এপ্রিল ২২, ২০২১ ১৯:৩৪ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা গাফির বা মু'মিনের ২৯ নম্বর থেকে ৩৩ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ২৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

يَا قَوْمِ لَكُمُ الْمُلْكُ الْيَوْمَ ظَاهِرِينَ فِي الْأَرْضِ فَمَنْ يَنْصُرُنَا مِنْ بَأْسِ اللَّهِ إِنْ جَاءَنَا قَالَ فِرْعَوْنُ مَا أُرِيكُمْ إِلَّا مَا أَرَى وَمَا أَهْدِيكُمْ إِلَّا سَبِيلَ الرَّشَادِ (29) 

“হে আমার সম্প্রদায়! আজ রাজত্ব তোমাদেরই, (এবং) এই দেশ তোমাদেরই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে; কিন্তু আমাদের উপর আল্লাহর শাস্তি এসে পড়লে কে আমাদেরকে সাহায্য করবে? ফেরাউন বলল: “আমি যা সঠিক মনে করি, তা ছাড়া তোমাদেরকে অন্য কিছু দেখাই না।  আর আমি তোমাদেরকে শুধু সঠিক পথই দেখিয়ে থাকি।”(৪০:২৯)

গত আসরে আমরা বলেছিলাম, ফেরাউনের দরবারের একজন মুমিন ব্যক্তি যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে হযরত মূসা (আ.)কে ফেরাউনের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। এরপর এই আয়াতে ওই মুমিন ব্যক্তির বক্তব্যের অব্যাহত অংশ তুলে ধরা হয়েছে। তিনি ফেরাউন ও তার পারিষদবর্গকে উদ্দেশ করে বলেন: মিশরের মতো একটি বিশাল দেশের ওপর তোমরা রাজত্ব করছ এবং গোটা দেশের ওপর তোমাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। কাজেই মূসা কিছু করতে চাইলেও তার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। কিন্তু যদি তাকে হত্যা করো তাহলে সে যে হুমকির কথা বলেছে তা সত্য হয়েও যেতে পারে। তখন আল্লাহ তোমাদের ওপর ক্ষুব্ধ হবেন এবং তোমাদের রাজত্ব কেড়ে নেবেন।

মুমিন ব্যক্তির এই বক্তব্যে ফেরাউনের পারিষদবর্গের মধ্যে ভাবান্তর লক্ষ্য করা যায়। তাদের মন কিছুটা নরম হয়। কিন্তু ফেরাউনের মন এতটুকু টলেনি। সে হযতর মূসাকে হত্যা করার সিদ্ধান্তে অটল থাকে।  সে সবাইকে উদ্দেশ করে বলে: আমি সব সময় সঠিক কথাই বলি এবং এখন মূসাকে হত্যা করাই হচ্ছে সঠিক পথ।

যুগে যুগে সব জালিম ও অত্যাচারী শাসক এই একই বক্তব্য দিয়ে এসেছে। তারা নিজেদেরকে সর্বজ্ঞানী মনে করে এবং তারা যা ভাবে সেটাকে সবার ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- আমরা যেন সম্পদ বা ক্ষমতার দাপট না দেখাই; কারণ আল্লাহ চাইলে যেকোনো মুহূর্তে এসব কেড়ে নিতে পারেন।

২- মুমিন ব্যক্তিদের দায়িত্ব অপরাধী ব্যক্তিকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা। যদি অপরাধী ব্যক্তি ফেরাউনের মতো প্রতাপশালী শাসকও হয় তবুও চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

৩- সতর্কবার্তায় কান না দেয়া এবং নিজেকে সর্বজ্ঞানী মনে করা হচ্ছে ফেরাউনি মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। তাকে ফেরাউনের মতো ক্ষমতাধর হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। যেকোনো সাধারণ মানুষও মন-মানসিকতায় ফেরাউনি চরিত্রের অধিকারী হতে পারে।

সূরা মুমিন বা গাফিরের ৩০ ও ৩১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

وَقَالَ الَّذِي آَمَنَ يَا قَوْمِ إِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ مِثْلَ يَوْمِ الْأَحْزَابِ (30) مِثْلَ دَأْبِ قَوْمِ نُوحٍ وَعَادٍ وَثَمُودَ وَالَّذِينَ مِنْ بَعْدِهِمْ وَمَا اللَّهُ يُرِيدُ ظُلْمًا لِلْعِبَادِ (31)

“যে ঈমান এনেছিল সে আরও বলল, হে আমার সম্প্রদায়! নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য পূর্ববর্তী দলসমূহের (ধ্বংস হয়ে যাওয়ার) দিনের অনুরূপ আশংকা করি-”(৪০:৩০)

“যা ঘটেছিল নূহ, আদ, সামুদ এবং তাদের পরবর্তী জাতিগুলোর ওপর।  আর আল্লাহ্‌ বান্দাদের প্রতি কোন জুলুম করতে চান না।” (৪০:৩১)

