কুরআনের আলো
সূরা গাফির: আয়াত ১৬-২০ (পর্ব-৫)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা গাফির বা মু'মিনের ১৬ নম্বর থেকে ২০ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ১৬ ও ১৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
يَوْمَ هُمْ بَارِزُونَ لَا يَخْفَى عَلَى اللَّهِ مِنْهُمْ شَيْءٌ لِمَنِ الْمُلْكُ الْيَوْمَ لِلَّهِ الْوَاحِدِ الْقَهَّارِ (16) الْيَوْمَ تُجْزَى كُلُّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ لَا ظُلْمَ الْيَوْمَ إِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ (17)
“যেদিন লোকসকল প্রকাশিত হবে সেদিন আল্লাহ্র কাছে তাদের কিছুই গোপন থাকবে না। আজ কর্তৃত্ব কার? আল্লাহরই, যিনি একক, প্রবল প্রতাপশালী।” (৪০:১৬)
“আজ প্রত্যেককে তার কৃতকর্ম অনুসারে প্রতিফল দেয়া হবে; আজ কোন জুলুম নেই। নিশ্চয় আল্লাহ্ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী।” (৪০:১৭)
এ দুই আয়াতে কিয়ামত দিবসের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হচ্ছে: সেদিন সব আবরণ খুলে যাবে এবং সবকিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে। মানুষের সব কৃতকর্ম প্রকাশ হয়ে পড়বে এবং কোনোকিছুই গোপন থাকবে না।
যদিও এই পৃথিবীতেই আল্লাহর কাছে কোনো কিছু গোপন নেই; কিন্তু তারপরও মানুষ ভাবে তারা হয়তো কিছু কিছু বিষয় আল্লাহর কাছ থেকেও গোপন রাখতে পারবে। কিন্তু তারা কিয়ামতের দিন উপলব্ধি করবে তাদের প্রতিটি কথা, কাজ ও আচরণ রেকর্ড হয়ে রয়েছে। ভয়াবহ সেই দিন আমাদের সবাইকে আল্লাহ তায়ালার সামনে উপস্থিত হতে হবে। সেদিনের কর্তৃত্ব হবে একমাত্র আল্লাহর। যদিও পার্থিব জীবনেও কর্তৃত্ব একমাত্র তাঁর কিন্তু কিয়ামতের দিন এ বিষয়টি মানুষের সামনে পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে যাবে। সেদিন পৃথিবীর রাজা-বাদশাহ ও অহংকারি মানুষগুলোর কোনো প্রতিপত্তি থাকবে না।
কিয়ামতের দিন আল্লাহর ক্ষমতা এতখানি স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, মানুষ এমনকি নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ওপরও কর্তৃত্ব রাখবে না। এসব অঙ্গ আল্লাহর নির্দেশে মানুষের বিপক্ষে সাক্ষী দেবে। সেদিন মানুষ তার ভালো ও মন্দ কর্মের উপযুক্ত প্রতিদান পাবে। পার্থিব জীবনে মানুষ স্বার্থ ও ভোগের পেছনে ছুটতে গিয়ে একে অন্যের প্রতি জুলুম বা অন্যায় করে। কিন্তু কিয়ামতের দিন কেউ জুলুম করার ক্ষমতা রাখবে না। সেদিন ক্ষমতা থাকবে একমাত্র আল্লাহর হাতে এবং তিনি ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিন্দুমাত্র জুলুম করবেন না। তিনি প্রত্যেককে তার কৃতকর্ম অনুযায়ী প্রতিদান দেবেন এবং তা সম্পন্ন হবে ক্ষিপ্র গতিতে।
দুনিয়ার আদালতের বিচার সম্পন্ন হতে মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছরও লেগে যায়। কিন্তু কিয়ামতের দিনের বিচার মুহূর্তের মধ্যে সম্পন্ন হবে এবং প্রত্যেকের ভাগ্য অতি দ্রুততার সঙ্গে নির্ধারিত হয়ে যাবে।
এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. আমরা যেন না ভাবি আল্লাহর কাছ থেকেও কোনো কিছু গোপন করা যায়। কিয়ামতের দিন তার সামনে কোনো কিছুই অস্পষ্ট থাকবে না।
২. কিয়ামতের দিন কাউকে হিসাব-নিকাশ বা বিচারের বাইরে রাখা হবে না। সেদিনের বিচারে আত্মীয়তার বন্ধন বা অন্য কোনো সম্পর্ক কাজে আসবে না।
৩. বিশ্বজগত পরিচালনায় আল্লাহ তায়ালা মহাপ্রতাপশালী ও প্রতিদ্বন্দ্বীহীন হওয়া সত্ত্বেও তিনি কারো ওপর জুলুম করেন না।
এই সূরার ১৮ থেকে ২০ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَأَنْذِرْهُمْ يَوْمَ الْآَزِفَةِ إِذِ الْقُلُوبُ لَدَى الْحَنَاجِرِ كَاظِمِينَ مَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ حَمِيمٍ وَلَا شَفِيعٍ يُطَاعُ (18) يَعْلَمُ خَائِنَةَ الْأَعْيُنِ وَمَا تُخْفِي الصُّدُورُ (19) وَاللَّهُ يَقْضِي بِالْحَقِّ وَالَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ لَا يَقْضُونَ بِشَيْءٍ إِنَّ اللَّهَ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ (20)
