পাশ্চাত্যে জীবন ব্যবস্থা (পর্ব-১৪)
গত আসরে আমরা বলেছি, ব্রিটেনে ছয় হাজার শিশু-কিশোরের উপর চালানো এক গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, শিশুদের উপর বিশেষকরে সাত বছরের বেশি বয়সী শিশুদের ওপর বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের মারাত্মক প্রভাব রয়েছে।
সাধারণভাবে তাদের মধ্যে বিষণ্ণতার পাশাপাশি নানা ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দেয় এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে এসব সমস্যা আরো প্রকট হয়। বিশেষ করে পরিবারে বাবার অনুপস্থিতি কন্যা সন্তানের ওপর খুবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। 'টোয়াইস এডোপটেড' বা 'দুই বার দত্তক নেয়া হয়েছে' শীর্ষক বইয়ের লেখক মাইকেল রিগান তার নিজের বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের উদাহরণ টেনে লিখেছেন, যখন আমার বাবা-মা আলাদা হয়ে গেল তখন তারা যেন আমার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু কেড়ে নিলো। নিরাপত্তাবোধ, ভালোবাসা, সুখানুভূতি এর সবই তারা যেন নষ্ট করে দিল, সব ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেল। এখন শিশু সন্তানটির ওপর দায়িত্ব পড়লো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছিন্ন-ভিন্ন অংশ জড়ো করে গুছিয়ে নেয়ার এবং একটি পথ নির্বাচনের। তালাক সব সময় এ ধরণেরই এক কঠিন সামাজিক সমস্যা। যাইহোক আজ আমরা পারিবারিক সহিংসতা নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করব।
শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে সুনাম অর্জন করেছেন জার্মান শিশু বিশেষজ্ঞ হেনরি কেমপে। তিনি ১৯৬২ সালে শিশুদের ওপর সহিসংতা নিয়ে একাধিক নিবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি সহিংসতার শিকার শিশুদের ওপর এ ধরণের আচরণের নেতিবাচক দিকগুলো সুন্দরভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হন। হেনরি কেমপে ছিলেন শিশুদের চিকিৎসক। যেসব শিশু সহিসংতার শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতো তিনি তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতেন এবং তা নিয়ে গবেষণা চালাতেন। এসব তথ্যভিত্তিক গবেষণার ফলাফল ও বিশ্লেষণ ফুটে উঠতো তার লেখায়। নির্যাতনের কারণে শিশুদের শরীর পুড়ে যাওয়া ও হাড় ভেঙে যাওয়ার মতো নানা স্পর্শকাতর ও মর্মস্পর্শী ঘটনা স্থান পেয়েছে তার নিবন্ধে। তার হৃদয়স্পর্শী লেখাগুলো তৎকালীন সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর প্রভাবে ইউরোপের স্বেচ্ছাসেবী, চিকিৎসক, নার্স, পুলিশ, অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং নারী ও শিশু আন্দোলনকর্মীরাও সোচ্চার হয়ে ওঠেন। তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় আইনে পরিবর্তন আনা হয়। নতুন আইনে নির্যাতিত শিশুদের স্বার্থ সংরক্ষণের কথা বলা হয়। এটি পারিবারিক সহিংসতার বিরুদ্ধে একটি বড় অর্জন এতে কোনো সন্দেহ নেই।
নিজের পারিবারের কোন একজন সদস্যের ওপর কোনো ধরণের শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন এবং আর্থিক ক্ষতি সাধন পারিবারিক সহিংসতা হিসেবে গণ্য হয়। এখানে পারিবারের সদস্য বলতে রক্ত সম্বন্ধীয় বা বৈবাহিক সম্পর্কীয় কারণে অথবা পালক বা যৌথ পরিবারের সদস্য হবার কারণে প্রতিষ্ঠিত কোনো সম্পর্ককে বুঝানো হয়। শারীরিক নির্যাতন বলতে এমন কোনো কাজ বা আচরণ করাকে বুঝায়, যার কারণে ব্যক্তির জীবন, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা বা শরীরের কোন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া পরিবারের কোনো ব্যক্তিকে অপরাধমূলক কাজ করতে বাধ্য করা বা প্ররোচনা দেয়াও এর অন্তর্ভূক্ত। আর মানসিক নির্যাতন বলতে মৌখিক নির্যাতন, অপমান, অবজ্ঞা, ভীতি প্রদর্শন বা এমন কোনো কথা বলাকে বুঝায় যাতে একজন ব্যক্তি মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মনোকষ্টে ভোগে। পাশ্চাত্যের আইনে এসব বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। কিন্তু আইন প্রণয়নের পরও পাশ্চাত্যে পারিবারিক সহিংসতার অবসান ঘটেনি এবং এখনও এটি একটি বড় সামাজিক ব্যাধি হিসেবে রয়ে গেছে।
