জুন ০৭, ২০২১ ১৮:১৫ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা গাফির বা মু'মিনের ৪৩ নম্বর থেকে ৪৭ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৪৩ থেকে ৪৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

لَا جَرَمَ أَنَّمَا تَدْعُونَنِي إِلَيْهِ لَيْسَ لَهُ دَعْوَةٌ فِي الدُّنْيَا وَلَا فِي الْآَخِرَةِ وَأَنَّ مَرَدَّنَا إِلَى اللَّهِ وَأَنَّ الْمُسْرِفِينَ هُمْ أَصْحَابُ النَّارِ (43) فَسَتَذْكُرُونَ مَا أَقُولُ لَكُمْ وَأُفَوِّضُ أَمْرِي إِلَى اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ (44)

“নিশ্চয়ই তোমরা আমাকে এমন একজনের প্রতি আহ্বান করছ, যে ইহলোক ও পরলোকে কোথাও আহবান-যোগ্য নয়। বস্তুতঃ আমাদের প্রত্যাবর্তন তো আল্লাহর দিকে এবং অবশ্যই অপব্যয়কারী বা সীমালংঘনকারীরাই জাহান্নামের অধিবাসী।”(৪০:৪৩)

“সুতরাং, আমি তোমাদেরকে যা বলছি, তোমরা অচিরেই তা স্মরণ করবে এবং আমি আমার ব্যাপারে (সিদ্ধান্ত) আল্লাহর হাতে ন্যস্ত করছি। নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর বান্দাদের (অবস্থার) প্রতি সবিশেষ দৃষ্টি রাখেন।”(৪০:৪৪)

গত আসরে আমরা বলেছি যে, ফেরাউনের দরবারের মুমিন ব্যক্তি তার ঈমানের বিষয়টি আর গোপন না রেখে প্রকাশ্যে শিরক, তৌহিদ এবং এসবের পরিণতি বর্ণনা করতে থাকেন। এই আয়াতে তার পরবর্তী বক্তব্য তুলে ধরতে গিয়ে বলা হয়েছে: তোমরা আমাকে অদ্বিতীয় আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমাদের মূর্তিগুলোর পূজা করার আহ্বান জানাচ্ছ। অথচ এই প্রাণহীন মূর্তিগুলোর দুনিয়াতে যেমন কিছু করার ক্ষমতা নেই তেমনি আখেরাতেও নয়। এগুলো যেমন কথা বলতে পারে না তেমনি মানুষের কোনো সমস্যারও সমাধান তাদের দ্বারা সম্ভব নয়। অথচ আমাদেরকে একদিন আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে এবং তাঁর কাছে জবাবদিহী করতে হবে।

স্বাভাবিকভাবেই কেউ যদি আল্লাহর প্রতি ঈমান না এনে মূর্তিপূজা করে তাহলে কিয়ামতের দিন তার স্থান হবে জাহান্নাম। কারণ, সে ভ্রান্ত পথ অনুসরণ এবং সীমালঙ্ঘন করেছে। ঈমানদার ব্যক্তি আরো বলেন, হে লোকসকল! আমি স্পষ্ট ভাষায় তোমাদেরকে জানিয়ে দিতে চাই: আমি আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি এবং আমার ফয়সালা তাঁর হাতে ন্যস্ত করেছি; এখন তোমাদের ক্ষমতার দম্ভ ও হুমকি আমার মধ্যে বিন্দুমাত্র ভীতি সৃষ্টি করতে পারবে না। কারণ আমি যার কাছে নিজেকে সমর্পন করেছি তিনি অসীম ক্ষমতার মালিক এবং তিনি তাঁর প্রতিটি বান্দার অবস্থা সম্পর্কে সম্যক অবহিত। 

তোমাদের জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে এই কারণে যে, তোমরা আল্লাহর শাস্তি পাওয়ার বিষয়ে আমার হুঁশিয়ারি উপলব্ধি করেও তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করছ না। মনে রেখো, কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে আর এ দুনিয়ায় ফিরতে দেয়া হবে না।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- উপযুক্ত দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে আমাদেরকে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে এবং গয়রুল্লাহ বা আল্লাহ ছাড়া অন্য সব কিছুকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।

২- শুধু সম্পদের ক্ষেত্রে অপচয়ের নীতি মেনে চলা যথেষ্ট নয়। আমাদের মেধা ও সময় ভ্রান্ত পথে ব্যয় করলে সেটিও অপচয় হিসেবে গণ্য হবে এবং এরজন্য জবাবদিহী করতে হবে। কাজেই জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের মেধা সঠিক পথে কাজে লাগানো অত্যন্ত জরুরি। কোনো অবস্থাতেই বেহুদা কাজে যেন সময় ব্যয় না হয়।

সূরা গাফিরের ৪৫ ও ৪৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

فَوَقَاهُ اللَّهُ سَيِّئَاتِ مَا مَكَرُوا وَحَاقَ بِآَلِ فِرْعَوْنَ سُوءُ الْعَذَابِ (45) النَّارُ يُعْرَضُونَ عَلَيْهَا غُدُوًّا وَعَشِيًّا وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ أَدْخِلُوا آَلَ فِرْعَوْنَ أَشَدَّ الْعَذَابِ (46)

“অতঃপর আল্লাহ তাকে ওদের ষড়যন্ত্রের অনিষ্ট হতে রক্ষা করলেন এবং কঠিন শাস্তি ফেরাউন সম্প্রদায়কে গ্রাস করল।”(৪০:৪৫)

