জুন ১৫, ২০২১ ১৯:৩১ Asia/Dhaka

ওয়ালফাজর-৮ অভিযানের মাধ্যমে ইরাকের ফাও উপত্যকা দখলের পাঁচ মাস পর ইরান কারাবাল-১ অভিযান চালায়। ফাও উপত্যকায় ইরানি যোদ্ধাদের হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার পর ইরাকি বাহিনী ইরানের সীমান্তবর্তী মেহরান শহর দখল করে।

সাদ্দামের সেনারা আত্মরক্ষামূলক অবস্থান থেকে বেরিয়ে আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। কিন্তু ইরানি যোদ্ধারা তাৎক্ষণিকভাবে পাল্টা হামলা চালিয়ে মেহরান শহর পুনরুদ্ধার করেন এবং ইরাকি বাহিনীকে আবার তার আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে পাঠিয়ে দেন। কারবালা-১ নামের এই অভিযানে ইরাকি বাহিনীর ১০ হাজার সেনা হতাহত ও এক হাজার ২১০ জন ইরানের হাতে বন্দি হয়। ইরাকের ১১০টি ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ ধ্বংস হয়। সেইসঙ্গে ইরানি যোদ্ধারা গনিমতের মাল হিসেবে লাভ করেন ৬৯টি ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান, ৮টি প্রকৌশল যন্ত্র ও ৬৪টি গাড়ি।

মেহরান শহর পুনরুদ্ধারের পর এটির বিভিন্ন প্রাচীরে বড় অক্ষরে লেখা একটি স্লোগান দেখতে পাওয়া যায়- “মেহরান মুক্ত হলো ইমামের অন্তর শান্ত হলো।” কিন্তু ইরাকি বাহিনী শহরটি স্থায়ীভাবে দখলে রাখার ব্যাপারে যে দাম্ভিক প্রচারণা চালিয়েছিল তাতে পশ্চিমা পর্যবেক্ষকরা ভাবতেই পারেননি যে, এত তাড়াতাড়ি শহরটি বাগদাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। লন্ডনের সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ এক প্রতিবেদনে ঘোষণা করে, ইরান কর্তৃক মেহরান পুনরুদ্ধার এমন একটি ঘটনা যা গভীরভাবে পর্যালোচনা করার দাবি রাখে। ইরানের হাতে বন্দি ইরাকি সেনাদের মধ্যে বহু পদস্থ সেনা কর্মকর্তা ছিল। তাদের মধ্যে ছিল একাধিক মেজর জেনারেল এবং বেশ কয়েকজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল।

লন্ডনের সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের মতে, ইরাকি সেনাবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে হতাশা থেকেই তাদের এত বেশি সংখ্যক সেনা কর্মকর্তা বন্দি হয়েছিল। ইরাকের তৎকালীন উপ প্রধানমন্ত্রী তারিক আজিজ এক সাক্ষাৎকারে ভেবেই পাচ্ছিলেন না কীভাবে মেহরানে এত বড় পরাজয়ের কথা বর্ণনা করবেন। তিনি ওই সাক্ষাৎকারে মেহরানে ইরানি যোদ্ধাদের হাতে ইরাকি বাহিনীর ভয়াবহ পরাজয় সম্পর্কে কোনো কথা বলেননি। তিনি শুধু ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতি আহ্বান জানান। তারিক আজিজ বলেন, কোনো দেশ যেন তেহরানকে কোনো ধরনের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতা না করে। তিনি দাবি করেন, তাহলেই কেবল ইরানকে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত ও শান্তি (!)  মেনে নিতে বাধ্য করা যাবে।

এ সময় লন্ডন থেকে প্রকাশিত গার্ডিয়ান পত্রিকা জানায়, “ইরাকি বাহিনী ২,৫০০ সেনার লাশ পেছনে ফেলে রেখে মেহরান থেকে পালিয়ে এসেছে। ছয় সপ্তাহ আগে ইরাক যখন মেহরান দখল করে তখন বাগদাদে তোপধ্বনি ও মিছিল শোভাযাত্রা করে এ বিজয়কে উদযাপন করা হয়। অথচ এখন বাগদাদ সুর নরম করে চুপচাপ একথা স্বীকার করছে যে, ইরাকি সৈন্যরা শুধু মেহরানই পুনরুদ্ধার করেনি বরং তারা আন্তর্জাতিক সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।”

ফাও দ্বীপ দখলে রেখেই মেহরান পুনরুদ্ধাদের ঘটনায় ইরানের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। বিবিসি রেডিও এক বিশ্লেষণে জানায়, “যদিও মেহরান পুনরুদ্ধাদের ঘটনা মূল যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি পাল্টে দিতে পারবে না তবুও ইরানি সৈন্যরা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তারা ফাও দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেই ইরাকি বাহিনীর যেকোনো আগ্রাসন মোকাবিলা করতে এবং নতুন নতুন বিপদ সৃষ্টি করতে সক্ষম।”

