জুন ১৫, ২০২১ ১৮:৩০ Asia/Dhaka

ফার্স প্রদেশের কেন্দ্রিয় শহর হলো শিরাজ। দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় ইরানের ঐতিহাসিক এই প্রদেশে দেখার মতো বহু নিদর্শন রয়েছে।

আমরা ধীরে ধীরে এইসব নিদর্শনের সঙ্গে পরিচিত হবার চেষ্টা করবো। শিরাজ প্রদেশের নাম উচ্চারিত হলেই মনের কোণে ভেসে ওঠে দুই কবির নাম। জগদ্বিখ্যাত এই দুই কবি হলেন হাফিজ এবং সাদি। এঁদের সুবাদেই শিরাজ হয়ে উঠেছে কবির শহর, কবিতার শহর। শিরাজ তাই শিল্প আর সংস্কৃতির শহরও। কবিরা শুয়ে আছেন যেন প্রেমের মৌচাক খুলে রেখে। আর ভক্ত মৌমাছির দল প্রতিদিন প্রেমের টানে এখানে এসে হাজির হয়।

কবি হাফিজের সমাধিস্তম্ভটি শিরাজের কেন্দ্রীয় শহরের কাছেই অবস্থিত। এই সমাধিস্তম্ভটি তৈরী হয় ১৯৫৩ সালে । একটি বাগানের ভেতরে খোলা প্যাভেলিয়নে তাঁর সমাধিস্তম্ভটি চমৎকার করে বানানো হয়েছে। মূল স্তম্ভটি মার্বেল পাথরের তৈরী। বৃত্তাকার পাঁচটি সিঁড়ির পাটাতনের উপর আটটি গোলাকার থাম। থামের মাথায় সবুজ রঙের একটি গম্বুজ বসানো । দূর থেকে গম্বুজটিকে মাথায় বাঁধা পাগড়ির মতো মনে হয়। গম্বুজের নীচে পাটাতনের ঠিক মাঝখানে কবি শুয়ে আছেন। তাঁর ছোট্ট কবরটি চমৎকারভাবে সেখানে শোভা পাচ্ছে। গম্বুজের ভেতরের অংশে কবির অসংখ্য কবিতার পংক্তি লেখা রয়েছে। এইসব পংক্তি ভক্তদের মনে কবির অনেক স্মৃতি জাগিয়ে তোলে। এর পাশেই ঐতিহ্যবাহী একটি চায়ের দোকান। দোকানটির একটা সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। আধুনিক রেস্টুরেন্টের মতো এসব দোকানে চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থা নেই।

তার পরিবর্তে আছে কাঠের খাট। খাটের উপর ইরানের ঐতিহ্যবাহী কার্পেট বিছানো। আর খাটে হেলান দিয়ে আরাম করে বসার জন্যে রয়েছে মখমলের কুশন বা বালিশ, অনেকে অবশ্য একে তাকিয়াও বলে। আপনি ঐ তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে উদাস হয়ে আওড়াতে পারেন হাফিজের কাব্যপংক্তি। হারিয়ে যেতে পারেন এমন কোথাও, যেখানে আপনার নিজস্ব পৃথিবীতে একমাত্র রাজা আপনি। আপনার নিজস্ব সাম্রাজ্যে সবকিছুই আপনার মনের মতো করে সাজানো। সবুজের সমারোহে ঘেরা এই নিবিড় পরিবেশে পৃথিবীর এক মহান কবির সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে আপনি। প্রেমিক কবি হাফিজের অমর কাব্যের আন্তরিক গুঞ্জনে এখানকার পরিবেশের প্রতিটি রন্ধ্র যেন ভরে আছে, যেই কবি তাঁর প্রিয়ার গালের একটি তিলের জন্যে সমরকন্দ ও বোখারা রাজ্য হেলায় বিলিয়ে দিতে পারতেন।

