জুন ১৫, ২০২১ ১৯:১২ Asia/Dhaka

আপনারা নিশ্চয়ই জানেন ইরান প্রাচীন সভ্যতার একটি দেশ। সুতরাং এ দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি যে বেশ সমৃদ্ধ তা তো বলারই অপেক্ষা রাখে না।

শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে বিশ্ব সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর সাহিত্য সংস্কৃতির নেপথ্য প্রেরণা ছিল ইরানের সাহিত্য।                                                                                                              

যাই হোক আজকের আসরে আমরা শুনবো সাদি'র চিরায়ত একটি গল্প। বোস্তাঁ থেকে নেওয়া এই গল্পটি বেশ রহস্যঘেরা। রহস্য আসলে ততক্ষণই রহস্যময় যতক্ষণ তা থাকে গোপন। গোপনীয়তা প্রকাশিত হয়ে গেলে আর রহস্যের কোনো গুরুত্ব থাকে না।  

প্রাচীনকালে বেশ শক্তিশালী একজন শাসক ছিল। ওই শাসক মনে মনে একটা গভীর রহস্য লালন করতো। এতো বিশাল রহস্য যে সে ছাড়া আর কেউই ওই রহস্য সম্পর্কে কিছুই জানতো না। কিন্তু শাসকের ভালো লাগছিল না। সে চাইতো কোনো বিশ্বস্ত মানুষের কাছে তার রহস্যের কথাটা প্রকাশ করে একটু হালকা হতে। কিন্তু তেমন কাউকেই সে খুঁজে পাচ্ছিল না। যখনই সে তার নিকটজন মাহরামদের কারো কাছে রহস্যটা বলতে চাইতো, উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তো। কেননা শাসক জানতো যে জনগণ যদি ওই রহস্যের ব্যাপারে জানতে পারে তাহলে তার মান-সম্মান শিকেয় উঠবে। তার যে গ্রহণযোগ্যতা ও মান-সম্মান জনগণের কাছে তা নড়বড়ে ও ভঙ্গুর হয়ে যাবে। কিন্তু রহস্যের কথা কতো আর পুষে রাখা যায়! বুদবুদের মতো সে বেরিয়ে যেতেই চায়।

এমনি একদিন শাসকের মনের পুকুরের তলদেশ থেকে রহস্যের বুদবুদ বেরিয়ে এলো। সে তার নিকটজনদের মধ্য থেকে যাদের গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বস্ত মনে করতো তাদের কজনকে ডেকে বললো: তোমরা তো আমার একান্ত আপনজন! তোমাদের ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস এবং আস্থা আছে। সে কারণেই আমি চাচ্ছি তোমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় তুলে ধরবো। তবে শর্ত হলো এই বিষয়টা নিয়ে তোমরা কারও সঙ্গে আলাপ করতে পারবে না। এমনকি তোমাদের এবং আমার পরিবারের সবচেয়ে কাছের মানুষটির সঙ্গেও এ বিষয়টি নিয়ে আলাপ করতে পারবে না। কথা দাও! রহস্যটা আমৃত্যু তোমাদের অন্তরেই পুষে রাখবে, ফাঁস করবে না।

শাসকের শর্তের কথা শুনে তাঁর স্বজনদের একজন উঠে বললো: আপনি আমাদের বিশ্বাস করতে পারেন। যা বলার নিশ্চিন্তে বলতে পারেন। আমরা কাউকে কিছু বলবো না। আপনার জন্য আমরা প্রাণ দিতে পারি, রহস্য তো ছাই! শাসক বললো: রহস্যের কথাটা আমি তোমাদের বলে লালন করার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চাই। কিন্তু যদি শুনি তোমরা ফাঁস করেছো তাহলে কিন্তু হত্যা করা হবে, কোনোরকম ছাড় দেওয়া হবে না। স্বজনেরা সবাই কথা দিলো, পরম নিকটজনের কাছেও ফাঁস করবে না। কিন্তু লক্ষ্য করা গেল: যে রহস্যটি শাসক একটি বছর নিজের মনের মণিকোঠায় পুষে রেখেছিল, তা তার পুরো রাজ্যের সকল জনগণের কাছে নিমেষেই পৌঁছে গেল।

