জানুয়ারি ৩১, ২০২১ ২০:৩০ Asia/Dhaka

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)’র চরিত্র ও চিন্তাধারা মানব জাতির ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়েছে।

তাই মুসলিম মনীষীরা ছাড়াও অনেক অমুসলিম মনীষীও মহানবীর (সা) মহত্ত্ব নিয়ে প্রশংসাসূচক ও গবেষণাধর্মী বই লিখেছেন। প্রখ্যাত জার্মান প্রাচ্যবিদ অ্যান ম্যারি শিমেলও এই মনীষীদের একজন। ‘মুহাম্মাদ(সা) মহান আল্লাহর প্রেরিতপুরুষ বা রাসুল’ শীর্ষক তাঁর বিখ্যাত বইয়ের ভূমিকায় এই নারী মনীষী লিখেছেন:

এ বইটি মুসলমানদের মহানবীর (সা) ব্যক্তিত্বের প্রতি আমার চল্লিশ বছরের অনুরাগের ফসল। আমার জীবনের দ্বিতীয় দশকে আমি প্রথমবার মহানবী মুহাম্মাদ (সা) সম্পর্কে পরিচিত হই। তাঁকে একজন আরেফ বা স্রস্টার জ্ঞান বিষয়ের বিশেষজ্ঞ-ব্যক্তিত্ব হিসেবে জানতে পারি। বিষয়টি আমার মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ সৃষ্টি করে। বাঙ্গালী ইতিহাসবিদ জাস্টিস সাইয়্যেদ আমির আলীর লেখা ‘মুহাম্মাদের জীবনী ও শিক্ষা’ শীর্ষক বইটি ও আরো একটি গবেষণামূলক বই ছিল আমার পছন্দের এবং অনুপ্রেরণার উৎস। যখন বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম তখনও মহানবী (সা) সম্পর্কে সোলায়মান চালাবির গান শুনে খুবই মুগ্ধ হতাম। গবেষণার পরবর্তী বছরগুলোতে জানতে পারলাম যে মহানবী হচ্ছেন সেই মহান ঐশী প্রেরিত পুরুষ যিনি নবী-রাসুলদের ধারার সর্বশেষ ব্যক্তি হিসেবে ওহি বা আসমানি প্রত্যাদেশ-ভিত্তিক সর্বশেষ ধর্ম এনেছেন। তাঁর ধর্ম সেইসব আসমানি ধর্মেরই পূর্ণতা দানকারী এবং অতীতের আসমানি ধর্মগুলোর সেই মৌলিকতা ও প্রাথমিক বিশুদ্ধতার সামগ্রিক নীতিমালারই সমন্বয় রয়েছে এ ধর্মে; আর সেইসব নীতিই তিনি আবারও নতুন করে বর্ণনা করেছেন। 

অধ্যাপক মিসেস অ্যান ম্যারি শিমেল যৌবনকাল থেকেই ইসলাম ও প্রাচ্য বিষয়ক জ্ঞান অর্জনে আগ্রহী ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি পাশ্চাত্যে ইসলামের বাস্তবতাগুলো স্পষ্ট করার পদক্ষেপ নেন। প্রায় ৫০ বছর ধরে গবেষণা করে তিনি যে ইসলামকে চিনেছেন এবং পশ্চিমা চিন্তাবিদ বা পাদ্রীরা ইসলাম সম্পর্কে যা তুলে ধরতেন তার মধ্যে রয়েছে স্পষ্ট পার্থক্য। তারা চেয়েছিল ঐশী প্রত্যাদেশকে বিকৃত করতে ও ইসলামের মহান নবীকে হিংস্র ও যুদ্ধবাজ ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরতে। শিমেল এই বাস্তবতাকে তিক্ত ও কষ্টদায়ক বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি ইসলাম সম্পর্কে গবেষণার পর লিখেছেন:  ইসলাম এমন এক ধর্ম যা পাশ্চাত্যে খুব খারাপভাবে অনুধাবন করা হয়েছে এবং তা করা হয়েছে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ অথবা অবাস্তবতায় বিশ্বাসী বা ইসলাম বিদ্বেষী লোকদের মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে অপবাদ আনা হয়েছে।

অ্যান ম্যারি শিমেল ইসলামী জ্ঞান, সংস্কৃতি ও ইসলামী ইরফান এবং মুসলিম বিশ্বের বিখ্যাত ব্যক্তিদের বিষয়ে ১০০’রও বেশী বই লিখেছেন জার্মান, ইংরেজি ও আরবি ভাষায়! ‘মুহাম্মাদ(সা) মহান আল্লাহর প্রেরিতপুরুষ বা রাসুল’ শীর্ষক তাঁর বিখ্যাত বইটি জার্মান ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশ  হয়েছে। শিমেলের লেখা থেকেই বোঝা যায় তিনি ইসলামের নবীকে অন্য সব নবীর চেয়ে বেশি মর্যাদাবান মনে করতেন। মহানবীর ব্যক্তিত্বের নানা দিক তুলে ধরতে গিয়ে তিনি অমুসলিম চিন্তাবিদদের পাশাপাশি মুসলিম আরেফদের বক্তব্যও তুলে ধরেছেন অত্যন্ত উদ্দীপনাময় ভাষায়। তার এ বই বিদ্বেষমুক্ত ও অনুরাগপূর্ণ।