হাফিজের কবিতা আওড়ানোর কথা বলছিলাম। আহা ! ভাবতেই নিজের ভেতরেও যেন কাব্যভাব এসে যায়। হাফিজের খোদাপ্রেমের কাব্য বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এই বিশ্ববিশ্রুত সর্বজনপ্রিয় কবি হাফিজের জন্ম হয়েছিল এই শিরাজেই । ১৩০০ খৃস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আর ১৩৮৮ খৃস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন । কোনো বাংলাভাষী পর্যটক যদি কবি হাফিজের সমাধিস্তম্ভের কাছে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের পুরোণো একটি পাতার উপর মনযোগ দেন, তাহলে নিশ্চয়ই তাঁর মনটা গর্বে ফুলে উঠবে। তাহলো কবি হাফিজ একবার বাংলাদেশে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দীন তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

ঘটনাটা হলো- সুলতান গিয়াস উদ্দীন অসুস্থ হয়ে পড়ার পর তিনি তাঁর তিন বাঁদীকে তাঁর লাশ ধোয়ার কথা বলেছিলেন। এই তিন বাঁদীর নাম ছিল সার্ব, গুল এবং লালা। তো একথা ফাঁস হয়ে যাবার পর অন্য বাঁদীরা এই তিনজনকে বিদ্রুপ করতে শুরু করলো। একথা সুলতানের কানে পৌঁছলে সুলতান আবেগভরে কবিতার একটি চরণ উচ্চারণ করলেন। চরণটি হলো- 'সাকী ! হাদীসে সার্বো ,গুলো ,লালা মিরাভা'দ' এটুকু বলে আর কিছুতেই তিনি দ্বিতীয় চরণ আর মেলাতে পারলেন না। তাই সভাকবিদের ডাকলেন। কিন্তু তারাও সুলতানের মনমতো কোনো চরণ মেলাতে পারলেন না। অবশেষে সুলতান পংক্তিটি শিরাজে কবি হাফিজের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। কবি হাফিজ এই পদের উপর একটি গজল লিখে ফেললেন।

হাফিজের লেখা গজলের কথা বলছিলাম। তিনি দুটি চরণে লিখলেন-শেকার শেকান শাওয়ান্দ, হামে তুতিয়া'নে হেন্দ। যি'ন কান্দে পারসী বে বাংলা' মি রাভাদ'। অর্থাৎ আজ পারস্যের যে চিনি অর্থাৎ গজল বাংলায় যাচেছ, তা গ্রহণ করে তৎকালীন হিন্দুস্তানের পাখিরাও অর্থাৎ কবি সাহিত্যিকরাও মিষ্টি বিতরণ করবে। এর মানে হলো হাফিজের কবিতার ব্যাপক প্রভাব একদিন বাংলা কাব্যের উপরে পড়বে। কবি হাফিজের এই ভবিষ্যৎবাণী সত্যিই অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর কবিতার অনুপ্রেরণায় বাংলা সাহিত্যে একটা নতুন যুগেরই সূচিত হয়। যাই হোক, সুলতান এই কবিতা পেয়ে ভীষণ খুশী হলেন এবং হাফিজকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর আর বাংলাদেশে যাওয়া হলোনা।

এই ঘটনা থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হলো-রাজদরবারে কবি হাফিজের মর্যাদা অসম্ভব উচ্চ ও সম্মানজনক ছিল। কবি হাফিজ তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় এই শিরাজেই ব্যয় করেছেন। এই শিরাজেই আবার সমাধিস্থ হয়েছেন তিনি। তিনি ছিলেন গজল তথা মরমী কাব্যের অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ কবি। বিশ্বজুড়ে তাঁর অধ্যাত্ম চেতনাময় কবিতার তুলনা মেলা ভার। এই কবি এখন শুয়ে আছেন তাঁর প্রিয় মাতৃভূমি শিরাজে। নিবে যাওয়া এই প্রদীপ আজো এক অলৌকিক আলোয় সমগ্র বিশ্বকে আলোকিত করে রেখেছেন। সে আলোর উৎসভূমি এই শিরাজে কবিমন উড়াল দেবে- তাতে আর বিচিত্র কী ! এখানে এসে কবিগণ তাঁদের হৃদয়ের তৃষ্ণা মেটান এক অলৌকিক সুধারসে। কেবল কবি - সাহিত্যিকই নন, আধ্যাত্মিকতার আলোয় যারা পথ চলতে চায়, তারাও এখানে এসে ভীড় জমায়। #

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