ফেরাউনকে হযরত মূসা (আ.)কে হত্যা করার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে দেখে তার সেই ঈমানদার পারিষদ আবার বক্তব্য শুরু করেন। তিনি পূর্ববর্তী জাতিগুলোর ধ্বংসাত্মক পরিণতি তুলে ধরেন এই আশা নিয়ে যে, তাতে হয়তো ফেরাউনের টনক নড়বে। তিনি বলেন: হে আমার জাতি! তোমরা নূহ, আদ, সামুদ এবং তাদের পরবর্তী জাতিগুলোর পরিণতির কথা জানো। তারা সভ্যতার শীর্ষে পৌঁছা সত্ত্বেও শিরক, কুফর ও জুলুম করার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে। নূহের জাতি মহাপ্লাবনে, আদ জাতি ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড়ে এবং সামুদ জাতি ভয়ঙ্কর বজ্রপাতে ভূপৃষ্ঠ থেকে মুছে গেছে।

মুমিন ব্যক্তি আরো বলেন: আমি এই আশঙ্কা করি যে, মিশরীয় জাতিও হয়তো সেভাবেই ধ্বংস হয়ে যাবে। অবশ্য পূর্ববর্তী জাতিগুলোর যে পরিণতি হয়েছিল তা ছিল তাদেরই কৃতকর্মের ফসল। মহান আল্লাহ তাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করতে চাননি। তিনি অসীম দয়ালু বলে তাঁর বান্দাদের অসংখ্য নেয়ামত দান করেন কিন্তু বান্দারাই নিজেদের উপর জুলুম করে ঐশী শাস্তি ডেকে আনে।

এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:

১- অতীত জাতিগুলোর পরিণতি থেকে শিক্ষা নিলে মানুষের ভবিষ্যতের চলার পথ সহজ হয়। পবিত্র কুরআন আমাদেরকে এই শিক্ষাই দিতে চেয়েছে।

২- ভুল চিন্তা ও পাপ কাজ যদি কারো অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় তাহলে সে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করে। অতীত জাতিগুলোর কাছে যখন পাপকাজ ভালো লাগতে শুরু করেছিল এবং কোনো অবস্থায় সত্য গ্রহণে রাজি হচ্ছিল না তখনই তাদের ওপর মহা শাস্তি নেমে আসে। 

সূরার ৩২ ও ৩৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

 وَيَا قَوْمِ إِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ يَوْمَ التَّنَادِ (32) يَوْمَ تُوَلُّونَ مُدْبِرِينَ مَا لَكُمْ مِنَ اللَّهِ مِنْ عَاصِمٍ وَمَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ (33)

“আর হে আমার সম্প্রদায়! আমি তোমাদের জন্য সেই দিনের আশংকা করি যেদিন মানুষ পরস্পরকে ডাকবে (এবং একে অপরের কাছে সাহায্য চাইবে)”(৪০:৩২)

“যেদিন তোমরা পেছন ফিরে (এদিক-সেদিক) পালাতে চাইবে, (কিন্তু সেদিন) আল্লাহর শাস্তি হতে তোমাদেরকে রক্ষা করার কেউ থাকবে না। আর আল্লাহ যাকে (তার কর্মফলের কারণে) বিভ্রান্ত করেন তার জন্য কোনো হেদায়াতকারী নেই।”(৪০:৩৩)

ফেরাউনের বংশের সেই মুমিন ব্যক্তি তার বক্তব্যে আরো বলেন: যদি অতীত জাতিগুলোর মতো আল্লাহর গজব নেমে আসে তাহলে পালিয়ে যাওয়ার কোনো পথ থাকবে না। কেউ তোমাদেরকে আল্লাহর ক্রোধ থেকে বাঁচাতে পারবে না। সেদিন তোমরা পরস্পরকে ডাকাডাকি করবে এবং একে অপরের সাহায্য কামনা করবে। কিন্তু সেই ডাকে কেউ সাড়া দেবে না কারণ, প্রত্যেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টায় মগ্ন থাকবে। তবে সেদিন শুধু তারাই মুক্তি পাবে যারা নবী-রাসূলদের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করেছে। যারা নবী-রাসূলদের শিক্ষা প্রত্যাখ্যান করেছে তারা আল্লাহর হেদায়েত থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তাদের পাপকর্মের কারণে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেন। ফলে কাফেররা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনে।  যে ছোট্ট শিশুটি পিতার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় সে হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে ব্যথা পাবে এটাই স্বাভাবিক।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- কর্মফলের ব্যাপারে পাপাচারী ব্যক্তিকে সতর্ক করা মুমিন ও মানবদরদী ব্যক্তিদের দায়িত্ব। যেমনিভাবে পিতামাতা তার সন্তানদের আগুনের নিকটবর্তী হতে দেখলে তাদেরকে সতর্ক করে দেন এবং দূরে সরিয়ে রাখেন।

২- হেদায়াত ও পথভ্রষ্টতা উভয়ই আল্লাহর হাতে রয়েছে। তবে কে হেদায়াত পাবে আর কে পথভ্রষ্ট হবে তা ওই ব্যক্তির কর্মফলের ওপর নির্ভর করে।

৩- হেদায়াত ও পথভ্রষ্টতার মধ্যবর্তী স্থান বলে কিছু নেই। একজন মানুষ হয় হেদায়াতের ওপর রয়েছে অথবা গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে। একজন মানুষের পক্ষে দুই দিকে থাকার কোনো সুযোগ নেই।#

পার্সটুডে/এমএমআই/এআর/২২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।