এপ্রিল ১২, ২০২১ ১৮:৪৩ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা গাফির বা মু'মিনের ২৬ নম্বর থেকে ২৮ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ২৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:  

وَقَالَ فِرْعَوْنُ ذَرُونِي أَقْتُلْ مُوسَى وَلْيَدْعُ رَبَّهُ إِنِّي أَخَافُ أَنْ يُبَدِّلَ دِينَكُمْ أَوْ أَنْ يُظْهِرَ فِي الْأَرْضِ الْفَسَادَ (26)

“ফেরাউন বলল, আমাকে ছেড়ে দাও আমি মূসাকে হত্যা করি এবং সে তার রবকে (তাকে বাঁচানোর জন্য) ডাকুক। নিশ্চয় আমি আশংকা করি যে, সে তোমাদের দ্বীন পরিবর্তন করে দেবে অথবা সে এই জনপদে বিপর্যয় ছড়িয়ে দেবে।” (৪০:২৬)

গত আসরে আমরা বলেছি, হযরত মূসা (আ.) অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদত করার জন্য এবং বনি ইসরাইল জাতির ওপর অত্যাচার না করার জন্য ফেরাউন ও তার সহযোগীদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি নিজের নবুওয়াতের স্বপক্ষে সুস্পষ্ট প্রমাণ ও অলৌকিক নিদর্শন তুলে ধরে।  এরপর আজকের এই আয়াতে বলা হচ্ছে: অহংকারি রাজা ফেরাউন এ আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে তার সভাসদকে উদ্দেশ করে বলে: যদি মূসাকে এ অবস্থায় ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে সে আমার রাজত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে, মানুষের ধর্ম পরিবর্তন করে দেবে এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। যদি আমি নীরব থাকি তাহলে সে শিগগরি মিশরের জনগণের অন্তরে স্থান করে নেবে এবং মূর্তিপূজার স্থানে সে তার একত্ববাদী ধর্ম প্রবর্তন করবে। কাজেই এসব যাতে করতে না পারে সেজন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মূসাকে হত্যা করতে হবে।

ফেরাউনের দৃষ্টিতে জনগণের মাধ্যমে তার পূজা ও মূর্তির উপাসনা করাই ছিল ধর্ম। জনগণকে ধোঁকা দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা ছিল তার সে ধর্মের মূল বৈশিষ্ট্য। আর যদি কেউ জনগণকে ফেরাউনের অত্যাচারী শাসন ও মূর্তিপূজা থেকে মুক্ত করার জন্য আন্দোলন করার চেষ্টা করত সেটা ছিল তার দৃষ্টিতে বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় সৃষ্টি।  অবশ্য শুধু ফেরাউন নয়, যুগে যুগে সব অত্যাচারী শাসক এই একই নীতিতে দেশ শাসন করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে।

যাই হোক, ফেরাউন বলল: দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী মূসাকে হত্যা করাই হচ্ছে এর একমাত্র সমাধান। সে হযরত মূসা (আ.)কে উদ্দেশ করে বলল: তোমার আল্লাহকে এখন আমার হাত থেকে তোমাকে রক্ষা করতে বলো। অবশ্য ফেরাউনের সভাসদদের সবাই তার এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত ছিল না। তারা মনে করতেন, বনি ইসরাইল জাতির মধ্যে হযরত মূসার যে প্রবল জনপ্রিয়তা রয়েছে, তাতে তাকে হত্যা করলে এই জাতি সরকারের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহ করতে পারে এবং তাতে ফেরাউনের শাসনব্যবস্থা ওলটপালট হয়ে যেতে পারে।

এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:

১- ফেরাউনের মতো অত্যাচারী শাসকেরা নিজেদের শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে সমাজে প্রচলিত অন্যায় রীতি ধরে রাখার চেষ্টা করে। কেউ এর ব্যত্যয় ঘটাতে চাইলে বা সমাজ সংশোধনের চেষ্টা করলে বিদ্রোহী আখ্যা দিয়ে তাকে হত্যা করে।

২- অত্যাচারী শাসকদের দেশে যদি শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় থাকতে দেখা যায় তবে তা হয় নিরাপত্তা বাহিনীর দমন অভিযানের ভয়ে; তাতে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকে না।

সূরা গাফির বা মুমিনের ২৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

وَقَالَ مُوسَى إِنِّي عُذْتُ بِرَبِّي وَرَبِّكُمْ مِنْ كُلِّ مُتَكَبِّرٍ لَا يُؤْمِنُ بِيَوْمِ الْحِسَابِ (27)

“এবং মূসা বললেন, আমি আমার রব ও তোমাদের রবের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি এমন প্রত্যেক অহংকারী ব্যক্তি হতে যে বিচার দিনের উপর ঈমান রাখে না।” (৪০:২৭)

