জুন ১৫, ২০২১ ১৯:৩১ Asia/Dhaka

ইরানি যোদ্ধারা ফাও দ্বীপ দখল করার ফলে পারস্য উপসাগরের সঙ্গে ইরাকের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অবশ্য অভিযান শুরু করার পর থেকে ফাও উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি গ্রহণ করা পর্যন্ত ৭০ দিন সময় লেগে যায়।

ইরাক-ইরান আট বছরের যুদ্ধে এই অভিযান ছিল সবচেয়ে বেশি দীর্ঘ ও শ্বাসরুদ্ধকর। ইরানি যোদ্ধারা ফাও উপত্যকায় নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার এক সপ্তাহ পর ইরাকিরা ধীরে ধীরে এই উপত্যকা পুনরুদ্ধারের আশা হারাতে থাকে। তারা বাগদাদের কাছে ইরানের সাফল্যের নানারকম ব্যাখ্যা তুলে ধরার চেষ্টা করে। এ সম্পর্কে এক ইরাকি সেনা কর্মকর্তা বলেন, যুদ্ধক্ষেত্রের বেশিরভাগ এলাকা জলাভূমিবেষ্টিত বলে আমরা আমাদের সাঁজোয়া বাহিনী, এমনকি পদাতিক বাহিনীকেও ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারিনি। এছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে ভারী যুদ্ধাস্ত্র বহন করে নিয়ে যাওয়াও আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।

ইরাকের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী আদনান খায়রুল্লাহ বলেন, ইরানিদের কাছ থেকে ফাও উপত্যকা পুনরুদ্ধার অত্যন্ত কঠিন। বড় বড় জলাশয় এবং অসংখ্য লবণ হ্রদের কারণে সেখানে অভিযান চালানো ইরাকি সেনাদের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া, ইরাকের সপ্তম পদাতিক ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল মাহের আব্দুর রশিদ বলেন, ফাও দখলের অভিযানে ইরান অভিনব রণকৌশল ব্যবহার করেছে। তারা জলাভূমি ও কাদামাটিতে প্রচণ্ড বৃষ্টিপাতের মধ্যে অভিযান চালিয়েছে যা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। খুব শিগগিরই ইরানের কাছ থেকে এই অঞ্চল পুনরুদ্ধার করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।

ইরাকি কমান্ডারদের ভাষ্য অনুযায়ী, ওয়ালফাজর-৮ অভিযানে ইরানের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ ছিল খরস্রোতা আরভান্দ নদী পার হওয়া। ইরানি যোদ্ধারা প্রথমে ছোট ছোট গানবোট ও স্পিডবোটের সাহায্যে তাদের কমান্ডো সেনা ও হালকা অস্ত্রসস্ত্র পার করেন। কিন্তু প্রাথমিক অভিযানে সাফল্য লাভের পর হাজার হাজার যোদ্ধাকে পার করার জন্য এই নদীর উপর সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এছাড়া, ট্যাংক, সাঁজোয়ান যান ও ভারী সামরিক বাহন নদীর ওপারে নেয়ার জন্য সেতু নির্মাণের কোনো বিকল্প ছিল না। কাজেই এই সেতু নির্মাণের দায়িত্ব পড়ে ইরানের ‘জিহাদে সজান্দেগি’ সংস্থার ওপর। এই সংস্থার প্রকৌশলিরা ৫৬ ইঞ্জি ব্যাসের প্রায় তিন হাজার ৪০০ তেল পাইপ ব্যবহার করে বিশেষ কৌশলে একটি সুদৃঢ় সেতু নির্মাণ করেন।

বে’সাত নামের এই সেতুর দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ৬০০ মিটার, প্রস্থ ১২ মিটার এবং গভীরতা ছিল প্রায় ৮ মিটার।  এই সেতুর নকশা তৈরি ও নির্মাণকাজ তদারকি করেন ইঞ্জিনিয়ার বেহরুজ পুরশারিফি। পরবর্তীকালে এই বীর যোদ্ধা ১৯৯৬ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। ফাও দখলের অভিযান শুরুর প্রায় তিন মাস পর ১৯৮৬ সালের ৩১ মে বে’সাত সেতুটি নির্মাণের কাজ শুরু হয়। সেতুটি নির্মাণের সময় ইরানি যোদ্ধাদেরকে নদীর জোয়ার-ভাটার স্রোত, ঝড়ো হাওয়ার ঢেউ এবং ইরাকি বাহিনীর কামানের গোলা ও বিমান হামলার মতো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়।

