ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (পর্ব-৬৮): ‘ফাও’ নামক উপত্যকা দখলের অভিযান
ওয়ালফাজর-৮ অভিযানের শুরুতেই ইরানি যোদ্ধাদেরকে ফাও শহরে পৌঁছানোর জন্য খরস্রোতা আরভান্দ নদী অতিক্রম করার প্রয়োজন দেখা দেয়।
কৌশলগত ইরাকের দুই বিখ্যাত নদী দজলা ও ফোরাত থেকে আরভান্দ নদীর উৎপত্তি এবং আরেকটি বড় নদী কারুনের পানিও এই নদীতে মিলিত হয়েছে। সবশেষে নদীটি আরভান্দ নামে পারস্য উপসাগরে পড়েছে। নদীটির সবচেয়ে সরু স্থানের প্রস্থ ৪০০ মিটার এবং সবচেয়ে প্রশস্ত স্থানের প্রস্থ এক হাজার ৬০০ মিটার। এছাড়া, নদীটির আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- জোয়ার ও ভাটার সময় এর পানির উচ্চতা অস্বাভাবিক রকম বাড়ে ও কমে।
আরভান্দ নদীর অপর তীরে অবস্থিত ‘ফাও’ বন্দরটি কৌশলগত ও সামরিক গুরুত্বের পাশাপাশি অর্থনৈতিক দিক দিয়েও ইরাকের সাদ্দাম সরকারের কাছে ছিল অতি মূল্যবান। এটির গুরুত্ব এত বেশি যে, মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে ফাও বন্দরকে ‘সাগরের বধূ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। খেজুরের বিশাল বিশাল বাগান ও বড় বড় তেল স্থাপনা এই শহরের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়া, এখানে আছে হেনা বা মেহেদি গাছের বাগান এবং লবনের ভাণ্ডার। এক কথায় ফাওকে খেজুর, লবন ও তেলের শহর বললেও অত্যুক্তি করা হবে না।
এদিকে, ইরাকের প্রতি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু দেশের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে যুদ্ধ শুরুর তুলনায় কয়েক বছর পর ইরাকের সামরিক শক্তি কয়েক গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল। মার্কিন সামরিক বিশেষজ্ঞ অ্যান্টনি কোর্ডসম্যানের রিপোর্ট অনুযায়ী, ইরাক ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে এক হাজার ৮০০ কোটি ডলার মূল্যের যুদ্ধাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম কিনেছিল। এই সামরিক বিশেষজ্ঞ জানান, ১৯৮৫ সালে ইরাকের নিয়মিত সেনা সংখ্যা ছিল সাত লাখ ৫০ হাজার এবং অনিয়মিত সেনা সংখ্যা ছিল আরো ছয় লাখ ৫০ হাজার।
কোর্ডসম্যান তার প্রতিবেদনে ১৯৮৫ সালে ইরাকের যুদ্ধাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামের বিবরণ তুলে ধরেন এভাবে: ট্যাংক চার হাজার ৮২০টি, সাঁজোয়া যান তিন হাজার ২০০টি, ভারী কামান তিন হাজারটি, বিমান বিধ্বংসী কামান কমপক্ষে ৪০০টি, ট্যাংক বহনকারী ভারী যানবাহন দুই হাজার, যুদ্ধবিমান ৫৮০টি এবং হেলিকপ্টার ৩৮০টি। যুদ্ধের এই ষষ্ঠ বছরে ইরাকের কাছে নিয়মিত পদাতিক সেনা ছিল ৫৫০ ব্যাটেলিয়ন। আর যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ব্যবহার করার জন্য আরো ৩০০ ব্যাটেলিয়ন অনিয়মিত সেনা প্রস্তুত ছিল। অথচ একই সময়ে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি যুদ্ধ করতে সক্ষম ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র মোট যোদ্ধা ছিল ৮০ ব্যাটেলিয়ন যাদের পক্ষে মাত্র সাত দিন টানা যুদ্ধ করার ক্ষমতা ছিল।
অবশেষে ১৯৮৫ সাল শেষ হওয়ার পর ১৯৮৬ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা ১০ মিনিটে ওয়ালফাজর-৮ অভিযান শুরু করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে এই অভিযানের জন্য প্রস্তুত যোদ্ধারা নির্দেশ পাওয়া মাত্র তাদের অগ্রাভিযান শুরু করেন। আগে থেকে ইরানের ডুবুরি ও কমান্ডোরা আরভান্দ নদী পার হয়ে শত্রু সেনাদের ঘাঁটিগুলোর কাছে ওঁৎ পেতেছিলেন। অভিযানের নির্দেশ পাওয়া মাত্র তারা শত্রুসেনাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহে আঘাত হানেন। তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল তারা যেন শত্রুদের এমনভাবে ব্যস্ত রাখেন যাতে গানবোটে করে ইরানি যোদ্ধারা সারারাত আরভান্দ নদী অতিক্রম করে সকাল নাগাদ বড় সংখ্যায় ফাও বন্দরে উপস্থিত হতে পারেন।
