কুরআনের আলো
সূরা গাফির: আয়াত ৩৮-৪২ (পর্ব-১০)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা গাফির বা মু'মিনের ৩৮ নম্বর থেকে ৪২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৩৮ থেকে ৪০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَقَالَ الَّذِي آَمَنَ يَا قَوْمِ اتَّبِعُونِ أَهْدِكُمْ سَبِيلَ الرَّشَادِ (38) يَا قَوْمِ إِنَّمَا هَذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا مَتَاعٌ وَإِنَّ الْآَخِرَةَ هِيَ دَارُ الْقَرَارِ (39) مَنْ عَمِلَ سَيِّئَةً فَلَا يُجْزَى إِلَّا مِثْلَهَا وَمَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ يُرْزَقُونَ فِيهَا بِغَيْرِ حِسَابٍ (40)
“আর যে ঈমান এনেছিল সে আরও বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আমার অনুসরণ কর, আমি তোমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করব।” (৪০:৩৮)
“হে আমার সম্প্রদায়! এ দুনিয়ার জীবন কেবল (সামান্য) ভোগের বস্তু, আর নিশ্চয় আখিরাত হচ্ছে স্থায়ী আবাস।” (৪০:৩৯)
“কেউ মন্দ কাজ করলে সে শুধু তার কাজের অনুরূপ শাস্তিই প্রাপ্ত হবে। আর পুরুষ কিংবা নারীদের মধ্যে যারা মুমিন হয়ে সৎকাজ করবে তারা প্ৰবেশ করবে জান্নাতে, সেখানে তাদেরকে অপরিমিত জীবনোপকরণ দেয়া হবে।” (৪০:৪০)
গত আসরে আমরা বলেছি, দাম্ভিক ও অত্যাচারী শাসক ফেরাউন হযরত মূসা (আ.)কে হত্যা করে আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী হিসেবে আগমনকারী এই মহান ব্যক্তির হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে চেয়েছিল। তবে ফেরাউনের বংশেরই একজন মুমিন পারিষদ যিনি কিনা নিজের ঈমানের বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন তিনি হযরত মূসাকে রক্ষা করার জন্য সভাসদদের উদ্দেশে প্রজ্ঞাপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। ওই মুমিন ব্যক্তির বক্তব্য এতটা প্রভাব বিস্তার করে যে, ফেরাউন হযরত মূসা (আ.)কে হত্যার পরিকল্পনা স্থগিত রাখে। এরপর ফেরাউন তার উজিরকে সুউচ্চ টাওয়ার নির্মাণ করার নির্দেশ দেয় হযরত মূসার দাবি করা আল্লাহর সত্যতা নিজের চোখে দেখার জন্য। হযরত মূসা (আ.) যেখানে এই দাবি করেননি যে, অনেক উঁচুতে উঠলে আল্লাহকে দেখা যাবে সেখানে ফেরাউনের এই নির্দেশের উদ্দেশ্য ছিল নিছক জনগণকে ধোঁকা দেয়া।
কিন্তু জনগণ যাতে ফেরাউনের এই দাম্ভিক আচরণে ধোঁকা না খায় সেজন্য সেই মুমিন ব্যক্তি যে বক্তব্য দেন তা আজকের এই তিন আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি জনগণকে উদ্দেশ করে বলেন: সঠিক পথ হচ্ছে সেটা, যেটা আমি তোমাদের দেখাই। এ বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেন: এক, এই পার্থিব জীবনই মানুষের সব কিছু নয়। দুনিয়ার জীবন অতি সামান্য ভোগের বস্তু। প্রচণ্ড গতিতে এই জীবন শেষ হয়ে যাবে এবং প্রত্যেককে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। মৃত্যুর পর মানুষ যে জগতে প্রবেশ করবে তার কোনো শেষ নেই।
দ্বিতীয়ত, সেই চিরস্থায়ী জীবনে শুধুমাত্র পার্থিব জীবনে করা নেক কাজগুলোই মানুষের কাজে আসবে। পার্থিব জীবনে মানুষ যা কিছু করবে মৃত্যু পরবর্তী চিরস্থায়ী জীবনে তার পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া হবে। এই শাস্তি ও পুরস্কার দেয়ার ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে বিন্দুমাত্র পার্থক্য করা হবে না।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- মুমিন ব্যক্তি সব সময় অন্য মানুষকে হেদায়েত বা সৎপথ প্রদর্শনের চিন্তা করে এবং এই দায়িত্ব থেকে সে কখনো মুক্ত নয়।
২- মানুষের উচিত এই অস্থায়ী জীবনের সামান্য সময়ের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করা এবং বেশি বেশি নেক আমল করা যাতে পরকালীন জীবনে তার উত্তম প্রতিদান ভোগ করতে পারে।
৩- ঈমানহীন সৎকর্ম কিংবা সৎকর্মহীন ঈমান- এর কোনোটিই মানুষের মুক্তির জন্য যথেষ্ট নয়। পূর্ণাঙ্গ ঈমানের সঙ্গে যথেষ্ট নেক আমল থাকলে তবেই পারলৌকিক জীবনে মুক্তির আশা করা যায়।
