ইরানের পণ্যসামগ্রী: প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদে বিশ্বে ১ম অবস্থানে ইরান
গত আসরে আমরা রাসায়নিক পণ্য সামগ্রীর ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান, অগ্রগতি ও তৎপরতা নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি।
ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের আগের তুলনায় বিপ্লব বিজয়ের পর আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এই শিল্পটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
বিশেষ করে ইরানের পেট্রোকেমিক্যাল খাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বিনিয়োগ করার জন্য এগিয়ে এসেছে। পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পের জন্য উপযুক্ত অবকাঠামো থাকার কারণে ইরানের এই শিল্পটির প্রতি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। যাই হোক আজকের আসরে আমরা ইরানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদ 'গ্যাস' নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো। দুই হাজার ষোলো সালে আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, উনিশ হাজার কোটি ঘনমিটার গ্যাসের উৎপাদন করে ইরান বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গ্যাস উত্পাদনকারী দেশের মর্যাদায় অবস্থান করছে। আর সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ থাকার কারণে ইরান বিশ্বে প্রথম অবস্থানে রয়েছে।
বিংশ শতাব্দির সত্তরের দশকের শুরু থেকে জ্বালানীর বিভিন্ন উৎসের মধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। বিশ্বে ব্যবহৃত বিচিত্র জ্বালানির মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে এই প্রাকৃতিক গ্যাস। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, উত্পাদন ও জ্বালানি-সম্পর্কিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, বিশ্ব বাজারে এর ক্রমবর্ধমান চাহিদা ইত্যাদি কারণে বিশ্ব জ্বালানির ভুবনে প্রাকৃতিক গ্যাস শীর্ষ জ্বালানী হিসাবে স্থান করে নিয়েছে। সাম্প্রতিক দশকগুলিতে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির চাহিদাটা কম দূষণকারী জ্বালানীর দিকে চলে গেছে। সবাই চায় এমন জ্বালানি ব্যবহার করতে যাতে পরিবেশ দূষণ কম হয়। এই বিবেচনায় দেখা গেছে প্রাকৃতিক গ্যাস অন্যান্য জীবাশ্ম বা ফসিল জ্বালানী যেমন কয়লা কিংবা তেলের তুলনায় পরিবেশকে কম দূষিত করে। প্রাকৃতিক এই গ্যাস থেকে জ্বালানির আরও যত রকমের প্রোডাক্ট তৈরি হয় সেগুলো অপরিশোধিত তেলের চেয়ে শতকা প্রায় চব্বিশ ভাগ কম পরিবেশ দূষণকারী।

কয়লা জ্বালানির চেয়ে শতকরা বিয়াল্লিশ ভাগ কম দূষণ তৈরি করে। প্রাকৃতিক গ্যাস বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উত্স। বিদ্যুৎ হলো সবচেয়ে কম দূষণকারী পরিষ্কার একটি শক্তি। এ কারণে এই বিদ্যুতের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। এক গবেষণায় দেখা আগামি পণর বছরের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার এক দশমিক দুই শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এর কারণ হলো গ্যাসের দূষণের মাত্রা কম। তাছাড়া উৎপাদন খরচও তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় প্রাকৃতিক গ্যাস বিদ্যুৎ উৎপাদনে একটি আকর্ষণীয় উত্স হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে ২০১৫ সালে বিশ্বজুড়ে সাড়ে তিন লাখ কোটি ঘনমিটারেরও বেশি প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করা হয়েছি যা দুই হাজার সালের তুলনায় শতকরা একচল্লিশ ভাগ বেশি।
