জুন ১৫, ২০২১ ১৯:৩১ Asia/Dhaka

ওয়ালফাজর-৮ অভিযানে ইরান বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করার পরপরই পশ্চিমা দেশগুলো প্রথম প্রতিক্রিয়াতে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমিয়ে দেয়।

ইরানের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ কমিয়ে দিয়ে দেশটির অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়ার লক্ষ্যে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়। এমনকি তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৬ ডলার পর্যন্ত নামিয়ে আনা হয়। এ কাজে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো পাশ্চাত্যকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে। এসব দেশ তেল উৎপাদন চাহিদার তুলনায় কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজার একপ্রকার তেলে ভাসিয়ে দেয়। এভাবে এক থেকে দুই বছর পর্যন্ত তেলের দাম কমিয়ে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে রিয়াদ।

এদিকে ওয়ালফাজর-৮ অভিযানে পরাজিত হয়ে দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে ইরাকের সাদ্দাম সরকার এতটা চাপের মুখে পড়ে যায় যে তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দেশটি ব্যাপক সামরিক ও রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করে। ইরাকি বাহিনী ইরানের একটি যাত্রীবাহী বিমান গুলি করে ভূপাতিত করে। ওই বিমানে ইরানের কয়েকজন সংসদ সদস্য ছিলেন। এমনকি ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’তে নিযুক্ত ইমাম খোমেনী (রহ.)’র প্রতিনিধি আয়াতুল্লাহ মাহাল্লাতি ওই বিমান ভূপাতিত করার ঘটনায় শহীদ হন।

ইরাকি বাহিনী একইসঙ্গে ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় খুজিস্তান প্রদেশের হাফত তাপ্পে স্টেশনে একটি যাত্রীবাহী ট্রেনে হামলা চালায়। এছাড়া ইরানের কয়েকটি অর্থনৈতিক ও শিল্প কেন্দ্রেও হামলা চালায় আগ্রাসী ইরাকি সেনারা।

ফাও দখলের অভিযানের আগ পর্যন্ত ইরাকের সামরিক কৌশল ছিল আত্মরক্ষামূলক। অর্থাৎ তারা সীমান্ত এলাকাগুলোতে কাঁটাতারের বেড়া, পরিখা খনন কিংবা মাইন পুতে রেখে তার পেছনে অবস্থান নিয়ে ইরানের যেকোনো হামলা থেকে আত্মরক্ষা করার কৌশল অবলম্বন করেছিল। কিন্তু ওয়ালফাজর-৮ অভিযানে ইরানের কাছে শোচনীয় পরাজয় শিকার করার পর ইরাকি বাহিনী আক্রমণাত্মক  অবস্থানে চলে যায়। ইরাক ও ইরানের এক হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ সীমান্তের বিভিন্ন ফ্রন্টে তারা ইরানে যোদ্ধাদের ওপর একসঙ্গে আক্রমণ করে বসে।  বাগদাদ এভাবে ফাও উপত্যকায় ইরানের হাতে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করে।

এ সময় ইরাকের চালানো অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অভিযান ছিল সাদ্দাম বাহিনী কর্তৃক ইরানের সীমান্তবর্তী মেহরান শহর দখল করা। ১৯৮৬ সালের ১৭ মে ইরাকি সেনারা এই শহর দখল করে নেয়। এর আগে ইরানি যোদ্ধারা ওয়ালফাজর-৩ অভিযান চালিয়ে শহরটিকে একবার ইরাকের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করেছিলেন।

১৯৮০ সালে ইরানের ওপর ইরাকি সেনারা আগ্রাসন চালানোর পর প্রথম তারা ইরানের যে শহরটি দখল করেছিল সেটি ছিল এই মেহরান। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে ইরানি যোদ্ধারা ওয়ালফাজর-৩ ও ওয়ালফাজর-৫ অভিযান চালিয়ে মেহরান শহরকে শত্রুসেনা মুক্ত করেছিলেন। কিন্তু ১৯৮৬ সালের মে মাসে সাদ্দাম বাহিনী এই শহর পুনর্দখল করে। তবে এবার ইরাকি বাহিনী শহরটিকে বেশিদিনে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। ইরানি যোদ্ধারা দু’মাসের মাথায় ১৯৮৬ সালেরই জুলাই মাসে মেহরান থেকে ইরাকি সেনাদের হটিয়ে দেন।

