কুরআনের আলো
সূরা গাফির: আয়াত ১০-১২ (পর্ব-৩)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা গাফির বা মু'মিনের ১০ নম্বর থেকে ১২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ১০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا يُنَادَوْنَ لَمَقْتُ اللَّهِ أَكْبَرُ مِنْ مَقْتِكُمْ أَنْفُسَكُمْ إِذْ تُدْعَوْنَ إِلَى الْإِيمَانِ فَتَكْفُرُونَ (10)
“কাফেরদেরকে উচ্চকণ্ঠে বলা হবে: তোমাদের নিজেদের প্রতি তোমাদের ক্ষোভ অপেক্ষা (তোমাদের প্রতি) আল্লাহর ক্ষোভ অধিক; কারণ, (দুনিয়ায়) যখন তোমাদেরকে বিশ্বাস স্থাপন করতে বলা হয়েছিল তখন তোমরা তা অস্বীকার করেছিলে।” (৪০:১০)
গত আসরে সৎকর্মশীল মুমিন বান্দাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালার অসীম ক্ষমা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আর আজকের এই আয়াতে সেইসব মানুষের প্রতি আল্লাহর সীমাহীন ক্ষোভ ও ক্রোধের কথা বলা হচ্ছে যারা সত্য উপলব্ধি করা সত্ত্বেও দাম্ভিকতা ও গোয়ার্তুমির কারণে ঈমান গ্রহণ করেনি।
কাফিররা কিয়ামতের দিন তাদের কৃতকর্মের ফলাফল প্রত্যক্ষ করার পর নিজেদের প্রতি ক্ষোভ ও অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকবে। পার্থিব জীবনে ভ্রান্ত পথ অবলম্বন করায় তারা নিজেদেরকে ভর্ৎসনা করার পাশাপাশি যেসব নেতা ও বন্ধু তাদেরকে বিপথগামী করেছিল তাদেরকে কটুকথা বলবে ও অভিশাপ দেবে। কিয়ামতের দিন বেঈমান ব্যক্তিরা নিজেদের প্রতি ঘৃণায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়বে।
এ সময় জাহান্নামের প্রহরীরা তাদেরকে বলবে, তোমাদের মতো গোঁয়ার ও আত্মম্ভরী কাফেরদের প্রতি আল্লাহ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তোমরা আজ যে অনুশোচনা করছ এবং একে অপরের প্রতি ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করছ তার চেয়ে আল্লাহ তায়ালা অনেক বেশি ক্ষিপ্ত হয়েছেন। কারণ, নবী-রাসূল প্রেরণ করে তোমাদেরকে সিরাতুল মুস্তাকিমে আসার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল এবং তোমরা সে আহ্বানকে সত্য বলে উপলব্ধিও করেছিলে। কিন্তু গোড়ামি ও অহংকারের কারণে আল্লাহর প্রেরিত পুরুষদের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছ। যারা তোমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে তোমাদেরকে সুখের সন্ধান দিতে চেয়েছিল তাদেরকে অপমান-অপদস্থ করে তাড়িয়ে দিয়েছ।
এই আয়াতের দু’টি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:
১- সত্যের বিরোধিতা, কুফরি ও নবী-রাসূলদের বিরুদ্ধাচরণ করলে মহান আল্লাহ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন।
২- আল্লাহ কোনো বান্দাকে সতর্ক না করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করেন না। তিনি নবী-রাসূলদের মাধ্যমে সত্যের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার পরই কেবল তা অস্বীকারকারীদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছেন।
সূরা গাফির বা মুমিনের ১১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
قَالُوا رَبَّنَا أَمَتَّنَا اثْنَتَيْنِ وَأَحْيَيْتَنَا اثْنَتَيْنِ فَاعْتَرَفْنَا بِذُنُوبِنَا فَهَلْ إِلَى خُرُوجٍ مِنْ سَبِيلٍ (11)
“কাফিররা বলবে, হে আমাদের রব! আপনি আমাদেরকে দু’বার মৃত্যু দিয়েছেন এবং দু’বার জীবিত করেছেন। এখন আমরা আমাদের অপরাধ স্বীকার করছি। অতএব (জাহান্নাম থেকে) বের হবার কোন পথ আছে কি?” (৪০:১১)
পার্থিব জীবনে কাফিররা সব সময় যে বিষয়টি অস্বীকার করে তা হচ্ছে, মৃত্যু পরবর্তী জীবন এবং কিয়ামতের পুনরুত্থান দিবস। তারা বলতে চায়, মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সবকিছু শেষ হয়ে যাবে এবং তার আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। কিন্তু কিয়ামতের দিন তাদের পক্ষে আর এই বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় থাকবে না। সেদিন তারা স্বীকার করবে, নবী-রাসূলদের আহ্বানকে তারা অকারণে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলবে, আমাদের রব আমাদেরকে একবার নয় বরং দুই দুই বার মৃত্যু ও জীবন দান করেছেন। একবার পৃথিবীর জীবন শেষে মৃত্যুর পর বারযাখের জীবন দান করেছেন এবং দ্বিতীয়বার কিয়ামতের আগ মুহূর্তে বারযাখি জীবন শেষে আবার মৃত্যু দিয়ে কিয়ামতের দিন পুনরায় জীবিত করেছেন। মৃত্যুর পর কিয়ামতের আগ পর্যন্ত কবরের জীবনকে বারযাখি জীবন বলা হয়।
