মার্চ ২০, ২০২১ ২২:৩০ Asia/Dhaka

বন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। নওরোজ উপলক্ষে আপনাদের সবাইকে বাসন্তি অভিনন্দন জানাচ্ছি।

ফার্সি ক্যালেন্ডারে বছরের প্রথম মাস ফারভারদিনের প্রথম দিন থেকে শুরু হয় নওরোজ। ইরানের সবচেয়ে বড় সরকারি ছুটির সময় এই নওরোজ। এভাবে বললেও ভুল হবে না যে বছরের প্রথম দিন থেকে নববর্ষ উপলক্ষে যে-কয়দিন ছুটি থাকে, সে কয়দিনই নওরোজ।

আবার বসন্তের সূচনাই ইরানের নওরোজ। ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক ফারভারদিনের প্রথম দিন বসন্ত এবং নওরোজ। তবে হ্যাঁ, ইরানের বসন্তের সঙ্গে প্রকৃতির দারুন সখ্যতা রয়েছে। বসন্তের সূচনায় গাছে গাছে ফুল ফোটে নি এমনটা হতে খুব কমই দেখা গেছে। এই নওরোজ বা নববর্ষ বরণের সংস্কৃতি যে কতোটা প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী ইরানে, তা নওরোজ সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত না হলে বোঝা যাবে না। বলা বাহুল্য ইরানে সবচেয়ে বড় উৎসব হলো নওরোজ উৎসব। যাই হোক এই নওরোজের বেশ কয়েকটি অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বৈশিষ্ট্যগুলোর সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো। তার আগে চলুন ইরানের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি বসন্তগীতি শোনা যাক।

বসন্ত সংগীতের অংশবিশেষ শুনলেন। বাকি অংশও আমরা সুযোগমতো শোনাবার চেষ্টা করবো। সেই নওরোজ এখন সমাগত দ্বারে। বসন্ত বরণ এবং নওরোজ উৎসব একত্রেই পালিত হয় ইরানে। বসন্তের সূচনায় প্রকৃতিতে যে পরিবর্তন ঘটে সেই পরিবর্তন মানুষ নিজেদের মনেও ঘটাতে চায়। তারই সাঙ্গীতিক প্রতিফলন ঘটেছে গানটিতে। বসন্ত আর নওরোজ উভয়কে সমান মর্যাদা দিয়ে বরণ করে নেওয়ার কিছু ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি রয়েছে ইরানে। পুরোনো বছরের শেষ দিকে ক্লান্তির নি:শ্বাস ফেলে যেন বিদায়ের প্রস্তুতি নেয় পুরোনো বছরের শেষ দিনগুলো। নতুনের ডামাডোলে সেই ক্লান্তি, শ্রান্তি, জড়তা কেটে যেতে থাকে।

জনগণ প্রকৃতির শ্যামলিমা নিজেদের ঘরে, আশেপাশে, অফিস-আদালত কিংবা কর্মস্থলেও গড়ে তোলার চেষ্টা করে। নওরোজকে ঘিরে তাই  ঘটা করে চলে সবুজের আবাহন। এই সবুজ মনোদৈহিক জাগৃতি আর নবীনতার প্রতীক। সতেজ, সজীব হয়ে ওঠার একান্ত মনোবাসনা ধরা দেয় এই সবুজের আয়োজনে। গম কিংবা মাশকলাই অথবা ডাল ভিজিয়ে সবুজ চারা বানানো হয় ঘরে ঘরে। বিচিত্র উদ্ভিদে প্রাকৃতিক সুন্দর পরিবেশ তৈরি করা হয় বাড়িঘরে। বিশ্বের যে প্রান্তেই ইরানিরা বসবাস করুক না কেন নওরোজের এই সংস্কৃতি সবার ঘরে ঘরে পালন করা হয়। বসবাসের স্থানেই তারা ইরানের এই চমৎকার সংস্কৃতি চর্চা করে। এভাবে সবুজের আবহ তৈরি করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ইরানিরা স্বাগত জানায় ঐতিহ্যবাহী 'নওরোজ'কে।

