কুরআনের আলো
সূরা গাফির: আয়াত ৭-৯ (পর্ব-২)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা গাফিরের ৭ নম্বর থেকে ৯ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
الَّذِينَ يَحْمِلُونَ الْعَرْشَ وَمَنْ حَوْلَهُ يُسَبِّحُونَ بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَيُؤْمِنُونَ بِهِ وَيَسْتَغْفِرُونَ لِلَّذِينَ آَمَنُوا رَبَّنَا وَسِعْتَ كُلَّ شَيْءٍ رَحْمَةً وَعِلْمًا فَاغْفِرْ لِلَّذِينَ تَابُوا وَاتَّبَعُوا سَبِيلَكَ وَقِهِمْ عَذَابَ الْجَحِيمِ (7)
“যারা আরশ ধারণ করে আছে এবং যারা এর চারপাশ ঘিরে আছে তারা তাদের প্রতিপালকের পবিত্রতা ও মহিমা প্রশংসার সাথে ঘোষণা করে এবং তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং মুমিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে (এবং বলে,) ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তোমার দয়া ও জ্ঞান সর্বব্যাপী (ছড়িয়ে আছে); অতএব যারা তওবা করে ও তোমার পথ অবলম্বন করে, তুমি তাদেরকে ক্ষমা কর এবং জাহান্নামের শাস্তি হতে রক্ষা কর।” (৪০:৭)
পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত অনুযায়ী, ফেরেশতারা আল্লাহর আদেশে এই বিশ্বজগত পরিচালনার বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত রয়েছে এবং তারা অনেক কাজে মানুষের সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্ক স্থাপন করে। এই আয়াতে মানুষের সঙ্গে ফেরেশতাদের সম্পর্কের একটি দিকের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে, আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত যেসব ফেরেশতা মহান আল্লাহর আরশে অবস্থান করেন তারা নিজেরা আল্লাহর ইবাদত বন্দেগি ও তাঁর প্রশংসায় মশগুল থাকার পাশাপাশি ঈমানদার বান্দাদের জন্য দোয়া করেন এবং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান। তারা আল্লাহর কাছে এই বলে কাকুতি-মিনতি করেন যে, হে আল্লাহ! মানুষের গোনাহ সম্পর্কে যেমন তোমার সম্যক ধারনা আছে তেমনি তোমার দয়া ও রহমতেরও কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। কাজেই যারা তওবা করে তাদের অপরাধ তুমি ক্ষমা করে দাও এবং তাদেরকে জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষা করো।
প্রকৃতপক্ষে এই আয়াতে মুমিন বান্দাদেরকে এই সুসংবাদ দেয়া হচ্ছে যে, আল্লাহর আরশ বহনকারী ফেরেশতারা হচ্ছেন সর্বাপেক্ষা অদৃশ্য শক্তির অধিকারী। তারা সারাক্ষণ তোমাদের জন্য দোয়া করছেন। তারা পার্থিব জীবনে তোমাদের সাফল্য কামনা করার পাশাপাশি পরকালীন জীবনেও তোমাদের পরিত্রাণের জন্য দোয়া করছেন। কাজেই মুমিনদের জন্য এর চেয়ে বড় সুসংবাদ আর হতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা যেসব নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাকে তাঁর আরশে আজিমকে বহন করার সুযোগ দিয়েছেন এবং আরো যেসব ফেরেশতা আরশে আজিমে তাঁর সঙ্গে অবস্থান করছেন তাদের সবাই মুমিনদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে দোয়া করে যাচ্ছেন। এমন সুসংবাদ শোনার পর পার্থিব জীবনে একজন মুমিন যত দুঃখ-কষ্টেরই সম্মুখীন হোক না কেন তার মন আনন্দে ভরে ওঠে এবং তার ঈমান আরো শক্তিশালী হয়।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- আল্লাহ তায়ালা তাঁর মুমিন বান্দাদেরকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য নানা ধরনের ব্যবস্থা রেখেছেন। ফেরেশতাদের মাধ্যমে দোয়া তার অন্যতম।
২- অন্যের জন্য দোয়া একটি উত্তম গুণ। ফেরেশতাদের এই গুণ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরাও অপরের কল্যাণ কামনা করে দোয়া করব।
৩- ফেরেশতাদের দোয়া ও আল্লাহর ক্ষমা লাভের পূর্বশর্ত হচ্ছে ঈমান ও নেক আমল। যে মানুষ এই দু’টি গুণ অর্জন করতে পারবে দুনিয়া ও আখেরাতে সে সব ধরনের বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাবে।
সূরা গাফিরের ৮ ও ৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