শাসকের রহস্যের কথা এখন সবার মুখে মুখে। শাসক বুঝতে পারলো যে তার নিকটজনেরা তার সঙ্গে খেয়ানত করেছে, এক বছর তো দূরের কথা একটি দিনও তারা নিজেদের মাঝে রহস্যের কথা ধরে রাখতে পারে নি। সুতরাং কথাভঙ্গের দায়ে স্বজনদের সবাইকে জল্লাদের হাতে ন্যাস্ত করার আদেশ দিলো। স্বজনরা এবার কান্নাকাটি শুরু করে দিলো এবং শাসকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে শুরু করলো। একজন বললো: শয়তানের প্ররোচনায় আমরা ভুল করে ফেলেছি আমাদের ক্ষমা করে দাও! এরকম ভুল আর হবে না। শাসক বললো: চুপ করো! তোমরা শাস্তির কথা জেনেও কথা রাখো নি! তোমাদের কথায় আর বিশ্বাস রাখা যায় না। তোমাদের শাস্তি অবশ্যাম্ভাবী। ওই শাস্তি থেকে অন্যরাও শিক্ষা নেবে। এই বলে জল্লাদের দিকে তাকালো এবং আদেশ দিলো সবাইকে হত্যা করার।

জল্লাদ তার কাজে এগিয়ে যাচ্ছিলো। হঠাৎ এক বৃদ্ধ ওই স্বজন সমাবেশ থেকে শাসকের অনুমতি নিয়ে কিছু বলতে চাইলো। অনুমতি পেয়ে সে বললো: কেন তুমি আমাদের হত্যা করতে চাও! তুমি তো নিজেও একই অপরাধে অপরাধী। শাসক ভ্রু কুঁচকে বৃদ্ধকে বললো: কী বললে! আমিও অপরাধী? আমি কী অপরাধ করেছি? তোমরাই তো অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছো। বৃদ্ধ বললো: হে মহান শাসক! তোমার অন্তর ছিল ওই রহস্যের ঝরনার উৎসমুখ। তুমি তার মুখ বন্ধ করো নি। নিজের সঙ্গে যে অঙ্গিকার তুমি করেছো তা ভঙ্গ করে অনেকের কাছে রহস্য প্রকাশ করে দিয়েছো। ওই ঝরনা তাই নদীতে পরিণত হয়েছে এবং নদীও পরিণত হয়েছে বন্যায়। এখন এই বন্যাধারার গতি তুমি কী করে রোধ করবে?

শাসক বললো: কিন্তু আমি তো তোমাদের বিশ্বাস করেছিলাম। তোমরা আমার সবচে কাছের মানুষ ছিলে। তোমরা যে এরকম খেয়ানত করবে তা তো ভাবতেও পারি নি আমি। বৃদ্ধ বললো: "প্রিয় শাসক! ধন সম্পদ রাখতে হয় ধন-ভাণ্ডারে! আর রহস্য পুষে রাখতে হয় একান্তই নিজের কাছে। কথা যতক্ষণ পর্যন্ত না জিহ্বায় উচআরিত হয় ততক্ষণ তা মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু মুখ থেকে একবার বেরিয়ে গেলে তা আর বক্তার নিয়ন্ত্রণে থাকে না"। শাসক এবার অপলক হয়ে ভাবতে লাগলো। বুঝলো ওই বৃদ্ধ যথার্থই বলেছে। সুতরাং যে রহস্য সে নিজের মাঝে নিজেই রাখতে পারলো না অন্যদের কাছে তা প্রত্যাশা করার সুযোগ কই! এরপর বললো: হুমম এই জ্ঞানী বৃদ্ধ যথার্থ বলেছে। আমিই রহস্যের কথা তোমাদের বলে অন্যায় করেছি। ভুল আমারই। তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম। তবে এখন থেকে তোমরা আর আমার নিকটজন নও! কেবল ওই জ্ঞানী বৃদ্ধই আমার কাছে থাকবে। কেননা সে আমার দৃষ্টি খুলে দিয়েছে।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ১৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।