ফেরাউনের হত্যা করার হুমকির সামনে মোটেও বিচলিত হননি হযরত মূসা (আ.)। তিনি দৃঢ়চিত্তে বলেন: আমি সেই রবের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি যিনি আমার এবং তোমার পালনকর্তা। তিনি অনুমতি না দিলে তোমার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়। আমি যখন ভূমিষ্ট হয়েছিলাম তখন তুমি আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলে। কিন্তু সেই রবের নির্দেশে আমার মা আমাকে বাক্সে ভরে নীল নদে ভাসিয়ে দিয়েছিল এবং তুমি নিজের হাতে আমাকে নদী থেকে তুলে লালনপালন করেছ। আজও সেই আল্লাহ আমাকে রক্ষা করবেন। কিন্তু তিনি যদি তোমার হাতে আমার শাহাদাতের ফয়সালা করে থাকেন তাহলে সেজন্যও আমি প্রস্তুত রয়েছি। আমি নিজেকে তাঁর হাতে সঁপে দিয়েছি এবং এখন তাঁর ইচ্ছাতেই সবকিছু হবে তোমার ইচ্ছায় নয়।

এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:

১- আমরা যেন ইসলামের শত্রুদের হুমকিতে ভীত না হই। আমাদেরকে একমাত্র তাঁর সাহায্য চাইতে হবে যার চেয়ে বড় আর কোনো শক্তি নেই।

২- অহংকার ও স্বেচ্ছাচারিতা হচ্ছে ফেরাউনি শক্তির বৈশিষ্ট্য।  এজন্য ক্ষমতায় থাকা জরুরি নয়। এই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মানুষেরা আল্লাহ ও পরকালে ঈমান আনতে চায় না।

এই সূরার ২৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:

وَقَالَ رَجُلٌ مُؤْمِنٌ مِنْ آَلِ فِرْعَوْنَ يَكْتُمُ إِيمَانَهُ أَتَقْتُلُونَ رَجُلًا أَنْ يَقُولَ رَبِّيَ اللَّهُ وَقَدْ جَاءَكُمْ بِالْبَيِّنَاتِ مِنْ رَبِّكُمْ وَإِنْ يَكُ كَاذِبًا فَعَلَيْهِ كَذِبُهُ وَإِنْ يَكُ صَادِقًا يُصِبْكُمْ بَعْضُ الَّذِي يَعِدُكُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي مَنْ هُوَ مُسْرِفٌ كَذَّابٌ (28)

“আর (তখন) ফেরাউন বংশের এক মুমিন ব্যক্তি যে তার ঈমান গোপন রাখছিল সে বলল: তোমরা কি এমন এক ব্যক্তিকে হত্যা করবে যে বলে, আমার রব আল্লাহ;  অথচ সে তোমাদের রবের কাছ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণসহ তোমাদের কাছে এসেছে? সে মিথ্যাবাদী হলে সে মিথ্যার জন্য তার ক্ষতি হবে; আর যদি সে সত্যবাদী হয়, (তবে) সে তোমাদেরকে যে (শাস্তির) ওয়াদা দিচ্ছে, তার কিছু তোমাদের উপর আপতিত হবে। নিশ্চয় আল্লাহ তাকে হেদায়াত দেন না, যে সীমালংঘনকারী, মিথ্যাবাদী।” (৪০:২৮)

ফেরাউনের সভাসদদের মধ্যে এক ব্যক্তি হযরত মূসা (আ.)’র প্রতি ঈমান এনেছিলেন। কিন্তু তিনি জরুরি মুহূর্তে আল্লাহর রাসূলকে সাহায্য করার জন্য নিজের ঈমানের কথা গোপন রেখেছিলেন। তিনি যখন দেখলেন ফেরাউন হযরত মূসাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছে তখন তিনি সাহসী ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসেন এবং যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে আল্লাহর নবীকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, মূসা যে রবের কথা বলছেন, তিনি আমাদের সবাইকে সৃষ্টি করেছেন এবং বিশ্বজগত তার ইচ্ছায় পরিচালিত হচ্ছে। তিনি মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করার জন্য মূসাকে অলৌকিক নিদর্শন ও সুস্পষ্ট প্রমাণসহ প্রেরণ করেছেন।

ওই মুমিন ব্যক্তি ফেরাউনকে উদ্দেশ করে আরো বলেন: কাজেই আপনি তড়িঘড়ি করে কোনো কাজ করে বসবেন না বরং ভেবেচিন্তে কাজ করুন। তা না হলে অনুতপ্ত হতে হবে। তিনি আরো বলেন: মূসা সত্য অথবা মিথ্যা- এ দু’টির মধ্যে যেকোনো একটি বলছে। যদি সে মিথ্যা বলে থাকে তাহলে সবার সামনে একদিন তা প্রকাশ হয়ে পড়বে এবং সে জনগণের সামনে অপমানিত হবে। কিন্তু যদি সে সত্য বলে থাকে, তাহলে সে যেসব শাস্তির কথা বলছে তার দু’একটি যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলেও আমাদের ধ্বংস হয়ে যেতে হবে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- হযরত মূসা ফেরাউনের হাত থেকে রক্ষা পেতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চান এবং আল্লাহ ফেরাউনের দরবারেরই একজনকে তার সাহায্যকারী করে দেন।

২- কখনো কখনো জরুরি ও বৃহত্তর প্রয়োজনে নিজের ঈমানের কথা গোপন রেখে অত্যাচারী শাসকের সাহায্যকারী হিসেবেও কাজ করা যায়। এর ফলে ঈমান নষ্ট হয় না।#

পার্সটুডে/এমএমআই/এআর/১২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।