প্রাকৃতিক গ্যাস আবিষ্কার হয়েছে হাজার হাজার বছর আগে। ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ অনুসারে, চীনারা তিন হাজার বছর আগে ভূপৃষ্ঠের তিন শ থেকে ছয় শ মিটার গভীরতা থেকে গ্যাস উত্তোলন করেছিল এবং লবণাক্ত জলের বাষ্পীভবনে গ্যাস ব্যবহার করেছিল। ইতিহাস অনুসারে প্রাচীন ইরানিরা আদিম এবং বিক্ষিপ্ত উপায়ে তেল এবং গ্যাস ব্যবহার করতো। অতীতকালে কোনো কোনো এলাকায় মাটির স্তরের গভীরতা কম থাকার কারণে পেট্রোলিয়াম জাতীয় বিভিন্ন উপাদান মাটির গহ্বর থেকে বের হয়ে যেত। এর ফলে কোথাও কোথাও প্রাকৃতিক প্রজ্বলনের ঘটনাও ঘটতো। সুলাইমান মসজিদের নিকটে জরথ্রুস্ট্রিয়ানদের মন্দির এবং আজারবাইজানের আজার গ্যাশছাব অগ্নিমন্দির এই প্রাকৃতিক প্রজ্জ্বলনের ঐতিহাসিক সত্যতা প্রামাণ্য করে তোলে। এসব এলাকার জরথ্রুস্ট্রিয়ানরা তাদের অগ্নি মন্দিরে আগুন প্রজ্জ্বলিত রাখার জন্য এই প্রাকৃতিক প্রজ্জ্বলন বা অগ্নিশিখা ব্যবহার করতো।
প্রাকৃতিক গ্যাস বা মিথেন-সিএইচ-ফোর হাইড্রোকার্বন জগতের মধ্যে সবচেয়ে সহজ এবং বহুল ব্যবহৃত হাইড্রোকার্বন। গ্যাস একটি বায়বীয় জীবাশ্ম জ্বালানী যা অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানীর তুলনায় সাধারণত পরিবেশের জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ এবং এটি একটি পুনর্নবীকরণযোগ্য উপাদান। বর্তমানে প্রাকৃতিক গ্যাস শিল্প এবং গার্হস্থ্য ব্যবহারের জন্য সর্বাধিক ব্যবহৃত জ্বালানি। অপরাপর জ্বালানির তুলনায় বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও এর ব্যবহার আরও বেশি সম্প্রসারিত হবে বলে মনে করা হয়। "ওয়ার্ল্ড এনার্জি স্ট্যাটিস্টিকস রিভিউ ২০১৭ " শিরোনামে ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বিপি'র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাপী গ্যাসের উত্পাদন বেড়েছে এবং এই উৎপাদনের গড় পরিমাণ সাড়ে তিন হাজার বিলিয়ন ঘনমিটারের বেশি।
বিশ্বব্যাপী গ্যাসের উত্পাদন বৃদ্ধি নিয়ে কথা বলছিলাম বিরতির আগে। ২০১৬ সালের যে পরিসংখ্যানটি সেটি বিগত বছর অর্থাৎ দুই হাজার পণেরো সালের তুলনায় বৈশ্বিক গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণের চেয়ে একুশ বিলিয়ন ঘনমিটার বৃদ্ধি দেখাচ্ছে। ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ১৯০ বিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস উৎপাদন করে ইরান বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গ্যাস উত্পাদনকারী দেশে পরিণত হয়েছিল। উল্লেখ্য যে সর্বাধিক প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদের দিক থেকে ইরান বিশ্বে প্রথম অবস্থানে রয়েছে।
বিশ্বে এক শ আটাশি ট্রিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস মজুদ রয়েছে। এর মধ্যে ইরানে গ্যাসের মজুদ প্রায় চৌত্রিশ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার। তার মানে বিশ্বের মোট প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদের আঠারো শতাংশ রয়েছে ইরানে। এটি সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে মজুদ গ্যাসের একান্ন শতাংশ এবং ওপেকভুক্ত তেল রফতানিকারক দেশগুলির মোট গ্যাস মজুদের চল্লিশ শতাংশের সমান। #
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/ মো:আবু সাঈদ/ ১৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।