رَبَّنَا وَأَدْخِلْهُمْ جَنَّاتِ عَدْنٍ الَّتِي وَعَدْتَهُمْ وَمَنْ صَلَحَ مِنْ آَبَائِهِمْ وَأَزْوَاجِهِمْ وَذُرِّيَّاتِهِمْ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ (8) وَقِهِمُ السَّيِّئَاتِ وَمَنْ تَقِ السَّيِّئَاتِ يَوْمَئِذٍ فَقَدْ رَحِمْتَهُ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ (9)
“হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি তাদেরকে (এবং তাদের) পিতা-মাতা, পতি-পত্নী ও সন্তান সন্ততিদের মধ্যে (যারা) সৎকাজ করেছে তাদেরকে স্থায়ী জান্নাতে প্রবেশ দান কর; যার প্রতিশ্রুতি তুমি তাদেরকে দিয়েছ। নিশ্চয়ই তুমি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (৪০:৮)
“এবং তুমি তাদেরকে অকল্যাণ হতে রক্ষা কর। সেদিন তুমি যাকে অকল্যাণ হতে রক্ষা করবে তাকে তো দয়াই করবে। আর এটিই তো মহাসাফল্য।” (৪০:৯)
আগের আয়াতে মুমিন বান্দাদের জন্য ফেরেশতাদের ক্ষমা প্রার্থনা করার কথা জানানোর পর এই আয়াতে বলা হচ্ছে: ফেরেশতারা মুমিনদের জন্য শুধু গোনাহ মাফ এবং জাহান্নামের আজাব থেকে মুক্তি কামনা করেই ক্ষান্ত হন না সেইসঙ্গে তারা যাতে পরিবার-পরিজন নিয়ে চিরকালীন আবাস জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে সেই দোয়াও আল্লাহর দরবারে করেন। অবশ্য এখানে পরিবারের সেইসব সদস্যের কথা বলা হচ্ছে যারা জান্নাতে যাওয়ার উপযুক্ত। কিয়ামতের দিন পিতা, মাতা, ভাই, বোন, আত্মীয়-স্বজন ইত্যাদি কোনো সম্পর্কই মানুষকে মুক্তি দিতে পারবে না।
জান্নাত লাভের একমাত্র শর্ত ঈমান ও নেক আমল। পারিবারিক বন্ধন সেখানে কোনো কাজে আসবে না। তবে ঈমান ও নেক আমল থাকার শর্তে জান্নাতবাসী আল্লাহর কাছে এই কামনা করতে পারবে যে, জান্নাতে আমাকে আমার পিতা-মাতা, স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে থাকতে দাও। জান্নাতবাসীর এ ধরনের কামনা আল্লাহ তায়ালা তাঁর দয়া ও রহমতের গুণে কবুল করতে পারেন বলে আশা করা যায়। আল্লাহর প্রতিশ্রুতির সঙ্গে এ বিষয়টির সামঞ্জস্য রয়েছে।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের অন্যত্র অর্থাৎ সূরা তুরের ২১ নম্বর আয়াতে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আয়াতের প্রথমাংশে বলা হয়েছে: “যারা ঈমানদার এবং যাদের সন্তানরা ঈমানে তাদের অনুগামী, আমি তাদেরকে তাদের পিতৃপুরুষদের সাথে মিলিত করে দেব এবং তাদের আমল বিন্দুমাত্রও হ্রাস করব না। ...” আল্লাহ তায়ালার এই প্রতিশ্রুতি থেকে বোঝা যায়, পারিবারিক বন্ধনের মূল্য তাঁর কাছে অনেক বেশি। পরের আয়াতে মুমিন ব্যক্তিদের জন্য ফেরেশতাদের দোয়া অব্যাহত থাকার কথা বলা হচ্ছে। তারা দুনিয়া ও আখেরাতে মুমিন ব্যক্তিদের জন্য সব ধরনের অকল্যাণ ও অনিষ্ট থেকে রক্ষা করার দোয়া করেন।
এখান থেকে বোঝা যায়, প্রকৃত মুমিন ব্যক্তিরা জান্নাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত যেন সব ধরনের বিপদ-আপদ থেকে মুক্ত থাকে এবং প্রশান্ত চিত্তে ও সম্মানের সঙ্গে যেন জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে- ফেরেশতারা আল্লাহর দরবারে সেই দোয়া করতে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই কেউ যদি ফেরেশতাদের এই দোয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে পারে এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভ করে জান্নাতে প্রবেশের অধিকার পায় তাহলে সে সর্বোচ্চ সৌভাগ্য ও সুখলাভ করবে। মানুষের জন্য এর চেয়ে উচ্চতর মর্যাদা ও সৌভাগ্য আর কিছু হতে পারে না।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- অপরের জন্য দোয়া করা ফেরেশতা ও নবী-রাসূলদের অনুসৃত রীতি। যারা পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে বা অন্যায় পথ অবলম্বন করছে তাদেরকে অভিসম্পাত না করে তারা যাতে সঠিক পথে ফিরে এসে আল্লাহর ক্ষমা লাভ করতে পারে সেজন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করা উচিত।
২- মানুষ যতক্ষণ গোনাহমুক্ত হতে না পারবে ততক্ষণ তাকে জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হবে না। গোনাহমুক্ত হওয়ার জন্য তওবা করার পাশাপাশি এই মুহূর্ত থেকে সব ধরনের পাপ কাজ থেকে বিরত থাকার সংকল্প করতে হবে।#
পার্সটুডে/এমএমআই/এআর/১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।