ইরানের পণ্যসামগ্রী: বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইরানের স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জন
গত আসরে আমরা কথা বলার চেষ্টা করেছি ইরানের বিদ্যুৎ শিল্প নিয়ে। একথা অনস্বীকার্য যে বিশ্বব্যাপী আজ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো বিদ্যুৎ সমস্যা।
বিভিন্ন সমাজে জীবন মানের উন্নয়ন ও স্থায়ী উৎকর্ষের পেছনে বিদ্যুতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই বিদ্যুত চাহিদা নিশ্চিত করা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য একটি মৌলিক বিষয়।
ইরানে বহু উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা রয়েছে। যদিও শুরুটা হয়েছিল কয়লা দিয়ে। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে মোহাম্মাদ হোসাইন মাহদাভি নামের এক ব্যক্তি কয়লাভিত্তিক জেনারেটর কিনে এবং তা স্থাপন করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে তেহরান শহরের কিছু অংশকে আলোকিত করেছিলেন। যেহেতু জেনারেটরটি ছিল কয়লাচালিত সেজন্য এর খরচও ছিল অনেক বেশি। সুতরাং কয়লার পরিবর্তে ডিজেল চালিত জেনারেটর ব্যবহার করার চেষ্টা হলো। এরপর ধীরে ধীরে এ ক্ষেত্রে আরও পরিবর্তন ও অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে।
শহরের ব্যাপক বিস্তার, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং ইরানের অর্থনীতিতে নতুন নতুন শিল্পের প্রবেশ ঘটার ফলে বিদ্যুতের চাহিদাও স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়। এই সময় দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য দায়বদ্ধ একটি সমন্বিত সাংগঠনিক সংস্থার অস্তিত্বের বিষয়টি দৃঢ়ভাবে অনুভূত হচ্ছিল। এই চাহিদা মেটানোর জন্য বিদ্যুৎশিল্প ক্ষেত্রে সরকারি পদক্ষেপের প্রয়োজন দেখা দিল। সেই সুবাদেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা, বিদ্যুৎ সরবরাহ করা, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম তৈরি, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ করা ইত্যাদি দায়িত্ব সরকারি খাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। এছাড়াও বিদ্যুৎ শিল্পের ক্ষেত্রে যেমন বেসরকারী খাতের কার্যক্রম যেমন ট্রান্সফর্মার উত্পাদন, মিটার উত্পাদন ও বৈদ্যুতিক তার উত্পাদন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকারের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। উল্লেখ্য যে ইরানে বিদ্যুৎ শিল্প জনসেবামূলক।
বেসরকারী খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলিও মূলত উত্পাদন এবং বিক্রয়ের জন্য নয় বরং উত্পাদন সংবেদনশীলতা এবং বিদ্যুৎ বিভ্রাট সংক্রান্ত উদ্বেগের কারণেই নির্মিত হয়েছে। কিছু কিছু কারখানা এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানও আছে যারা তাদের পণ্য উত্পাদন বা পরিষেবা সরবরাহের প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে যেন ক্ষতির সম্মুখিন হতে না হয় তা রোধ করতে নিজেদের ফ্যাক্টরিতে নিজস্ব উদ্যোগে জেনারেটর স্থাপন করেছে। সময়ের পরিক্রমায় ইরানের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে বিশেষ করে যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না সেসব এলাকায় বিদ্যুত সরবরাহ করার জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়। ইরানের বহু পাওয়ার প্লান্ট মানে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পর।
![](https://media.parstoday.ir/image/4bvc119edf7e7e1pi0v_800C450.jpg)
বলছিলাম ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পরই বিদ্যুৎ খাতে ইরানের অগ্রগতি হয়েছে দর্শনীয় পর্যায়ে। একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র সর্বোচ্চ পঁচিশ থেকে ত্রিশ বছর সার্ভিস দিতে পারে। এই হিসেবে ইরানের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এখনও তরুণ বয়সী অর্থাৎ এখনও প্রাচীন হয়ে ওঠে নি। বিদ্যুৎ সংযোগ পাবার কল্যাণে ইরানের প্রায় সকল শহর, নগর, গ্রাম-গঞ্জই বিদ্যুতের অনুগ্রহে প্রোজ্জ্বল হয়েছে। যদিও ভৌগোলিক দিক বিবেচনা করলে দেখা যাবে ইরানের একেকটি গ্রাম আরেকটি গ্রাম থেকে বেশ দূরে দূরেই অবস্থিত। সুতরাং ইরানের মতো বিশাল আয়তনের একটি দেশের গ্রামে গঞ্জে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ কাজটি খুব একটা সহজসাধ্য ছিল না। এর বাইরেও ইরানে রয়েছে বিশাল বিশাল পর্বতমালা, রয়েছে জঙ্গলের পর জঙ্গল আবার মরুভূমির পর মরুভূমি। এই বর্ণনার দৃশ্যটি সচক্ষে কিংবা কল্পচোখেও দেখলে বিদ্যুৎ সরবরাহের কাজটি যে কতোটা দুরূহ একটা ব্যাপার ছিল তা সহজেই অনুমান করা যাবে।
ইরানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জ্বালানির অর্ধেকরও বেশি ব্যবহার হয় বাণিজ্যিক ও আবাসিক খাতে। শতকরা তেত্রিশ ভাগ বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয় শিল্পখাতে আর বাদবাকি বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় কৃষিখাতসহ অন্যান্য খাতে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাচুর্যের দিক থেকে ইরান বিশ্বের শীর্ষ বিশটি দেশের তালিকাভুক্ত রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইরানের অবস্থান প্রথম পর্যায়ে রয়েছে। এ অঞ্চলে বৃহত্তম বিদ্যুৎ শিল্প নেটওয়ার্ক রয়েছে ইরানের। তাই ইরান তাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে দেশের বিদ্যুৎ নেটওয়ার্ক সংযোগ স্থাপন করেছে। প্রাকৃতিক গ্যাস এবং অপরিশোধিত তেলের উচ্চ মওজুদও রয়েছে ইরানে। সেইসাথে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনায় প্রয়োজনীয় জ্ঞান এবং দক্ষতাসহ সকল সরঞ্জাম নির্মাণে স্বয়ংসম্পূর্ণতাঅর্জন করেছে ইরান। বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে তাই অন্য কারো সহযোগিতা নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না ইরানের।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষেত্রে ইরানের স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জনের কথা বলছিলাম আমরা। যেহেতু ইরানের সঙ্গে বেশ কয়েকটি দেশের স্থল সীমান্ত রয়েছে সেহেতু ইরান নিজেদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা প্রতিবেশি দেশগুলোর সঙ্গে শেয়ার করতে কার্পণ্য করে নি। সেইসঙ্গে সরাসরি ইরান থেকে প্রতিবেশি দেশগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করারও ব্যবস্থা করেছে। বর্তমানে ইরান প্রতিবেশি দেশ ইরাক, তুরস্ক, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নাখচিভান প্রজাতন্ত্র, আর্মেনিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং আজারবাইজান প্রজাতন্ত্রে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ যেহেতু খুবই ব্যয় সাপেক্ষ প্রকল্প সেজন্য প্রতিবেশি দেশগুলোর অনেকেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন না করে ইরান থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করার চিন্তা করেছে। ইরানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বহুরকম কেন্দ্র রয়েছে মানে বিভিন্ন উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় ইরানে। যেমন সৌরবিদ্যুৎ অর্থাৎ সূর্যের আলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার সিস্টেম রয়েছে ইরানের।
বায়ুপ্রবাহ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন যাকে আমরা উইন্ড অ্যানার্জি বলে জানি সেই ব্যবস্থায়ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের পদ্ধতি রয়েছে ইরানে। পানি বিদ্যুৎ মানে হাইড্রো ইলেক্ট্রিসিটি তো রয়েছেই। এর বাইরেও রয়েছে জিও-থারমাল অ্যানার্জি এবং সম্মিলিত তাপ এবং শক্তি বা সিএইচপি বিদ্যুৎও। সিএইপি প্লান্টগুলো সাধারণত সমুদ্র উপকুলীয় অঞ্চলেই বেশিরভাগ স্থাপন করা হয়ে থাকে। কেবল বিদ্যুৎই নয় বরং ইরান এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদিও রপ্তানি করছে। অর্ধ শতাব্দিরও বেশি সময় ধরে ইরান বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার উৎপাদন করছে। ইরানে উৎপাদিত এইসব বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম যে কেবল দেশের অভ্যন্তরেই ব্যবহৃত হয় তা কিন্তু নয় বরং এগুলো এখন পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর বাইরে আফ্রিকা, এরং ইউরোপের ইতালির মতো দেশগুলোতেও রপ্তানি হচ্ছে। #
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/ মো:আবু সাঈদ/ ১০
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।