ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০২১ ২০:০০ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা আয-যুমারের ৪৬ ও ৫০ নম্বর আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৪৬ নম্বর নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

قُلِ اللَّهُمَّ فَاطِرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ عَالِمَ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ أَنْتَ تَحْكُمُ بَيْنَ عِبَادِكَ فِي مَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ (46)

“বলুন, হে আল্লাহ! (হে) আসমান ও যমীনের স্রষ্টা, (হে) দৃশ্য ও অদৃশ্যের জ্ঞানী, আপনিই আপনার বান্দাদের মধ্যে ফয়সালা করবেন, যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করত।” (৩৯:৪৬)

এই আয়াতে আল্লাহর রাসূলকে উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে: আপনি মুশরিকদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন এবং আসমান ও জমিনের স্রষ্টা এবং সব গোপন খবরের মালিক আল্লাহর পানে তাকান। দুনিয়ার জীবনে মানুষ যেসব বিষয়ে মতপার্থক্য করে মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন সেসব বিষয়ে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবেন। আল্লাহ তায়ালা যে সৃষ্টিজগতের একচ্ছত্র অধিপতি সে বিষয়টি কিয়ামতের দিন সবার সামনে স্পষ্ট হয়ে যাবে। সেদিন তাঁর মীমাংসা সবাই মেনে নেবে। পার্থিব জীবনে যারা গোঁয়ার্তুমি ও অহংকারের কারণে সত্য দ্বীন মেনে নেয়নি কিয়ামতের দিন তারা তাদের অপরাধ স্বীকার করে নেবে। কিন্তু সেদিনের স্বীকারোক্তি তাদের কোনো কাজে আসবে না। এসব দাম্ভিক কাফির ও মুশরিককে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে।

এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:

১- আমরা গায়রুল্লাহ বা আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছুর ওপর ভরসা করা থেকে বিরত থাকব এবং প্রতিটি কথা ও কাজে কেবল এই মহান সত্ত্বার আদেশ-নিষেধ মেনে চলব।

২- যিনি গোটা বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন তিনি এই জগতের সকল গোপন রহস্য সম্পর্কে পরিপূর্ণ ওয়াকিবহাল।

৩- আল্লাহ তায়ালা তাঁর এই মহাজ্ঞান দিয়ে বিচার করবেন; ফলে কিয়ামতের কারো প্রতি বিন্দুমাত্র জুলুম করা হবে না।

সূরা যুমারের ৪৭ ও ৪৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

وَلَوْ أَنَّ لِلَّذِينَ ظَلَمُوا مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا وَمِثْلَهُ مَعَهُ لَافْتَدَوْا بِهِ مِنْ سُوءِ الْعَذَابِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَبَدَا لَهُمْ مِنَ اللَّهِ مَا لَمْ يَكُونُوا يَحْتَسِبُونَ (47) وَبَدَا لَهُمْ سَيِّئَاتُ مَا كَسَبُوا وَحَاقَ بِهِمْ مَا كَانُوا بِهِ يَسْتَهْزِئُونَ (48)

“এবং যদি গোনাহগারদের কাছে পৃথিবীর সব কিছু থাকে এবং তার সাথে সমপরিমাণ আরও থাকে, তবে অবশ্যই তারা কেয়ামতের দিন সে সবকিছুই নিস্কৃতি পাওয়ার জন্যে মুক্তিপণ হিসেবে দিয়ে দেবে। (কিন্তু সেদিন) আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের সামনে এমন শাস্তি স্পষ্ট হবে যা তারা কল্পনাও করত না।” (৩৯:৪৭)

“এবং (সেদিন) দেখবে, তাদের দুষ্কর্মসমূহ তাদের সামনে স্পষ্ট হবে এবং যে বিষয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ, তা তাদেরকে গ্রাস করে নেবে।” (৩৯:৪৮)

এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে, পার্থিব জীবনে গোনাহগার ও জুলুমকারী ব্যক্তিরা কিয়ামতের দিন ভয়াবহতম শাস্তির সম্মুখীন হবে। এমনকি তারা সেদিন যে আজাবের সম্মুখীন হবে তা কখনো তাদের কল্পনাতেও আসেনি। পবিত্র কুরআনে জুলুম বলতে শিরক ও কুফরের মতো বিশ্বাসগত বিষয়কে যেমন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তেমনি পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অন্যের প্রতি জুলুমকেও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। তবে এটা স্পষ্ট যে, বিশ্বাসগত জুলুম সামাজিক জুলুমের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকারক ও ভয়ঙ্কর। কারণ, সামাজিক জুলুমের ক্ষতি অনেক সময় পূরণ করা যায় কিন্তু বিশ্বাসগত জুলুম প্রজন্মের পর প্রজন্মকে পথভ্রষ্ট করে দেয় যেখান থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব হয় না।