অবাক করা ব্যাপার হলো পাখিদের কলকাকলীও এ সময় বসন্তের পূর্বাভাস নিয়ে আসে। না, আমাদের কোকিল নয় ঠিক, বনের সচরাচর পাখিরাই কূজনে মেতে উঠে বলে দেয় 'আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে'।

পাখিদের ওই নৃত্য গান আর কল-কোলাহল দেখে

বলছে সবাই খুলে মন-দোর : বসন্ত এসে গেছে

ওঠো! আলিঙ্গনে করে নাও তারে বরণ

বাসন্তি প্রবাহে সে যে প্রকৃতির পরাণ

এ লগ্নের তিক্ততায় বোজো জাগ্রত আঁখি

বসন্ত এসেছে মিষ্টি স্বপ্নের ঘোর মাখি।

নাসির মাহমুদের কণ্ঠে তাঁর স্বরচিত বসন্তকাব্যের আবৃত্তি শুনলেন। এই আবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চয়ই মনে পড়ে যাবে বিখ্যাত সেই গানটি: আহা, আজি এ বসন্তে। চলুন শিল্পী সাদি মোহাম্মদের কণ্ঠে কথামুখটি অন্তত শুনে নেওয়া যাক।

গানটির অংশবিশেষ শুনলেন। বসন্ত আর নওরোজকে ঘিরে সাজসজ্জার আয়োজন চলে মাসখানেক ধরে।

ঠিকই বলেছেন মিলি আপা! এ যেন দস্তুরমতো এক অভিযান। ইরানিরা এমনিতেই ভীষণরকম পরিচ্ছন্ন জাতি। নওরোজ উপলক্ষে সেই পরিচ্ছন্নতায় যুক্ত হয় নতুন নতুন আকাঙ্ক্ষা ও মনযোগ। কেউ রঙ করে। সামর্থ্য অনুযায়ী কেউ ঘরের আসবাবপত্র পাল্টায়। কেউবা ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন বা ঘরের অভ্যন্তর সজ্জায় পরিবর্তন এনে সবকিছু নতুন করে সাজায়। এটাকে নওরোজের পরিভাষায় 'খনে থেকনি' বলে। খনে মানে ঘর আর থেকনি মানে হলো ঝাঁকুনি দেওয়া। তার মানে কোনো কিছুর পর ময়লা, ধুলোবালি পড়লে যেভাবে আমরা ঝাড়া দিয়ে পরিষ্কার করার চেষ্টা করি, ঠিক সেরকম ঝেড়েমুছে ঘর পরিষ্কার করার নামই খনে থেকনি। তবে শুধু ঝেড়েই শেষ করা হয় না বরং ধুয়েমুছেও পরিচ্ছন্ন করা হয় বিগত বছরের সব ধুলোবালি, ময়লা-আবর্জনা, জরা-জীর্ণতা।

সারা দেশ জুড়ে এই পরিচ্ছন্নতা অভিযান চলার ফলে পুরো দেশটাই একেবারে নতুন ঝকমকে হয়ে ওঠে। মিউনিসিপাল করপোরেশন কর্তৃপক্ষও দেশের সম্ভাব্য সৌন্দর্য বর্ধন উপযোগী জায়গাগুলোতে ফুল কিংবা নতুন উদ্ভিদ রোপন করে সাজিয়ে তোলে পরিবেশকে। নওরোজে তাই সত্যিকার অর্থেই নতুন আমেজ তৈরি হয় ইরানিদের মাঝে। ইরানিদের একটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হলো নওরোজে সবার বাড়িতে মোটামুটি আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের যাওয়া-আসা। তাই সার্বক্ষণিক পরিচ্ছন্নতার আয়োজন চলে। এর মাধ্যমে মানুষের মনেও আসে এক ধরনের পবিত্রতা। সবুজের নবজন্মে বিশ্বাসে আসে নতুন মাত্রা। যারা পুনরুজ্জীবন কিংবা পরকালীন জীবনে বিশ্বাস করে তাদের বিশ্বাসের পালে লাগে নতুন হাওয়া। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাকে ঈমানের অংশ বলা হয়েছে ইসলামে। একইভাবে পরকালীন জীবনে বিশ্বাসও ঈমানের অংশ।