শিমেল ‘মুহাম্মাদ(সা) মহান আল্লাহর প্রেরিতপুরুষ বা রাসুল’ শীর্ষক বিখ্যাত বইটি লিখেছেন পাশ্চাত্যের অমুসলমানদের উদ্দেশে। তিনি মহানবীর আধ্যাত্মিক ও মানবীয় রূপ তুলে ধরে এই মহান ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে পশ্চিমাদের সৃষ্ট ভুল ধারণাগুলো দূর করতে চেয়েছেন। শিমেল মহানবীকে (সা) রহমত ও ভালবাসার নবী হিসেবে তুলে ধরেছেন।

শিমেল মুসলিম দেশগুলোতে বহুবার সফর করেছেন। মহানবীর প্রতি মুসলমানদের গভীর ভালবাসা তিনি উপলব্ধি করেছেন। তার মতে মহানবীর সুন্দর আচরণ ও মন-মানসিকতা প্রত্যেক মুসলমানের কাছেই প্রশংসিত। মহানবী তাঁর এসব বৈশিষ্ট্য দিয়েই উম্মতের ভালবাসার স্নিগ্ধতা উপহার পাচ্ছেন। তিনি মুসলমানদের হৃদয় ও প্রাণের ওপর রাজত্ব করছেন।

শিমেল অস্ট্রেলিয় লেখক আর্থার জ্যাফরির উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন: প্রজ্ঞাহীন খ্রিস্টানরা মুসলমানদের মনে কষ্ট দিয়েছে। এ বিষয়টি মহানবীর ব্যক্তিত্ব ও সম্মান উপলব্ধিতে অমুসলমানদের ব্যর্থতারই প্রমাণ। শিমেল মনে করেন পাশ্চাত্য মহানবী সম্পর্কে অসঙ্গত বা অসত্য দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে। তিনি বলেছেন:  পাশ্চাত্য বছরের পর বছর বা যুগ যুগ ধরে মনে করতো যে ইসলাম শেষ হয়ে যাওয়ার পথে রয়েছে। কিন্তু আমাদের যুগে মুসলমানদের জাগরণ ও নিজ সম্পর্কে নতুন আত্ম-উপলব্ধি ছিল বিস্ময়কর। ফলে পাশ্চাত্য মুসলমানদের সংস্কৃতি আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য ইসলামের কোনো কোনো মৌলিক ও সামাজিক নীতির বিষয়ে নতুন করে গবেষণা শুরু করতে বাধ্য হয়েছে।  আমিও অমুসলিম পাঠকদের এটা দেখাতে চাই যে মুহাম্মাদ (সা) প্রত্যেক মানুষের জন্যই জীবনের সব ক্ষেত্রেই শ্রেষ্ঠ অনুকরণীয় আদর্শ। মহানবীর (সা) প্রতি মুসলমানদের ভালবাসা বেশ গভীর, শক্তিশালী ও উদ্দীপনায় ভরপুর। যুগে যুগে কত বিপুল সংখ্যক মানুষ মহানবীকে শ্রদ্ধা করে তাঁকে ওয়াসিলা বা মাধ্যম করতে চেয়েছেন। তাঁর রয়েছে সবচেয়ে সম্মানিত উপাধি। এই মহান নবী চিরকাল সেইসব মানুষের জন্য কল্যাণ ও মঙ্গলের আদর্শ হয়ে থাকবেন যারা নামাজে সাক্ষ্য দিচ্ছে যে তিনি ছিলেন সত্যিই আল্লাহর রাসুল। 

শিমেল ‘মুহাম্মাদ(সা) মহান আল্লাহর প্রেরিতপুরুষ বা রাসুল’ শীর্ষক বিখ্যাত বইটির প্রথম অধ্যায়ে লিখেছেন মহানবীর যোগ্যতা প্রসঙ্গে লিখেছেন: হযরত মুহাম্মাদ (সা) চিন্তার সাগরে ডুবে থাকতেন। তিনি সমাজে প্রচলিত প্রথা ও রীতির চেয়েও বড় ও বেশি উপযুক্ত কিছুর সন্ধান করতেন। তিনি কখনও কখনও মক্কার সন্নিকটে হেরা গুহায় যেতেন। সেখানেই তিনি প্রথম আসমানি অদৃশ্য জ্ঞানের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন ও ঐশী প্রত্যাদেশ পান। মহানবী (সা) বলতেন এবং কুরআনের বাণীতেও বার বার স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে তিনি ছিলেন মানুষ। কেবল তাঁর বিশেষ যোগ্যতা হল এটা যে আল্লাহর বাণী তথা ওহী গ্রহণ করার মত যোগ্যতা তাঁর রয়েছে। তিনি নিজেও এটা বুঝতেন যে তাঁর কাছে যা যা আসছে তা আল্লাহর বর্ণনাতীত অনুগ্রহ ছাড়া অন্য কিছু নয়। মানুষের কাছে আল্লাহর অনুগ্রহ পৌঁছে দেয়ার জন্যই তাঁকে মাধ্যম হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। শাহাদাতাইন তথা দুই সাক্ষ্য অর্থাৎ  আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ বা উপাস্য নেই এবং আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল – এ দুই বাক্য ধার্মিক সমাজের জন্য ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের সব ক্ষেত্রে মুহাম্মাদের জীবনাদর্শ অনুসরণের বৈধতার ও কার্যকারিতারই স্বীকৃতি। অন্য কথায় মহানবীর আচার-আচরণ মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য ও শ্রেষ্ঠ আদর্শ।#

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ১১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