ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (পর্ব-৪৯): ইরানের দ্বিতীয় সংক্ষিপ্ত অভিযান
ইরানি যোদ্ধারা ইরাকের অভ্যন্তরে মুসলিম ইবনে আকিল অভিযান শুরু করার পর সাদ্দাম সরকার জাতিসংঘে নিজেকে শান্তিকামী ও ইরানকে যুদ্ধকামী হিসেবে তুলে ধরার লক্ষ্যে ব্যাপক রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলো সাদ্দামের অপরাধের সহযোগী ছিল বলে তারা ইরাকের দাবি অনুযায়ী ৫২২ নম্বর প্রস্তাব অনুমোদন করে। প্রস্তাবে যুদ্ধের কথা উল্লেখ না করে ‘ইরাক-ইরান সর্বশেষ পরিস্থিতি’ পরিভাষা ব্যবহার করা হয়। এতে উভয় দেশের সেনাবাহিনীকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমান্তে ফেরত নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। সেইসঙ্গে ইরাক এর আগে ৫১৪ নম্বর প্রস্তাব মেনে নেয়ায় বাগদাদকে ধন্যবাদ জানানো হয়।
প্রস্তাবে বলা হয়, উভয় দেশকে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং যুদ্ধবিরতি তদারকি করার জন্য জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল মোতায়েন করা হবে। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলো কিনা তা জাতিসংঘ মহাসচিবকে লিখিত আকারে নিরাপত্তা পরিষদকে জানাতে বলা হয়। এর আগের প্রস্তাবগুলোর মতো এই প্রস্তাবেও এই যুদ্ধ শুরুর জন্য দায়ী দেশকে চিহ্নিত করা এবং আগ্রাসনের শিকার দেশটিকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কোনো কথা বলা হয়নি। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এই প্রস্তাবকে পক্ষপাতদুষ্ট অভিহিত করে তা প্রত্যাখ্যান। এর পরিপ্রেক্ষিতে সাদ্দাম সরকার সীমান্তবর্তী ইরানি শহর ও গ্রামগুলোতে বোমাবর্ষণ করার পাশাপাশি ইরানের গভীর অভ্যন্তরের শহরগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে শুরু করে।
মুসলিম ইবনে আকিল অভিযানের পর ইরানের কাছে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইরাক সরকার বা তার পৃষ্ঠপোষকদের কেউই ন্যায়ভিত্তিক শান্তি চায় না; বরং ইরাক যুদ্ধের ময়দানে চাপের মধ্যে পড়ায় তাকে উদ্ধার করতেই ৫২২ নম্বর প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। যতদিন ইরাকি সেনা ইরানের অভ্যন্তরে ছিল ততদিন দু’দেশের সেনাবাহিনীকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমান্তে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়নি। কিন্তু যখনই ইরান ইরাকের অভ্যন্তরে অভিযান চালাতে গেছে তখনই জাতিসংঘের টনক নড়েছে। কাজেই ইরান ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ইরাক সরকারকে আত্মসমর্পনে বাধ্য করার জন্য সামরিক অভিযান চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা হাতে নেয়।
এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘মহররম’ নামক অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়। ১৯৮২ সালের ১ নভেম্বর সীমান্তবর্তী মুসিয়ান অঞ্চলের দেহলোরান থেকে ফাক্কে এলাকা পর্যন্ত এই অভিযান শুরু করেন ইরানি যোদ্ধারা। দেহলোরানের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এবং ‘এইন খোশ’ এলাকার পশ্চিমে বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকায় মহররম অভিযান শুরু করা হয়। ইরাকি বাহিনী ইরানের কাছ থেকে ছাড় আদায় করার লক্ষ্যে যেকোনো মূল্যে এই পার্বত্য অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার চেষ্টা করছিল। ফাক্কে থেকে দেহলোরান পর্যন্ত এলাকার হামরিন পর্বতমালা শত্রুর দখলমুক্ত করার ছিল এই অভিযানের মূল লক্ষ্য। প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল ফাতহুল মুবিন অভিযানের ধারাবাহিকতা যার মাধ্যমে আগের অভিযানের অর্জনকে পূর্ণতা দেয়া সম্ভব হয়েছিল। এই অঞ্চলের ঠিক পশ্চিম পার্শ্বেই ইরাকের ‘আল-আম্মারা’ ও ‘আলী গারবি’ শহর এবং দজলা নদী অবস্থিত। ইরান শুরু থেকেই আল-আম্মারা ও আলী গারবি শহরের মধ্যবর্তী দজলার পূর্ব অববাহিকা নিজের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। ওদিকে এই শহর রক্ষা করা ইরাকিদের কাছেও ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