নওরোজ উৎসবকে ইরানে ঈদে নওরোজ বলে অভিহিত করা হয়। তবে এই ঈদের সঙ্গে ইসলামের ঈদকে মেলানো চলবে না। কারণ ইরানে যে-কোনো উৎসবকেই 'ঈদ' বলা হয়। যদিও ঈদের সঙ্গে একটা মিল আছে নওরোজের। সেটা হলো কেনাকাটার ধুম পড়ে যায় নওরোজের কিছুদিন আগে থেকেই। বাজার-ঘাটগুলো তাই জনারণ্যে পরিণত হয়ে ওঠে। শুরুতেই বলেছি যে নওরোজ উপলক্ষ্যে বেশ লম্বা ছুটি থাকে ইরানে। ছুটিতে বাজারঘাট বন্ধ থাকে। সেজন্য বন্ধের দিনগুলোতে বাজারের চাহিদা মেটাতে নওরোজের আগেভাগে জমজমাট হয়ে পড়ে রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার সব। নতুন জামা-কাপড় থেকে শুরু করে ঘরের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব কেনাকাটার ধুম পড়ে যায়।

প্রকৃতির সঙ্গে মিল রেখে সবাই নতুন জামা পরার চেষ্টা করবে-এটাই স্বাভাবিক। নবীন কিশলয় যেরকম ঝকমকে প্রতিবিম্ব ছড়ায় নতুন জামার আয়োজনেও দেশজুড়ে সেরকম নতুনের আমেজ লক্ষ্য করা যায়। মাটির চেহারা সবুজের আগমনে, এই বসন্তে যেভাবে পাল্টে যায়, প্রকৃতির সেই রূপ ইরানিরা তাদের পোশাক-আশাকেও চর্চা করে। বসন্তের আগমনে তাই প্রতিটি ইরানির মনেও স্বাভাবিকভাবেই বিরাজ করে সবুজ সতেজ আনন্দময় বসন্তের উচ্ছ্বাস এবং নির্মল প্রশান্তি।

বন্ধুরা! বিশেষ এ আয়োজনের এ পর্যায়ে শোনা যাক বসন্তগীতির বাকি অংশ। 

এই গানটা না, আসলেই হৃদয় কেড়ে নেয়। বিশেষ করে বসন্তের আমেজ সৃষ্টি করে মনের গহীনে।

যাই হোক, নওরোজে বুট-বাদাম, পেস্তা, আখরোট, ফল-ফুলের বিচি জাতীয় শস্যদানা খাওয়ার প্রচলনও ইরানে বেশ প্রাচীনকাল থেকেই রয়েছে। নওরোজে প্রায় প্রতিটি ইরানির ঘরেই সারাবছর ধরেই এগুলোর সংগ্রহ লক্ষ্য করা যাবে। আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। নওরোজের ছুটির অবসরে বেড়াতে যাওয়া ইরানিদের একটা ঐতিহ্য। প্রাচীনকাল থেকেই এই প্রবণতা চলে আসছে ইরানিদের মাঝে। নওরোজে যেখানেই বেড়াতে যাবে এই শস্যদানা খাওয়ার চেষ্টা চলবে। গল্প-গুজবের ফাঁকে ফাঁকে শস্যবীচির সঙ্গে চা খাওয়ার প্রচলন ইরানিদের মাঝে সহজলক্ষ্য।

