কুরআনের আলো
সূরা গাফির: আয়াত ১৩-১৫ (পর্ব-৪)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা গাফির বা মু'মিনের ১৩ নম্বর থেকে ১৫ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ১৩ ও ১৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
هُوَ الَّذِي يُرِيكُمْ آَيَاتِهِ وَيُنَزِّلُ لَكُمْ مِنَ السَّمَاءِ رِزْقًا وَمَا يَتَذَكَّرُ إِلَّا مَنْ يُنِيبُ (13) فَادْعُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ (14)
“তিনিই তোমাদেরকে তাঁর নিদর্শনাবলী দেখান এবং আকাশ থেকে তোমাদের জন্য রিযিক পাঠান। তবে কেবলমাত্র তারাই উপদেশ গ্রহণ করে যারা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী।” (৪০:১৩)
“সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ডাক, তাঁর উদ্দেশ্যে দীনকে একনিষ্ঠভাবে নিবেদিত করার মাধ্যমে। যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে।” (৪০:১৪)
গত আসরে আমরা পরকালে কাফির ও মুশরিকদের পরিণতি নিয়ে কথা বলেছিলাম। এরপর আজকের এই দুই আয়াতে তৌহিদ বা একত্ববাদের স্বরূপ তুলে ধরে বলা হচ্ছে: তোমাদের চারপাশে আল্লাহর সৃষ্ট যেসব জিনিস রয়েছে তা থেকেই তাঁর একত্ববাদের পরিচয় পাওয়া যায়। তোমরা চোখ খুললেই যা কিছু দেখতে পাও তার সবকিছুতেই আল্লাহর একত্ববাদের নির্দশন রয়েছে। আসমান, জমিন, পাহাড়, সমতলভূমি, সাগর, মহাসাগর, সাগরের মধ্যে অসংখ্য প্রাণী ও উদ্ভিদ, ভূপৃষ্ঠের পশু ও আকাশে উড়ন্ত পাখি- এসব কিছুই তোমাদের চোখের সামনে রয়েছে এবং এর কোনো কিছুই গোপন নয়।
এরপর বলা হচ্ছে, তিনি তোমাদেরকে আসমান থেকে রিজিক দান করেন। মহান আল্লাহ মানুষ, পশু-পাখি ও উদ্ভিদের জন্য আসমান থেকে বৃষ্টির পানি বর্ষণ করেন এবং আসমানে অবস্থিত সূর্যের কিরণ দিয়ে ভূপৃষ্ঠের জীবন বাঁচিয়ে রাখেন। সূর্যের আলো ও বৃষ্টির পানি না থাকলে পৃথিবী থেকে প্রাণের অস্তিত্ব হারিয়ে যেত।
আমাদের চারপাশে আল্লাহ তায়ালার এতসব নিদর্শন থাকা সত্ত্বেও যাদের অন্তদৃষ্টি নষ্ট হয়ে গেছে তারা এর কিছুই দেখতে পায় না। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালার এসব নিদর্শন দেখে অনেকে তার স্বীকৃতি দেয় এবং আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনের আকুতি প্রকাশ করে। তারা আল্লাহর নির্দেশিত সরল পথে জীবন পরিচালিত করে এবং সর্বান্তকরণে তাঁর নিষেধ মেনে চলার চেষ্টা করে। একজন আরেফ বলেছেন, যে ব্যক্তি সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে আছে তাকে ডাক দিলেই সে জেগে ওঠে। কিন্তু যে ব্যক্তি জেগে থাকা অবস্থায় ঘুমের ভান করে আছে তার ঘুম ভাঙানো যায় না।
পরের আয়াতে বলা হচ্ছে: যখন তোমরা একথা উপলব্ধি করেছ যে, বিশ্বজগত সৃষ্টিতে আল্লাহর কোনো শরিক নেই তখন ইবাদতেও তার সঙ্গে কাউকে শরিক করো না। একনিষ্ঠ চিত্তে শুধুমাত্র তারই ইবাদত করো। নিঃসন্দেহে তোমরা যখন একাগ্রচিত্তে ও কায়মনোবাক্যে এক আল্লাহর ইবাদত করো তখন উগ্র কাফেররা প্রচণ্ডরকম ক্ষুব্ধ হয়। কিন্তু তাদের ক্ষোভ দেখে তোমরা ভয় পেয়ো না বরং একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করে যাও। খোদাদ্রোহী জালেম ব্যক্তিরা ক্ষুব্ধ হলো কি হলো না তা দেখার প্রয়োজন তোমাদের নেই।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- আমাদের চারপাশে আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদের অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে। আমরা যদি অন্তর্চক্ষু দিয়ে এসব নিদর্শনের দিকে তাকাই তাহলে এসব সৃষ্টির স্রষ্টাকে খুঁজে পাব।
২- ভূপৃষ্ঠে অবস্থিত প্রতিটি জীব যেমন আল্লাহর নিদর্শন তেমনি এসব জীবের রিজিকের ব্যবস্থাপনাও আল্লাহ তায়ালার আরেকটি পরিচয়চিহ্ন।
৩- সব ধরনের বেদআত, খোরাফাত ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে ধর্মবিরোধী ভ্রান্ত আচার-অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করার মাধ্যমেই কেবল অদ্বিতীয় আল্লাহর সন্ধান ও তাঁর করুনা লাভ করা সম্ভব।