ইরাকি সেনারা মেহরান শহরে আগ্রাসন চালালে এটির নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত সাত ব্রিগেড ইরানি সৈন্য পশ্চাদপসরণ করেন। ইরাকি বাহিনী মেহরান শহরে হামলা চালিয়েছিল ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থা বিরোধী মোনাফেকিন গোষ্ঠীর সহযোগিতায়। শহরটি দখলের পর ইরাক ঘোষণা করে, তারা ফাও দ্বীপের বদলে ইরানের মেহরান শহর দখল করেছে এবং এটির নিয়ন্ত্রণ যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ইরানের হাতে ফিরিয়ে দেবে না। এবার দর কষাকষির মাধ্যমে ইরানের কাছ থেকে ফাও দ্বীপ পুনরুদ্ধার করার সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে মেহরান দখলের অভিযান ছিল বাগদাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইরাক সরকার এই ঘটনায় এতটা উৎফুল্ল হয় যে, এ উপলক্ষে বাগদাদে ৪০ বার তোপধ্বনি করা হয়।

মেহরান শহর হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর ইরানি সেনা কমান্ডাররা তাৎক্ষণিকভাবে এটি পুনরুদ্ধারের অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেন।  এই অভিযানের নাম দেয়া হয় কারবালা-১।  অভিযানের দ্বিতীয় দিনেই ইরানি যোদ্ধারা আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর কাছ থেকে শহরটি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। কারবালা-১ অভিযানে মেহরান ছাড়াও ইরাকি বাহিনীর দখলে থাকা আরো প্রায় ২২০ বর্গকিলোমিটার এলাকা পুনরুদ্ধার করা হয়। অভিযানে ইরানের সেনা কমান্ডারদের পরিকল্পনার বাইরেও বেশ কিছু এলাকা পুনরুদ্ধার হয়ে যায়। কারবালা-১ অভিযান ছিল ইরাকি বাহিনীকে আবার আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে ফিরিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য। ইরাকি বাহিনী মেহরান থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত নতুন করে আর কোনো ইরানি ভূখণ্ড বা শহরের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি বরং নিজের সীমান্ত ধরে রাখতে সচেষ্ট হয়।

ইরাকি বাহিনী ইরানের হাতে দখল হওয়া ফাও উপত্যকা পুনরুদ্ধারের মুক্তপণ হিসেবে মেহরানকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। একইসঙ্গে ইরাকি সেনাদের ভেঙে পড়া মনোবল চাঙ্গা করতেও মেহরান দখল ছিল তাদের একটি কৌশল। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে ইরানি যোদ্ধারা শহরটি পুনরুদ্ধার করার ফলে বাগদাদের সেসব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলি এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করে এবং কারবালা-১ অভিযানের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব বিশ্লেষণ করতে শুরু করে। লন্ডন থেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিন ‘ফরেন রিপোর্ট’ এক প্রতিবেদনে জানায়, “স্বাভাবিক নিয়মে মেহরান দখলের আলাদা কোনো বিশেষত্ব নেই। কৌশলগত দিক দিয়ে এটি দখলের যতটা না গুরুত্ব রয়েছে তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে।” এছাড়া সামরিক বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে ভয়েস অব আমেরিকা জানায়, মেহরান দখলের অভিযানে ইরাকের পরাজায় মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে ভয়ঙ্কর পরিণতি বয়ে আনতে পারে। কারণ, ইরাকিরা তাদের ফাও দ্বীপ দখলের বদলা নিতে ইরানের এই শহরটি দখল করেছিল।”

এদিকে ইরানের কাছে ফাও দ্বীপ হাতছাড়া হয়ে যাওয়া এবং এটি পুনরুদ্ধার করতে না পারার কারণে পাশ্চাত্যের পাশাপাশি নিজের আঞ্চলিক সহযোগীদের কাছে অপমানজনক অবস্থায় পড়ে যায় ইরাকের সাদ্দাম সরকার। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয় মেহরান দখল করে হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার অপমান। মার্কিন দৈনিক নিউজউইক এক বিশ্লেষণে জানায়, ফাওয়ের পর মেহরানও ইরাকের হাতছাড়া হয়ে যাওযার পর সাদ্দাম সরকারের প্রতি মার্কিন কর্মকর্তাদের আস্থা মারাত্মকভাবে কমে গেছে এবং বাগদাদের প্রতি অস্ত্র সাহায্য সীমিত করে ফেলেছে ওয়াশিংটন।

এদিকে ফাও এবং মেহরানে পরপর দু’টি সফল অভিযানের ফলে ইরানের রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে যুদ্ধের সমাপ্তি টানার আশা জেগে ওঠে। তেহরানে এ ধারনা প্রবল হয়ে ওঠে যে, সামরিক উপায়ে এ যুদ্ধের ইতি টানা সম্ভব। #

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