কাজেই আয়াতের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, দু’বার মৃত্যু অর্থে একবার পার্থিব জীবন এবং আরেকবার বারযাখি জীবনের মৃত্যুর কথা বোঝানো হয়েছে। আর দু’বার জীবনদান বলতে একবার বারযাখে এবং দ্বিতীয়বার কিয়ামত দিবসে জীবিত করাকে বোঝানো হয়েছে।
কিয়ামতের দিন এই বিষয়গুলোকে স্বীকার করে কাফিররা আল্লাহ তায়ালাকে একথা বলার চেষ্টা করবে যে, দু’বার যখন জীবনদান হয়ে গেছে তখন তার সঙ্গে আরেকবার মৃত্যু ও জীবনদানের মাধ্যমে তাদেরকে যেন পার্থিব জীবনে ফেরত যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। যদি সে সুযোগ দেয়া হয় তাহলে তারা ঈমান আনার পাশাপাশি অনেক নেক আমল করে আসবে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, কিয়ামতের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করার পর সত্য স্বীকার করলে কোনো লাভ হবে না এবং জাহান্নামের আগুন থেকেও মুক্তি পাওয়া যাবে না। এ ছাড়া, এসব কাফিরকে আরেকবার পৃথিবীতে পাঠালেও তারা আবার তাই করবে যা আগের জীবনে করেছিল।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:
১- কিয়ামতের দিন অপরাধী ব্যক্তিরা পৃথিবীতে ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা করবে। আমরা যারা এই কথা উপলব্ধি করেছি, তাদের উচিত হবে এখনই তওবা করে জীবনের যতগুলো দিন বাকি আছে ততদিন বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগি ও নেক আমল করা যাতে কিয়ামতের দিন অনুতপ্ত হতে না হয়।
২- যারা মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে অস্বীকার করে তাদেরকে মৃত্যুর পরে আরো দুইবার জীবিত হওয়ার স্বাদ উপভোগ করতে হবে।
এই সূরার ১২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
ذَلِكُمْ بِأَنَّهُ إِذَا دُعِيَ اللَّهُ وَحْدَهُ كَفَرْتُمْ وَإِنْ يُشْرَكْ بِهِ تُؤْمِنُوا فَالْحُكْمُ لِلَّهِ الْعَلِيِّ الْكَبِيرِ (12)
“এই (শাস্তি) এজন্যে যে, যখন আল্লাহকে অদ্বিতীয় হিসেবে ডাকা হত তখন তোমরা কুফরি করতে, আর যখন তাঁর সাথে শরীক নির্ধারণ করা হত তখন তোমরা তাতে বিশ্বাস করতে। সুতরাং (আজ) যাবতীয় নির্দেশ সমুচ্চ, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকেই।” (৪০:১২)
এই আয়াতে কুফরের মূল কারণ হিসেবে শিরকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ, কিছু মানুষ বিশ্বজগত সৃষ্টি ও প্রতিপালনের বিষয়ে অদ্বিতীয় আল্লাহকে মেনে নিতে চায় না। তারা দাবি করে, আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করে পৃথিবীর বুকে ছেড়ে দিয়েছেন। কাজেই এখন বিশ্ব পরিচালনার জন্য আমাদেরকে অন্য কারো কাছে আশ্রয় নিতে হবে।
পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বলা হচ্ছে: তারা খালেক বা সৃষ্টিকর্তা হিসেবে আল্লাহকে অস্বীকার করে না বরং রব বা পালনকর্তা হিসেবে তাঁর অস্তিত্ব অস্বীকার করে। কখনো তারা নিজেদেরকেই আল্লাহর স্থানে বসিয়ে দেয় এবং বিশ্ব পরিচালনার জন্য নিজেরাই আইন তৈরি করে। কখনো বা মূর্খতার কারণে তারা কোনো ব্যক্তি বা আল্লাহর সৃষ্ট কোনো বস্তুকে প্রতিপালক হিসেবে নির্ধারণ করে তার উপাসনা শুরু করে দেয়।
এই আয়াতের দু’টি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:
১- আল্লাহর একত্ববাদে একনিষ্ঠ বিশ্বাস ও ইবাদত এবং সব রকম শিরক থেকে দূরে থাকা কিয়ামত দিবসের ভয়াবহতা থেকে মুক্তিলাভের একমাত্র উপায়।
২- সৃষ্টিকর্তা হিসেবে আল্লাহকে স্বীকার করাই যথেষ্ট নয়। বিশ্বজগত পরিচালনায়ও আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করা যাবে না। আল্লাহকে সম্পূর্ণ বা আংশিক অস্বীকারই মানুষের জাহান্নামের যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। #
পার্সটুডে/এমএমআই/এআর/৯
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।