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে মাত্র ছয় মাসের মধ্যে সেতুটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয় এবং ১৯৮৬ সালের ৭ অক্টোবর সেতুটির উপর দিয়ে ভারী যানবাহন পারাপার করার কাজ শুরু হয়। সেতুটি নির্মাণের কাজে যেসব তেলের পাইপ ব্যবহার করা হয় তা দিয়ে প্রায় ৮০ কিলোমিটার লম্বা পাইপ স্থাপন করা সম্ভব হতো। আর এসব তেলের পাইপ ইরাকের কাছ থেকে গনিমতের মাল হিসেবে সংগ্রহ করা হয়েছিল। ইরানের স্থলভাগের সঙ্গে ইরাকের স্থলভাগের সংযোগ স্থাপন করে ভারী যান পারাপার করার ক্ষেত্রে এই সেতু নির্মাণ ছিল সামরিক প্রকৌশলবিদ্যায় ইরানের বিশাল এক সাফল্য।

ওয়ালফাজর-৮ অভিযানের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধক্ষেত্রে এমন একটি সাফল্য লাভ করা যা ব্যবহার করে ইরানের রাজনৈতিক নেতারা যুদ্ধ বন্ধের আলোচনায় শক্তিমত্তার অবস্থানে থেকে কথা বলতে পারেন। ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনীর নির্দেশ ছিল, এই যুদ্ধ শুরু করার জন্য কে দায়ী তা কঠোরভাবে চিহ্নিত করা যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো প্রতিবেশী দেশ ইরানে আগ্রাসন চালানোর সাহস না দেখায়। কাজেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের পাশাপাশি ইরানের জনগণও ফাও দখলের মতো একটি বড় সাফল্যের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এছাড়া, পরপর কয়েকটি অভিযানে ব্যর্থতার পর ইরানি যোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা করার জন্যও এমন একটি বড় সফল অভিযানের প্রয়োজন তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছিল।

ইরাকের ফাও উপত্যকা দখল করে ইরান দেখিয়ে দিয়েছে, এই যুদ্ধে ইরানের বিজয় অবশ্যম্ভাবী এবং যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হবে তত বেশি ইরানের সুবিধা হবে। এছাড়া এই সাফল্য সামরিক উপায়ে যুদ্ধের অবসান ঘটানোর ব্যাপারে ইরানকে আশাবাদী করে তোলে। ফাও দখলের এই অভিযানে কামান ও ভারী ট্যাংকের গোলাবর্ষণ দু’পক্ষের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং অভিযানের প্রথম কয়েকদিন উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপকভাবে গোলা বিনিময় হয়। এই যুদ্ধে ইরাক শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। আরভান্দ নদী পেরিয়ে এত বড় একটি অভিযানে ইরান সাফল্য লাভ করায় ইরাকের আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যায় যে, এই যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারণের শক্তি ইরানের রয়েছে।

১৯৮২ সালে দখলদার ইরাকি বাহিনীর হাত থেকে খোররামশাহর পুনরুদ্ধারের পর ফাও দখলের অভিযান ছিল ইরানের জন্য সবচেয়ে বড় বিজয়। এই বিজয়ের ফলে ইরানের সামনে আরো কয়েকটি সফল অভিযানের দুয়ার উন্মুক্ত করে দেয়। এসব অভিযানের মধ্যে ইরাক-ইরান সীমান্তবর্তী মেহরান শহর পুনরুদ্ধারের অভিযান- ‘কারবালা-১’ এবং ‘ওয়ালফাজর-১০’ অভিযান অন্যতম। অকস্যাৎ আক্রমণ চালিয়ে ইরান ইরাকের ফাও উপত্যকা দখল করার ফলে বাগদাদের আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকরা হতচকিত হয়ে যায়। এর আগে আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আরব দেশগুলোর ধারনা ছিল, ইরাকি বাহিনীর পক্ষে ইরানের যেকোনো অভিযান প্রতিহত করা সম্ভব। এ কারণে, তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াকে প্রাধান্য দিয়েছিল। কিন্তু ওয়ালফাজর-৮ অভিযানে ইরাকের পরাজয় তাদের সব ধারনা ও ভবিষ্যদ্বাণী ওলটপালট করে দেয়। এ কারণে তারা ইরাককে সামরিক দিক দিয়ে আরো বেশি শক্তিশালী করার জন্য বাগদাদের কাছে বিপুল পরিমাণ সমরাস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