মেহরানে পরাজিত হওয়ার পর ইরাকি বাহিনী যথারীতি ইরানের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চল ও আবাসিক এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এসব হামলায় ইরানের শত শত বেসামরিক নাগরিক হতাহত হন এবং এদেশের শিল্প কারখানাগুলোর ব্যাপক ক্ষতি হয়। এসব হামলার জবাবে ইরান ইরাকের রাজধানী বাগদাদের শিল্প কেন্দ্রগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেয়। হামলার আগে ইরানের রেডিও টেলিভিশন থেকে বারবার ইরাকি বেসামরিক জনগণকে সেদেশের সব শহরের শিল্প ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলো থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানানো হয়।

১৯৮৬ সালের গ্রীষ্মে ইরাকি বিমান বাহিনী ফ্রান্সের কাছ থেকে পাওয়া মিরেজ এফ-ওয়ান জঙ্গিবিমান দিয়ে প্রথমবারের মতো ইরানের ইস্পাহান শহরের তেল শোধনাগারে বোমাবর্ষণ করে। সে সময় ইরাকি বাহিনীর কাছে জ্বালানী সরবরাহকারী বিমান না থাকায় এবং ইস্পাহান পর্যন্ত এসে আবার ফিরে যাওয়ার মতো জ্বালানী মিরেজ জঙ্গিবিমানের ধারন করার ক্ষমতা না থাকায় এই হামলাকে ইরাকের বিমান বাহিনীর সক্ষমতায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন বলে মনে করা হয়।এ ঘটনায় একথা প্রমাণিত হয় যে, ইরাকি জঙ্গিবিমানগুলো যেভাবেই হোক আকাশে জ্বালানী সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে। 

ইরাক একথা ভালো করে জানত, যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য ইরান একমাত্র তেল রপ্তানি থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার ওপর নির্ভরশীল। এ কারণে বাগাদ ইরাকের বিভিন্ন তেল স্থাপনা, তেল শোধনাগার, তেল ট্যাংকার ও তেল রপ্তানিকারক বন্দরগুলোর ওপর হামলা চালায়। সে সময়ে ইরাকের সাদ্দাম সরকার পাইপ লাইনের মাধ্যমে তুরস্ক, সৌদি আরব ও জর্দানে তেল পাঠিয়ে ওইসব দেশের বন্দর থেকে তা বিদেশে রপ্তানি করত। কাজেই তেল রপ্তানির জন্য ইরাক পারস্য উপসাগরের ওপর তেমন একটা নির্ভরশীল ছিল না। অন্যদিকে ইরানের বেশিরভাগ তেল এই উপসাগর দিয়ে রপ্তানি হতো।

কাজেই পারস্য উপসাগরে যুদ্ধ ছড়িয়ে দিলে তাতে ইরাকের কোনো ক্ষতি হতো না বললেই চলে। এ কারণে ইরাকি বাহিনী ১৯৮৬ সালে পারস্য উপসাগর দিয়ে যাতায়াতকারী ইরানি জাহাজ ও তেল ট্যাংকারগুলোর উপর বিমান হামলা শক্তিশালী করে। এ কাজে ইরাক আমেরিকার দেয়া গোয়েন্দা তথ্য ও ফ্রান্সের কাছ থেকে পাওয়া মিরেজ জঙ্গিবিমান ব্যবহার করে। আর এ কাজে সার্বিক সহযোগিতা করে পারস্য উপসাগর তীরবর্তী আরব দেশগুলো। ১৯৮৫ ও ১৯৮৬ সালে ইরানের সর্বমোট ১২০টি তেল স্থাপনা ও তেল ট্যাংকারের উপর ইরাকি সেনারা হামলা চালায়। এসব হামলায় ইরানের ১৭৮ জন তেল কর্মী নিহত হন। হামলার ফলে স্বাভাবিকভাবেই ইরানের তেল রপ্তানি শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ইরাকি বাহিনী এভাবে যুদ্ধের ময়দানে পেরে উঠতে না পেরে অর্থনৈতিকভাবে ইরানকে ক্ষতিগ্রস্ত করার নেশায় মেতে ওঠে। প্রথমদিকে এ ধরনের হামলায় ইরানের তেল রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ইরানি যোদ্ধারা উপযুক্ত পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে সে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন এবং ইরাকের সাদ্দাম সরকারকে একথা বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হন যে, ইরানের ওপর আগ্রাসন চালিয়ে বাগদাদ মারাত্মক ভুল করেছে।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