৪- ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক দিয়ে আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে খুশি করার চেষ্টা না করি। সত্য মেনে নিয়ে আমরা যেন তা আমল করি; যদিও তা কাফেরদের পছন্দ নয়।
সূরা গাফিরের ১৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
رَفِيعُ الدَّرَجَاتِ ذُو الْعَرْشِ يُلْقِي الرُّوحَ مِنْ أَمْرِهِ عَلَى مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ لِيُنْذِرَ يَوْمَ التَّلَاقِ (15)
“তিনি তাঁর (সৎকর্মশীল বান্দাদের) মর্যাদা বাড়িয়ে দেন (এবং) তিনি আরশের অধিপতি। তিনি রুহ (অর্থাৎ ওহির ফেরেশতাকে) স্বীয় আদেশ হতে তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা প্রেরণ করেন যাতে তিনি (মানুষকে) সাক্ষাৎ (বা কিয়ামত) দিবস সম্পর্কে সতর্ক করেন।” (৪০:১৫)
এই আয়াতে মহান আল্লাহর কিছু গুণ ও কাজের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। আগের আয়াতে একনিষ্ঠ ইবাদত করার যে কথা বলা হয়েছিল তার ধারাবাহিকতায় এখানে বলা হচ্ছে: মুমিনদের মধ্যে আল্লাহর আনুগত্যে যে যত বেশি একনিষ্ঠ আল্লাহ তায়ালার কাছে তার মর্যাদা তত বেশি। এমনকি নবী-রাসূলগণের মধ্যেও যাঁরা ঐশী পরীক্ষায় যত বেশি উত্তীর্ণ হয়েছেন এবং একনিষ্ঠতায় যে যত বেশি উচ্চতায় উঠতে পেরেছেন তিনি মহান আল্লাহর কাছে তত বেশি মর্যাদা প্রাপ্ত হয়েছেন। কাজেই মনে রাখতে হবে, আল্লাহ তায়ালা একাগ্রচিত্ত ও একনিষ্ঠতার মাপকাঠিতে মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।
আয়াতের পরের অংশে বলা হচ্ছে, তিনি আরশের অধিপতি এবং তাঁর শাসনক্ষমতা গোটা বিশ্বজগতের সর্বত্র ছেয়ে আছে। তাঁকে মোকাবিলা করার কথা কল্পনা করার সাধ্যও কারো নেই। এরপর বলা হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করে তাকে যেমন খুশি তেমন চলার অনুমতি দেননি। তিনি অন্য সব সৃষ্টির মতো মানুষের জন্য বস্তুগত রিজিক নির্ধারণ করার পাশাপাশি তার জন্য তিনি আত্মিক রিজিকেরও বন্দোবস্ত করেছেন। এই আত্মিক রিজিক মানুষের কাছে পৌঁছায় ওহীর ফেরেশতা তথা জিব্রাইল আমিন এবং নবী-রাসূলদের মাধ্যমে। তাঁদের মাধ্যমে মহান আল্লাহ মানুষকে একথা স্মরণ করিয়ে দেন যে, মৃত্যুর মাধ্যমে জীবনের সমাপ্তি হবে না বরং মৃত্যু/পরকালীন জীবনের সূচনা মাত্র যে জীবনের কোনো শেষ নেই।
এই আয়াতে পরকালীন জীবনের কিয়ামত দিবসকে সাক্ষাৎ দিবস বলে অভিহিত করা হয়েছে। কিয়ামত প্রকৃতপক্ষে সাক্ষাতেরই দিন। সেদিন মানুষ তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। সেদিন সত্য পথের দিশারীদের সঙ্গে তাদের অনুসারীদের এবং ভ্রান্ত পথের অনুসারীদের সঙ্গে তাদের নেতাদের সাক্ষাৎ হবে। সেদিন মানুষের সঙ্গে তাদের আমলনামার সাক্ষাৎ হবে। সেদিন জালিম বা অত্যাচারীর সঙ্গে মজলুম বা নির্যাতিতদের দেখা হয়ে যাবে। কিন্তু অত্যাচারীরা কখনো ভাবেনি যে তাদেরকে এমন একটা দিনে তার হাতে নির্যাতিতদের মুখোমুখি হতে হবে।
এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- ইসলাম হচ্ছে একনিষ্ঠ চিত্তে আল্লাহর ইবাদত করার ধর্ম। এখানে যে যত বেশি চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালাবে তার মর্যাদা তত বেড়ে যাবে।
২- নবী-রাসূলগণ আল্লাহ তায়ালার বাছাই করা বান্দা এবং তিনি তাঁর মহাজ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়ে এসব ঐশী ব্যক্তিগণকে বাছাই করেন।
৩- নবী রাসূলগণ মানুষের পরম হিতাকাঙ্ক্ষী হিসেবে তাকে চলার পথের বিপদাপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দেন। এই সতর্কবাণীতে যে কান দেবে সে সৌভাগ্যবান এবং যে তা প্রত্যাখ্যান করবে তার জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে রয়েছে অপমান ও ধ্বংস। #
পার্সটুডে/এমএমআই/এআর/১৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।