মহররম অভিযানটি চালানো হয় কয়েকটি পর্যায়ে এবং আলাদা আলাদাফ্রন্টে। অভিযান শুরুর আধাঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ইরানি যোদ্ধারা একটি ফ্রন্টে বেশ কিছু ইরাকি সেনাকে আটক করে। আরেকটি ফ্রন্টে এক ব্রিগেডেরও বেশি ইরাকি সেনা ইরানি যোদ্ধাদের হাতে ঘেরাও হয়ে পড়ে এবং তাদের বেশিরভাগই আটক হয়। এভাবে তিনটি ফ্রন্টে ইরানি যোদ্ধারা তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে যান। কিন্তু চতুর্থ ফ্রন্টে কিছু সমস্যার কারণে ইরান সম্পূর্ণ লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়।
এই অভিযানে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর ৫২টি এবং সেনাবাহিনীর ৮টি ব্যাটালিয়ন অংশগ্রহণ করে। অন্যদিকে অভিযান পরিচালনার এলাকাগুলোতে ইরাকের ২০ ব্যাটেলিয়ান সেনা মোতায়েন ছিল। এ ছাড়া, ইরাকের ১০ ব্যাটেলিয়ন ট্যাংকের বিপরীতে ইরানের ট্যাংক ছিল ৬ ব্যাটেলিয়ন। বিমান শক্তির দিক দিয়ে ইরান এই অভিযানে ১০টি কোবরা হেলিকপ্টার, ১০টি ‘বেল-২১৪ হেলিকপ্টার’ ও ৪টি চিনুক হেলিকপ্টার ব্যবহার করে। মহররম অভিযানে ইরান ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে এবং ইরাকি বাহিনীর মারাত্মক ক্ষতি হয়। এই অভিযানের ফলে দেহলোরান এলাকার ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এইন খোশ মহাসড়ক ইরাকি বাহিনীর আওতামুক্ত করা সম্ভব হয় এবং হামরিন পর্বতমালা ইরাকি বাহিনীর দখলমুক্ত হয়।
অভিযানের ফলে বেশ কয়েকটি তেল কূপ ইরাকি বাহিনীর কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করা হয় এবং প্রায় ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। এ ছাড়া, ইরানের ৫৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকা শত্রুর দখলমুক্ত হয় এবং ইরাকের প্রায় ৩৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ইরানের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। মহররম অভিযানে তিন হাজার ৪০০ ইরাকি সেনা ইরানের হাতে বন্দি হয় এবং সাদ্দাম বাহিনীর সাত হাজার সেনা হতাহত হয়। এ ছাড়া, অভিযানে ১৫০টি ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান, ২৫০টি গাড়ি, ৫১টি ১০৬ মিলিমিটার রাইফেলসহ কামানের বেশ কিছু গোলাবারুদ ইরানি যোদ্ধাদের হস্তগত হয়। ইরানের পক্ষে প্রায় ৫৩০ জন যোদ্ধা শহীদ এবং এর চেয়ে বেশি সংখ্যক যোদ্ধা আহত হন।
মহররম অভিযানে পূর্ব নির্ধারিত বেশিরভাগ লক্ষ্য অর্জিত হয় এবং ইরান গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জন করে। মুসলিম ইবনে আকিল অভিযানে বিজয়ের পর এই অভিযানেও ইরানের সাফল্যে পরবর্তী অভিযানগুলোতেও বিজয়ের ব্যাপারে ইরান আশাবাদী হয়ে ওঠে। ঠিক এ কারণে ইসলামি বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.) এই বিজয়কে ‘মহান মহররম বিজয়’ বলে আখ্যায়িত করেন। এই অভিযানের পর ইমাম এক ফতোয়ায় বলেন, “এখন শক্তি-সামর্থ্যবান সবাইকে যুদ্ধে যেতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যাকে যুদ্ধে যাওয়ার উপযুক্ত মনে করবেন তাকে অবশ্যই যুদ্ধে যেতে হবে। এখন অন্য যেকোনো কাজের চেয়ে যুদ্ধে যাওয়া বেশি জরুরি।”
এদিকে প্রতিবারই যেকোনো ফ্রন্টের যুদ্ধে ইরানি যোদ্ধাদের কাছে ধরাশায়ী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইরাকি সেনারা সীমান্তবর্তী ইরানি শহরগুলোর বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা চালিয়ে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিত।
মহররম অভিযান শেষ হওয়ার পর ইরানের সীমান্তবর্তী দেজফুল শহরের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণ করে সাদ্দাম বাহিনী। ইমাম খোমেনী ইরাকি বাহিনীর এই কাপুরুষোচিত ও বর্বর হামলার প্রতিক্রিয়ায় বলেন: “সাদ্দাম যখনই পরাজিত হয় তখনই সীমান্তবর্তী বঞ্চিত আরব জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত শহরগুলোর নিরপরাধ মানুষগুলোর ওপর দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। যদি ইরাকি বাহিনী আবার পরাজিত হয় তাহলে এসব সীমান্তবর্তী শহরের ওপর সাদ্দাম ভয়াবহ অপরাধযজ্ঞ চালাতে পারে। আর দেশের ভেতর সাদ্দামের মিত্র মোনাফেকিন গোষ্ঠী তো রয়েছেই। নিজের পরাজয় ধামাচাপা দেয়ার জন্য সাদ্দাম এই কাজ করে। মহররম অভিযানে আমরা বিজয়ী হলেও সাদ্দাম টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে দাবি করেছে, ইরান হামলা চালালও ইরাকি বাহিনী নাকি এই অভিযানে জয়লাভ করেছে।”#
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ০২
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।