পাশ্চাত্যের লাইফ স্টাইল অনুসরণকারী দেশগুলোতে দেখা যাচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটার কারণে অনেক সময়ই সৎ মা অথবা সৎ বাবার মাধ্যমে শিশুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কোনো শিশু প্রতিবন্ধী হলে দেখা যায়, সমাজের লোকজনের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকেও সে অবহেলার শিকার হয় যা তাকে মানসিকভাবে চরম হতাশাগ্রস্ত করে। শিশু ও নারীরাই পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয় সবচেয়ে বেশি। ফ্রান্সে গড়ে প্রতি তিন দিনে একজন করে নারী তার বর্তমান অথবা সাবেক স্বামীর হাতে নিহত হন। ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে- ২০১৭ সালে একশ'র বেশি নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৬ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, সেখানে এক-চতুর্থাংশ নারীই পারিবারিক সহিংসতার শিকার। বৃটেনের ২০১৭ সালের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ওই বছরে সেখানে পুরুষের হাতে মারা গেছেন ১৩৯ জন নারী। এর মধ্যে ২০ শতাংশকে হত্যা করা হয়েছে অত্যন্ত নির্মমভাবে।
তবে মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, পাশ্চাত্যের লাইফ স্টাইল অনুসরণকারী দেশগুলোতে পারিবারিক সহিংসতার মাত্রা বেশি হওয়ার কারণ কি? বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, পাশ্চাত্যের পরিবার ব্যবস্থার যৌক্তিক কাঠামো ভেঙে দেওয়া হয়েছে। অতীতে নারী, পুরুষ ও সন্তানদের মধ্যে দায়িত্বের বিন্যাস ছিল তা এখন আর মেনে চলা হয় না। দায়িত্বের চিরাচরিত ধারা পুরোপুরি পাল্টে দেওয়া হয়েছে। পুরুষ সদস্যরা পরিবারের অন্য সদস্যদের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে অর্থ রোজগারের দায়িত্ব পালন করতো। তারা সন্তানসহ গোটা পরিবার সামলাতো। কিন্তু এখন নারীরা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় বাইরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। এর ফলে নারীরা সন্তানদের লালনপালনে আগের মতো সময় দিতে পারছে না। তারাও পুরুষের মতো বাইরের জগত সামলাতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছে। নানা পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, শিল্পোনত দেশগুলোতে ঘরের বাইরে নারীদের কাজের ক্ষেত্র তৈরি হওয়ার পর পারিবারিক ঝামেলা বেড়ে গেছে। নারীরা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে।
নারীরা আগে পরিবার ব্যবস্থাপনায় যে ভূমিকা রাখতো এখন আর সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারছে না। অতীতে পরিবার ব্যবস্থায় নারীরা সন্তান লালন-পালন এবং পরিবারের সব সদস্যের জন্য একটি নিরাপদ ও শান্তিময় পরিবেশ নিশ্চিত করার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতো। কিন্তু এখন তারাও পুরুষদের মতো অর্থ উপার্জনের পেছনে সময় দেওয়ায় সন্তানদের দেখাশোনা সঠিকভাবে করতে পারেন না। ঘরের বাইরে কাজ শেষে পুরুষের মতো একজন নারীও ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে ঘরে ফেরেন। এর ফলে স্বামী ও সন্তানদের মমতা ও ভালোবাসার চাহিদা পরিপূর্ণভাবে পূরণ করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। এসব কারণে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও অসন্তোষ লেগেই থাকে। শান্তির সোনালী নীড় অশান্তির উৎস হয়ে ওঠে।#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ০১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।