পরের আয়াতে বলা হচ্ছে, তারা দুনিয়াতে যেসব মন্দকাজ করত সেগুলোই আজ জাহান্নামের আগুন হয়ে তাদের সামনে ধরা দিয়েছে। পার্থিব জীবনে তারা সম্পদ আহরণ ও তা জমা করার কাজে ব্যস্ত ছিল এবং তারা মনে করত, এই সম্পদই তাদেরকে সৌভাগ্য এনে দেবে। কাজেই সম্পদশালী এসব মানুষ কিয়ামতের কথা শুনলে তা নিয়ে হাসিঠাট্টায় মেতে উঠত। তারা মনে করত, কিয়ামতের সতর্কবাণী কেবল অশিক্ষিত ও অসভ্য লোকেরা বিশ্বাস করে।  কিন্তু আজ কিয়ামতের ময়দানে তারা দেখতে পাচ্ছে তারা যেসব বিষয়কে ঠাট্টা করত তাতেই তারা ভয়ঙ্করভাবে ধরা পড়েছে। আর দুনিয়াতে তারা যে সম্পদ আহরণ করেছিল তা তাদের কোনো কাজেই আসছে না।

এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:

১- কেউ যদি দুনিয়ার সব সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপত্তির মালিকও হয় তবুও তা  কিয়ামতের দিন কোনো কাজে আসবে না।

২- কিয়ামতের দিন সব গোপন বিষয় প্রকাশ হয়ে পড়বে। জান্নাত ও জাহান্নাম বাস্তব রূপে মানুষের সামনে স্পষ্ট হবে।

৩- আমরা যেন ধর্মীয় কোনো বিশ্বাস বা আদেশ-নিষেধ নিয়ে কোনো অবস্থাতেই হাসি-ঠাট্টা না করি। যদি করি তাহলে কিয়ামতের দিন অনুতপ্ত হতে হবে।

সূরা যুমারের ৪৯ ও ৫০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

  فَإِذَا مَسَّ الْإِنْسَانَ ضُرٌّ دَعَانَا ثُمَّ إِذَا خَوَّلْنَاهُ نِعْمَةً مِنَّا قَالَ إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ بَلْ هِيَ فِتْنَةٌ وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ (49) قَدْ قَالَهَا الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَمَا أَغْنَى عَنْهُمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ (50)  

“মানুষকে যখন দুঃখ-কষ্ট স্পর্শ করে, তখন সে আমাকে ডাকতে শুরু করে, এরপর আমি যখন তাকে আমার পক্ষ থেকে নেয়ামত দান করি, তখন সে বলে, এটা তো আমি আমার জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়েই প্রাপ্ত হয়েছি।  (এমনটি নয়) বরং এই নেয়ামত (তার জন্য) এক পরীক্ষা, কিন্তু তাদের অধিকাংশই বোঝে না।” (৩৯:৪৯)

“তাদের পূর্ববর্তীরাও তাই বলত, কিন্তু তারা যা অর্জন করেছিল তা তাদের কোন উপকারে আসেনি।” (৩৯:৫০)

এই দুই আয়াতে অকৃতজ্ঞ মানুষের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে বলা হচ্ছে: বেশিরভাগ মানুষ দুঃখ-কষ্টের সময়ই কেবল আল্লাহকে ডাকে। এরপর আল্লাহর অনুগ্রহে দুঃখ থেকে উত্তরণ ঘটার সঙ্গে সঙ্গে তারা আল্লাহকে ভুলে যায়। তখন তারা বলে, আমি আমার বুদ্ধি ও কর্মদক্ষতা দিয়ে সমস্যার সমাধান করে ফেলেছি এবং এই নেয়ামতগুলো অর্জন করেছি।

পবিত্র কুরআন এ ধরনের অকৃতজ্ঞ মানুষের এই ভ্রান্ত ধারণার জবাবে বলছে: যে নেয়ামত তোমাদেরকে দেয়া হয়েছে তা তোমাদের জন্য পরীক্ষা। এর মাধ্যমে তোমরা এই নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা আদায় করো নাকি অকৃতজ্ঞ হয়ে যাও আল্লাহ তায়ালা তা পরীক্ষা করতে চান।

পরের আয়াতে বলা হচ্ছে: ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় যুগে যুগে সব মানুষ আল্লাহ তায়ালার দেয়া নেয়ামত নিয়ে এ ধরনের কথাই বলে এসেছে। যাকেই ধন-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি বা পদমর্যাদা দান করা হয়েছে সে-ই আল্লাহ তায়ালাকে ভুলে গেছে। সে ভেবে নিয়েছে, এই সম্পদ ও প্রতিপত্তি তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা এনে দেবে।  কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তারা যা কিছু অর্জন করেছে তা দিয়ে কিয়ামতের দিন তারা তাদের কঠিন পরিণতি ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।

এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- পার্থিব জীবনে বিপদ-আপদ আসলে মানুষ নিজের অক্ষমতা ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতা উপলব্ধি করে। এর ফলে সে আল্লাহমুখী হয় ও তাঁর সাহায্য কামনা করে।

২-  পার্থিব জীবনের ধন-সম্পদ ও সুখ-শান্তি মানুষকে আল্লাহ তায়ালার কথা ভুলিয়ে রাখে এবং মানুষকে অহংকারী ও স্বেচ্ছাচারী বানিয়ে দেয়।

৩- বিপদ-আপদ এবং সুখ-শান্তি উভয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা।  এর মাধ্যমে কৃতজ্ঞ ও অকৃতজ্ঞ মানুষগুলো চিহ্নিত হয়ে যায়।#

পার্সটুডে/এমএমআই/এআর/৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।