এবারে সূরা মুমিন বা গাফিরের ৪১ ও ৪২ নম্বর আয়াতের দিকে দৃষ্টি দেব। দেখা যাক এই দুই আয়াাতে আল্লাহ তায়ালা কী বলেছেন:
وَيَا قَوْمِ مَا لِي أَدْعُوكُمْ إِلَى النَّجَاةِ وَتَدْعُونَنِي إِلَى النَّارِ (41) تَدْعُونَنِي لِأَكْفُرَ بِاللَّهِ وَأُشْرِكَ بِهِ مَا لَيْسَ لِي بِهِ عِلْمٌ وَأَنَا أَدْعُوكُمْ إِلَى الْعَزِيزِ الْغَفَّارِ (42)
“আর হে আমার সম্প্রদায়! এটা কি ধরনের কথা যে, আমি তোমাদেরকে ডাকছি (আগুন থেকে) মুক্তির দিকে, আর তোমরা আমাকে ডাকছ আগুনের দিকে?” (৪০:৪১)
“তোমরা আমাকে ডাকছ যাতে আমি অদ্বিতীয় আল্লাহর সাথে কুফরী করি এবং তার সাথে এমন কাউকে শরীক করি যার ব্যাপারে আমার কোন জ্ঞান নেই; আর (পক্ষান্তরে) আমি তোমাদেরকে ডাকছি পরাক্রমশালী ও অত্যন্ত ক্ষমাশীল (আল্লাহর) দিকে।" (৪০:৪২)
এই দুই আয়াত থেকে বোঝা যায়, ফেরাউনের জাতির ওই মুমিন পারিষদ নিজের ঈমানের বিষয়টি আর গোপন রাখতে পারেননি বরং শিরক ও তৌহিদের মধ্যকার পার্থক্যের বিষয়টি সবার সামনে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরতে বাধ্য হন। কাজেই যারা তাকে এসব কথা বলতে নিষেধ করেছিল তাদেরকে তিনি সাফ জানিয়ে দেন: তোমরা তোমাদেরই মতো একজন মানুষ ফেরাউনকে আল্লাহর স্থানে বসিয়ে দিয়ে ভেবেছো সে পৃথিবীর মালিক। অথচ বাস্তবে এই দুনিয়ার ওপর তার কোনো কর্তৃত্ব নেই। ফেরাউনকে সৃষ্টিকর্তা মনে করার পেছনে তোমাদের কাছে কোনো যুক্তি নেই বরং তোমরা নিছক অজ্ঞতা ও ধারণাবশত তাকে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে মেনে নিয়েছ।
তিনি আরো বলেন, তোমরা আমাকে অদ্বিতীয় আল্লাহকে প্রত্যাখ্যান করে এমন কারো ইবাদত করার আহ্বান জানাচ্ছো যার ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই। তোমরা আমাকে তোমাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস গ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানাচ্ছ। অথচ আমি জানি, শিরকমিশ্রিত বিশ্বাস ও আমলের প্রতিদান জাহান্নামের আগুন ছাড়া আর কিছু নয় এবং তোমরা নিজেদের পাশাপাশি আমাকেও জাহান্নামের অধিবাসী করতে চাও। ওই মুমিন ব্যক্তি আরো বলেন, তোমরা আমাকে যে পথে আহ্বান করছ তা অন্ধকার, বিপজ্জনক ও ভ্রান্ত পথ।
পক্ষান্তরে আমি তোমাদেরকে যে পথে ডাকি তা হচ্ছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট। এটি মহাপরাক্রমশালী এবং অত্যন্ত ক্ষমাশীল আল্লাহর পথ। তোমরা মানুষসহ অন্য যা কিছুর উপাসনা করছ সেসব বাদ দিয়ে আমি তোমাদেরকে একক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদত করার আহ্বান জানাচ্ছি। আমি তোমাদেরকে এমন সৃষ্টিকর্তার দাসত্ব মেনে নেয়ার কথা বলছি যার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে গোটা সৃষ্টিজগত এবং তিনি দয়ার আধার ও ক্ষমাশীল। বিশেষ করে, যারা ভ্রান্ত পথ বাদ দিয়ে তাঁর দিকে ফিরে আসে তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দেন।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- মানুষকে সৎপথে আহ্বানের ক্ষেত্রে নিজেকে অসহায় মনে করা যাবে না। দ্বিধাহীন চিত্তে উপযুক্ত দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করে মানুষের সামনে সত্য তুলে ধরতে হবে। ভ্রান্ত বিশ্বাসের অধিকারীরা যদি সংখ্যায় বিশাল জনগোষ্ঠীও হয় তবুও তাদের কথায় প্রভাবিত হওয়া যাবে না। সংখ্যায় দলভারী হওয়া সঠিক পথে থাকার মাণদণ্ড নয়।
২- একত্ববাদে বিশ্বাস ও নেক আমল হচ্ছে মানুষের মুক্তির একমাত্র উপায়।আর সৃষ্টিজগত পরিচালনায় অন্য কাউকে শরিক করলে দুনিয়া ও আখিরাতে মানুষ নানা ধরনের বিপদ-আপদের সম্মুখীন হয়।
আয়াত দু'টির আরো কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো:
৩- শিরকের পক্ষে কোনো যৌক্তিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক দলিল নেই। এটি অজ্ঞতা অথবা আত্মম্ভরিতা থেকে উৎসারিত। কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করা হচ্ছে এর আসল উদ্দেশ্য।
৪- আমাদের মনে রাখতে হবে আল্লাহ তায়ালা মহা প্রতাপশালী হওয়ার পাশাপাশি অনেক বড় দয়ালু। #
পার্সটুডে/এমএমআই/এআর/২৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।