ইরান যখন রাতের অন্ধকারে এ অভিযান শুরু করে তখন মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ইরানি ডুবুরিদের কাজ অনেকটা সহজ করে দেয়। ইরাকি সেনারা ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে কোনোরকম প্রতিরোধের চেষ্টা না করে নিজেদের ঘাঁটি ছেড়ে পালাতে থাকে। অভিযান শুরুর ঘণ্টা দুয়েক পর ইরাকি সেনাদের বেতারযন্ত্রের কথোকপথন থেকে তাদের চরম দুরবস্থা ফুটে ওঠে। প্রত্যেক ইরাকি কমান্ডার তার নিয়ন্ত্রিত এলাকার দখল ধরে রাখতে অপারগতা প্রকাশ করে এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের সাহায্যে সৈন্য ও অস্ত্রসস্ত্র পাঠানোর আবেদন জানায়।
একজন ইরাকি অফিসার তার কমান্ডিং অফিসারকে জানায়: “শত্রু বাহিনী (অর্থাৎ ইরানি যোদ্ধারা) গানবোটে করে ঝড়ের গতিতে সেনা নামাচ্ছে এবং এসব গানবোট বারবার নদীর ওপার যাচ্ছে ও হাজার হাজার সেনা পার করে এপার নিয়ে আসছে। যদি এখনই আমাদের সাহায্য করা না হয় তাহলে তারা উম্মুল কাসর শহর পর্যন্ত দখল করে নেবে।” এ সময় তার কমান্ডিং অফিসার ইরাকি শাসক সাদ্দামের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর ওই অফিসারকে নির্দেশ দেয়: “নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করো। আমরা তিন ডিভিশন সশস্ত্র সেনা পাঠাচ্ছি।”
অভিযানের প্রথম দিন ইরাকি বাহিনীর কিছু বুঝে উঠতে উঠতেই সময়ে চলে যায়। ফলে তারা কোনো ধরনের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। ইরান কয়েকমাস ধরে এই অভিযানের প্রস্তুতি নিলেও অতি সতর্কতা অবলম্বন করায় এ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আগাম আভাস পায়নি আগ্রাসী ইরাকি বাহিনী। এ কারণে ইরানি যোদ্ধাদের হাতে বহু ইরাকি সেনা হতাহত হয়।
ইরানি যোদ্ধারা ইরাকের ফাও দ্বীপে ঢুকে পড়ায় এটির নিকটবর্তী বসরা নগরীতে বিপদঘণ্টা বেজে ওঠে। ইরাকের সাদ্দাম সরকার যেকোনো মুল্যে বসরা নগরীকে রক্ষা করার নির্দেশ দেয় যদিও এই অভিযানে বসরা দখল করার পরিকল্পনাই ইরানের ছিল না।
ইরাকি বাহিনী নিজেকে সামলে নেয়ার কারণে অভিযানের পরবর্তী কয়েক দিন দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল লড়াই হয়। ‘খোরআব্দুল্লাহ’ ও ‘কারখানা-ই-নামাক’ এলাকায় সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইরাকি বাহিনী তাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ঠিকমতো গড়ে তুলতে পারেনি এবং ইরানি যোদ্ধাদের হাতে ফাও দ্বীপের পতন হয়। এরপর প্রায় দুই মাস ধরে ইরাকি বাহিনী ফাও দ্বীপে অবস্থান গ্রহণকারী ইরানি যোদ্ধাদের অবস্থানে ব্যাপক বোমা হামলা ও কামানের গোলাবর্ষণ চালিয়ে যায়। এরপর তারা হতাশ হয়ে যায় এবং পরিস্থিতির ওপর ইরানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
ওয়ালফাজর-৮ অভিযানে ইরাকের প্রায় ৮০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ইরানের নিয়ন্ত্রণে আসে এবং শত্রুসেনাদের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। অভিযানে ইরাকি বাহিনীর হতাহত ও বন্দি সেনাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫২ হাজার। নিহত ইরাকি সেনাদের মধ্যে ছিল একজন মেজর জেনারেল ও পাঁচজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। ওই অভিযানে ইরাকি বাহিনীর ৭৪টি যুদ্ধবিমান, ১১টি হেলিকপ্টার, ৬০০টি ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান, ৫০০টি সামরিক গাড়ি, ২০টি ফিল্ড কামান, ৫৫টি বিমান বিধ্বংসী কামান, ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপে সক্ষম দু’টি গানবোটসহ আরো বহু সমরাস্ত্র ধ্বংস হয়। সেইসঙ্গে বিপুল পরিমাণু অস্ত্রসস্ত্র ও গোলাবারুদ ইরানি যোদ্ধাদের হস্তগত হয়। #
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ৩০
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।