'হাফত-সিন' সংস্কৃতির কথা না বললেই নয়। নওরোজের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে এই 'হাফত-সিন' সংস্কৃতি। হাফত-সিন হলো ফার্সি সিন বর্ণ দিয়ে শুরু হয়েছে-এরকম সাতটি জিনিস দিয়ে ঘরে ঘরে টেবিল সাজানোর সংস্কৃতি। এর বিভিন্ন প্রতীকী অর্থ রয়েছে। কেউ কেউ সিন দিয়ে শুরু সাতটি খাবার দিয়েও হাফত-সিন সাজায়। যেমন: সোমগ-এক ধরনের পাহাড়ি গাছের ফলের গুঁড়ো, সির মানে রসুন, সিব মানে আপেল, সানজেদ-এটাকে রাশিয়ান অলিভও বলা হয়, সামানু-গমের চারার শাস দিয়ে তৈরি এক ধরনের খাবার, সেরকেহ মানে সিরকা এবং সাবজেহ মানে সবুজ চারা।

হাফত-সিনের টেবিলে এই সাতটি জিনিসের পাশাপাশি কুরআনে মাজিদ, পানি, গোল্ড ফিশ এবং ডিমও রাখা হয়। আরও রাখা হয় বিচিত্র মিষ্টি ও শুকনো ফল। ইরানি মিষ্টি শুকনো বলে দীর্ঘদিন থাকে, নষ্ট হয় না। এই হলো মোটামুটি ইরানি হাফত-সিন সংস্কৃতি। তবে অঞ্চলভেদে এতে অন্যান্য সংযোজনি কিংবা বিয়োজনও লক্ষ্য করা যায়। বাড়ির মহিলারাও নওরোজ উপলক্ষে বিভিন্ন রকমের খাদ্য সামগ্রী তৈরি করে থাকেন। নওরোজ উপলক্ষে তরুণ-তরুণীদের মাঝে বিয়ের একটা সংস্কৃতি লক্ষণীয়। যে মেয়ের সঙ্গে এঙ্গেইজমেন্ট হয়েছে সেই পাত্রীর বাসায় নওরোজের আগমনে কিছু উপহার সামগ্রী পাঠানো হয়। এই উপহারকে 'এইদুনে' বলে অভিহিত করা হয়। এইদুনে মানে হলো ঈদ উপহার। নতুন জামা, মিষ্টি, বাদাম জাতীয় পণ্য, সামানু কিংবা স্বর্ণ ইত্যাদি এইদুনের অন্তর্ভুক্ত থাকে। পাত্রীপক্ষও পাত্র পক্ষকে নওরোজের রাতে আমন্ত্রণ জানায়। সেইসঙ্গে জামা-কাপড় ইত্যাদি উপহার দেয়।

নওরোজের প্রথম প্রহরে মানে বছর শুরুর একেবারে সূচনালগ্নে একটি দোয়া পাঠ করা হয়। এই দোয়াটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। দোয়াটি হলো:

یا مقلب القلوب و الابصار یا مدبرالیل و النهار یا محول الحول و الاحوال حول حالنا الی احسن الحال.

[ ইয়া মুকাল্লিবাল কুলুবি ওয়াল আবচার, ওইয়া মুদাব্বিরাল লাইলি ওয়ান নাহার, ইয়া মুহাভভিলাল হাওলি ওয়াল আহওয়াল! হাভভিল হা-লানা ইলা আহসানিল হাল ]

এর অর্থ হলো: “হে অন্তর ও দৃষ্টির পরিবর্তনকারী এবং দিন ও রাতের পরিচালনাকারী এবং অবস্থার পরিবর্তনকারী-মহান আল্লাহ! আমাদের অবস্থাকে সর্বোত্তম অবস্থায় রূপান্তরিত করুন।”

সুন্দর এই দোয়াটি আমাদের সবার জীবনে বয়ে আনুক ইতিবাচক পরিবর্তন। এ প্রত্যাশায় পরিসমাপ্তি টানছি নওরোজের বিশেষ আয়োজনের।

  • সবাইকে আবারও নওরোজের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/২০

ট্যাগ