“আর আপনি তাদেরকে সতর্ক করে দিন আসন্ন দিন (বা কিয়ামত দিবস) সম্পর্কে; যখন (ভয়ের তীব্রতায়) দুঃখ-কষ্ট সম্বরণরত অবস্থায় তাদের প্রাণ কণ্ঠাগত হবে। (সেদিন) জালিমদের কোন অন্তরঙ্গ বন্ধু নেই এবং এমন কোন সুপারিশকারীও নেই যার সুপারিশ গ্রাহ্য হবে।” (৪০:১৮)
“তিনি চোখসমূহের চোরা চাহনি এবং অন্তরসমূহের গোপন বিষয়াদি জানেন।” (৪০:১৯)
“আর আল্লাহ ফয়সালা করেন যথাযথভাবে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তারা যেসব মাবুদকে ডাকে তারা কোন কিছুর ফয়সালা করতে পারে না। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।” (৪০:২০)
কিয়ামত দিবসের বর্ণনা দেয়ার পর এই তিন আয়াতে বলা হচ্ছে: তোমরা ভেবনা কিয়ামত বহুদূরের কোনো ঘটনা বরং কিয়ামত অতি নিকটে এবং সেদিন তোমাদেরকে কৃতকর্মের হিসাব দিতে হবে। কিয়ামতের দিন এত বেশি ভয়াবহ হবে যে, মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়বে এবং তার হৃৎপিণ্ড মনে হবে উৎকণ্ঠায় স্থানচ্যুত হয়ে গেছে এবং সেটি তার কণ্ঠ থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে।
প্রতিটি মানুষ অন্যের সামনে কৃতকর্ম প্রকাশ হয়ে পড়া এবং জাহান্নামে যাওয়ার ভয়ে এতটা আতঙ্কিত থাকবে যে সে ভয়াবহতা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার যোগাড় হবে কিন্তু মুখ ফুটে কেউ তা বলতে পারবে না। কারণ, আল্লাহর আদালতে সবাই উপস্থিত এবং সেখানে চিৎকার চেচামেচি করার সাহস কারো থাকবে না।
এ ধরনের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মানুষ সাধারণত পরিচিত ও প্রভাবশালী আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধব খোঁজ করে। এ কারণে এ বিষয়টিও আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতেই মানুষের জন্য স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, সেদিন সুপারিশ করার জন্য তো দূরের কথা সান্ত্বনা দেয়ার মতো কেউও আশপাশে থাকবে না। কারণ, সেদিন প্রত্যেকে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে বলে অন্যের উপকার করার সুযোগই পাবে না। পরে আয়াতে আল্লাহ তায়ালার মহাজ্ঞানের বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হচ্ছে: যখন তোমরা চোখ দিয়ে হারাম দৃশ্য উপভোগ করতে এবং ভাবতে কেউ তোমাদের দেখছে না তখনও সেখানে আল্লাহ তায়ালা উপস্থিত ছিলেন এবং এই চোরা চাহনি টের পেয়েছেন। সেইসঙ্গে তোমরা যেসব অপকর্ম করার কথা কল্পনা করেছিলে তাও তিনি জানতেন। অবশ্য চোখের খেয়ানত বা চোরা চাহনি বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। পরনারীর দিকে দৃষ্টি হতে পারে আবার অন্যের দিকে তাচ্ছিল্যভরা দৃষ্টিতে তাকানোও হতে পারে। এসব দৃষ্টিকে চোরা চাহনি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
নিঃসন্দেহে এই বিষয়গুলো সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তোলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষ যখন জানবে তার গোপন দৃষ্টি, অন্তরের কল্পনা এবং অসৎ বাসনাগুলিও আল্লাহ জেনে যাচ্ছেন তখন সে তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জন করবে এবং কথা, কাজ ও কল্পনায় আল্লাহকে ভয় করবে।
এই তিন আয়াতে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে:
১. কিয়ামতের দরজা হচ্ছে মৃত্যু। কাজেই কিয়ামতকে অতি নিকটে ভেবে আমাদেরকে এখনই সেই ভয়াবহ দিনের জন্য প্রস্তুত করতে হবে।
২. কিয়ামতের দিন গোনাহগার মানুষগুলো নিজেদের কৃতকর্মের জন্য ভয়ানক আতঙ্কে থাকবে ঠিকই কিন্তু চিৎকার দিতে পারবে না।
৩. অপরাধী মানুষের জন্য কিয়ামত একাকিত্বের দিবস। সেদিন ঘনিষ্ঠ বন্ধু বা দুনিয়ার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কোনো কাজে আসবে না। প্রত্যেকে নিজ নিজ প্রাণ বাঁচানোর আশা করবে।
৪. আমরা যদি নিজেদেরকে একথা বোঝাতে পারি যে, আমাদের অন্তরের বাসনাগুলি সম্পর্কেও আল্লাহ তায়ালা সম্যক অবহিত তখন আমরা সব ধরনের খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে পারব এবং এটিই হচ্ছে তাকওয়া বা খোদাভীতি।#
পার্সটুডে/এমএমআই/এআর/২৯
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।