধের পরেই ৭২ থেকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে একটি জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তোলা একটি আত্মমর্যাদা সম্পন্ন রাজনীতি গড়ে তোলার যাত্রাটা আমরা শুরু করতে পারি নি। বরং পদে পদে আমরা দেখছি যে, যে রাষ্ট্রটির হওয়ার কথা ছিল জনবান্ধব, মানুষের জন্য সংবেদনশীল সেই রাষ্ট্র গত ৪৯ বছরে অনেক বেশি দমনমূলক, নিপীড়নমূলক হয়েছে। আজকে একধরনের স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়েছে। ফলশ্রুতিতে বর্তমানে দেশে চুরি, দুর্নীতি,লুটপাট- সন্ত্রাস, জবর-দখল এবং অর্থপাচারের ঘটনা ঘটছে। সমগ্র বিষয়টা বাস্তবে ৪৯ বছরের মাথায় এসে একধরনের সামাজিক নৈরাজ্য দেখছি দেশে এখন।
রেডিও তেহরান: বাংলাদেশে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। একে বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় সফলতা হিসেবে দেখা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। অনেকে বলছেন, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য এটি সবচেয়ে বড় অর্জন। আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

কাজী ফিরোজ রশীদ: দেখুন যে-সব মেগা প্রজেক্টগুলো আছে-ধরুন একটা পদ্মা সেতু যুগ যুগ ধরে থাকবে। সরকার আসে সরকার যাবে কিন্তু যতদিন পদ্মা সেতু থাকবে ততদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে পারবে না।

যতদিন চট্টগ্রামে কর্ণফুলি নদীর তলদেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু টানেল থাকবে, যতদিন পায়রা সমুদ্র বন্দর থাকবে, আমাদের মেট্টোরেল থাকবে ততদিন কিন্তু শেখ হাসিনার নাম মুছে যাবে না। এসব কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার বড় বড় অর্জন। দেশ স্বাধীন হয়েছিল বলেই কিন্তু আজ এসব অর্জন হয়েছে।
পদ্মাসেতুসহ মেগা প্রজেক্টগুলো সম্পর্কে জনাব সাইফুল হক আপনার মূল্যায়ন কী?
সাইফুল হক: নিশ্চয়ই আমরা আমাদের দেশের উন্নয়ন চাই্। আমাদের অবকাঠামোগত যে উন্নয়ন সেখানে নিশ্চয়ই বড় বড় প্রকল্প হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে যেসব মেগাপ্রকল্প তৈরি হচ্ছে তাতে আমাদের অভিজ্ঞতা খুবই শোচনীয়। আমরা দেখছি বড় বড় প্রকল্প মানে হচ্ছে মেগা দুর্নীতি। সেকারণে যখন মেগা প্রকল্পের কথা বলা হয় তখন একদিকে আমরা আশাবাদী হতে চাই অন্যদিকে আমাদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা কাজ করে যে রাষ্ট্রীয় সম্পদের একটা বেসুমার চুরি ও আত্মসাতের রাস্তা বুঝি খুলে গেল।#
রেডিও তেহরান: তো জনাব কাজী ফিরোজ রশীদ ও কমরেড সাইফুল হক বাংলাদেশের বিজয়ের এত বছর পর প্রত্যাশা-প্রাপ্তি এবং সম্ভাবনা নিয়ে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলার জন্য আপনাদেরকে আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
কমরেড সাইফুল হক: আমি সবাইকে আরেকবার সালাম জানাই।
কাজী ফিরোজ রশীদ: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২৪
- বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।