“আগুন, তাদেরকে তাতে উপস্থিত করা হয় সকাল ও সন্ধ্যায় এবং যেদিন কিয়ামত ঘটবে (সেদিন বলা হবে), ফিরআউন গোষ্ঠীকে নিক্ষেপ কর কঠোরতম শাস্তিতে।”(৪০:৪৬)

ফেরাউন সম্প্রদায়ের কঠোর হুমকি ও ষড়যন্ত্র থেকে ওই মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করলে আল্লাহ তায়ালা তাকে ওই নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করেন। তিনি তাকে ঈমান ও তৌহিদের পথে দৃঢ় মনোবল করে দেন। পক্ষান্তরে ফেরাউন সম্প্রদায়কে নবীর সঙ্গে বেয়াদবি ও সত্য প্রত্যাখ্যান করার অপরাধে কঠোর শাস্তি দেন।

এই আয়াতে সেই শাস্তির ধরন বর্ণনা করা না হলেও কুরআনের অন্যত্র একাধিক আয়াতে বলা হয়েছে, হযরত মূসা (আ.) ও বনি ইসরাইল জাতি নিরাপদে নীল নদ পার হয়ে গেলেও ওই নদে ফেরাউন ও তার পথভ্রষ্ট সহযোগীদের সলিল সমাধি হয়।  এসব খোদাদ্রোহী বর্তমানে বারযাখি জীবনে শাস্তি ভোগ করছে এবং তাদেরকে সকাল ও সন্ধ্যায় আগুনের সামনে হাজির করা হয়।  তবে তাদের জন্য আরো কঠিন যে শাস্তি অপেক্ষা করছে তা হলো কিয়ামত দিবসের শাস্তি।

কুরআনে কারিমের আয়াত অনুযায়ী মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত মানুষ বারযাখি জীবনে অবস্থান করে। এই সময়ে জান্নাতি ও জাহান্নামি মানুষেরা তাদের পারলৌকিক জীবনের কিছু পুরস্কার ও শাস্তি পেতে থাকে। মুমিন ব্যক্তিদের জন্য বারযাখ হচ্ছে জান্নাতের দরজাস্বরূপ; অন্যদিকে পাপাচারীদের জন্য বারযাখি জীবন জাহান্নামের আগুন ছাড়া আর কিছু নয়।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:

১- আমরা যদি আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ নির্ভর করতে পারি তাহলে তিনি আমাদেরকে ভয়ঙ্কর শত্রুদের হাত থেকেও রক্ষা করবেন। একইসঙ্গে সেই ভয়ঙ্কর শত্রুকে দুর্বল ও প্রয়োজনে ধ্বংস করে দেবেন।

২- জালিমদের শাস্তি মৃত্যুর মুহূর্তে থেকেই শুরু হয়ে যায়; তবে কিয়ামতের দিন তারা চূড়ান্ত শাস্তি প্রাপ্ত হবে।

সূরা গাফিরের ৪৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:

 وَإِذْ يَتَحَاجُّونَ فِي النَّارِ فَيَقُولُ الضُّعَفَاءُ لِلَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا إِنَّا كُنَّا لَكُمْ تَبَعًا فَهَلْ أَنْتُمْ مُغْنُونَ عَنَّا نَصِيبًا مِنَ النَّارِ (47)

“আর যখন (জাহান্নামিরা) দোযখে পরস্পর বিতর্কে লিপ্ত হবে, তখন যারা অহংকার করেছিল তাদেরকে দুর্বলেরা বলবে: আমরা তো তোমাদের অনুসরণ করেছিলাম সুতরাং তোমরা কি এখন আমাদের থেকে (জাহান্নামের) আগুনের কিছু অংশ গ্ৰহণ করবে?”(৪০:৪৭)

এই আয়াতে জাহান্নামে প্রবেশের পর সেখানকার অধিবাসীদের মধ্যে তুমুল বিতর্ক লেগে যাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।  বলা হচ্ছে: সেখানে প্রত্যেকে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করবে। অথচ মহান আল্লাহ সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে সেখানে পুরস্কার ও শাস্তি দেবেন এবং কেউ বিনা দোষে জাহান্নামে যাবে না।

তবে পৃথিবীতে যারা বিচারবুদ্ধিকে কাজে না লাগিয়ে অন্ধভাবে পথভ্রষ্ট ব্যক্তিদের অনুসরণ করার কারণে জাহান্নামি হয়েছে তারা অন্তত এতটুকু আশা করতেই পারে যে, যারা তাদের জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হয়েছে তারা তাদের শাস্তির কিছু অংশ কমিয়ে দিক।  অথচ সেদিন সেসব অহংকারী ও পাপাচারী নেতারা এতটা শাস্তির মধ্যে নিমজ্জিত থাকবে যে, অপরকে রক্ষা করা দূরে থাক নিজেদের বাঁচানোরই পথ খুঁজে পাবে না।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:

১- জাহান্নামবাসী পরস্পরকে চিনতে পারবে এবং পার্থিব জীবনের সব ঘটনা তাদের মনে পড়বে।

২- পার্থিব জীবনের বন্ধুত্ব যদি আল্লাহর জন্য না হয় তাহলে কিয়ামতের দিন ওই বন্ধুত্ব শত্রুতায় পরিণত হবে।

৩- দুনিয়ার জীবনে যত কষ্টেই থাকি না কেন জালেমদের অন্ধ অনুকরণ করা যাবে না। যাকে অনুসরণ করব কিয়ামতের দিন তার কি পরিণতি হতে পারে তা যেন আমরা আগে বিবেচনা করি।#

পার্সটুডে/এমএমআই/এআর/৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।