জুন ১৫, ২০২১ ১৯:৩১ Asia/Dhaka
  • ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (পর্ব-৭৫): যুদ্ধক্ষেত্রে কারবালা-১ অভিযান পরবর্তী পরিস্থিতি

ইরানি যোদ্ধারা মেহরান শহর পুনরুদ্ধার করার পর ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি এক প্রতিবেদনে জানায়, “পারস্য উপসাগর বিষয়ক বিশ্লেষকরা মনে করেন, মেহরান শহর ইরাকের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ফলে ইরাক সরকার আক্রমণাত্মক যে রণকৌশল বেছে নিয়েছিল তা ব্যর্থতা হয়েছে।”

এছাড়া, ভয়েস অব আমেরিকা সামরিক বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে জানায়, “ইরাকের এই পরাজয় সেদেশের সামরিক বাহিনীর ওপর মারাত্মক মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলবে। কারণ, তারা ইরানের হাতে তাদের ফাও উপত্যকার পতনের লজ্জা কাটিয়ে ওঠার জন্য মেহরান দখল করেছিল।” তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের উদ্ধৃতি দিয়ে সুইডিশ পত্রিকা ‘টিমপাওয়াস’ জানায়: “ইরান নিজেকে আমেরিকার ধারনার চেয়েও বড় হুমকি হিসেবে প্রমাণ করেছে।” একই দৈনিক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মার্কিন কর্মকর্তার বক্তব্য তুলে ধরে যাতে তিনি বলেন, “ইরানের এই বিজয় মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।”

এ ধরনের বিশ্লেষণ থেকে ইরান যাতে আর কোনো অভিযানে বিজয় অর্জন করতে না পারে সেজন্য মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা নিজের রাজনৈতিক, সামরিক ও গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়িয়ে দেয়। সির্ত উপসাগরে লিবিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকা একটি অভিযান চালানোর পর তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ হুমকি দেন, “সির্ত উপসাগরের এ সংঘর্ষ থেকে ইরান যেন প্রয়োজনীয় বার্তা গ্রহণ করে।  ইরান মধ্যপ্রাচ্যে শক্তির ভারসাম্য নষ্ট করলে আমেরিকা তা চেয়ে চেয়ে দেখবে না।” বুশের ওই হুমকির জবাব ইরানের তৎকালীন সংসদ স্পিকার ও যুদ্ধের দায়িত্বপ্রাপ্ত শীর্ষ কমান্ডার হুজ্জাতুল ইসলাম হাশেমি রাফসানজানি ঘোষণা করেন, “যারা ইরাকের মাধ্যমে ইরানের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে তাদের মুখে এ ধরনের কথা মানায় না।  আমাদেরকে ধ্বংস করার জন্য যখন যুদ্ধ চাপানো হয়েছে তখন এর উল্টো ফলাফলের জন্যও তাদের প্রস্তুত থাকা উচিত। যুদ্ধ করলে শক্তির ভারসাম্য নষ্ট হবেই।”

বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য দলিল-প্রমাণে দেখা যায়, ১৯৮৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ইরানের বিরুদ্ধে ইরাকের যুদ্ধ চলতে থাকলে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে তাতে ইরানের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে এবং সেক্ষেত্রে ইরাকসহ গোটা পারস্য উপসাগরের নিয়ন্ত্রণ ইরানের হাতে চলে যেতে পারে। কাজেই ইরানের বিজয় ঠেকাতে তৎকালীন শীতল যুদ্ধের শত্রুভাবাপন্ন দুই দেশের নেতারা আলোচনায় বসেন। ১৯৮৬ সালের ১১ অক্টোবর মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান ও সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্ভাচভ আইসল্যান্ডের রাজধানী রেইকিয়াভিকে প্রথম দফা আলোচনায় মিলিত হন। দুই নেতা প্রথমে এক ঘণ্টা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন এবং এরপর দু’দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা তাদের সঙ্গে যোগ দেন। বলা হয়ে থাকে, এই বৈঠকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৫ নম্বর প্রস্তাবের বীজ বপন করা হয়; যে প্রস্তাবের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত ইরাক-ইরান যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছিল।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জর্জ পি. শুল্টজ ১৯৮৬ সালের ১৬ অক্টোবর ক্রিসেন্ট ইন্টারন্যাশনালকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, “ইরাক-ইরান যুদ্ধে ইরানের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলে আমেরিকা সামরিক হস্তক্ষেপ করবে। আর সেরকম হস্তক্ষেপে আমেরিকার প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নের পূর্ণ সমর্থন থাকবে। কারণ, দুই পরাশক্তিই মনে করে এখন যুদ্ধের অবসান হলে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষিত হয়।  আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়ে মনে করে, চলমান যুদ্ধে ইরানের বিজয় হলে মধ্যপ্রাচ্যে শক্তির ভারসাম্য পাশ্চাত্যের স্বার্থের বিপরীতে চলে যেতে পারে।”

ইরাক-ইরান যুদ্ধের গোটা সময়টিতে বাগদাদ নিজের সামরিক সক্ষমতা শক্তিশালী করার চেষ্টায় নিয়োজিত থাকে। যুদ্ধ শুরুর পর যতই দিন যেতে থাকে ততই ইরাকের সমরাস্ত্রের পরিমাণ ও গুণগত মান বাড়তে থাকে। ইরানি যোদ্ধারা মেহরান শহর পুনরুদ্ধার করার পর ১৯৮৬ সালের ২৫ জুলাই ইরাকের রাজধানী বাগদাদে দেশটির শীর্ষ নেতারা এক জরুরি বৈঠকে মিলিত হন। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সেদেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, গোয়েন্দামন্ত্রী ও পদস্থ সেনা কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেন।  বৈঠকে সাদ্দাম বলেন, যদি প্রয়োজন হয় তাহলে আমাদের সেনাবাহিনীর সদস্যসংখ্যা বর্তমানের তিন গুণ বাড়ানো হবে। দীর্ঘ আট ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত বৈঠকে সাদ্দামের ওই প্রস্তাব গৃহিত হয়। ইরাকি সেনাবাহিনীতে লোক ভর্তি করার লক্ষ্যে সেদেশের সকল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদেরকে জরুরি ভিত্তিতে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।

সে সময় ইরাকের প্রধান সমরাস্ত্র সরবরাহকারী দু’টি দেশ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ফ্রান্স। ইরান একসঙ্গে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় এই দু’টি দেশের কেউই চায়নি যুদ্ধে তেহরান বিজয়ী হোক। দুই পরাশক্তির এই নীতি-অবস্থানের কারণে ইরাকের সাদ্দাম সরকার প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের কাছ থেকে অঢেল অর্থ ও সমরাস্ত্র সাহায্য পেতে থাকে। এমন এক পরিস্থিতিতে ইরানকে প্রায় গোটা বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়। ফ্রন্টলাইনে লড়াই চালিয়ে যেতে এবং শত্রুসেনাদের স্বস্তিতে থাকতে না দেয়ার লক্ষ্যে ইরান ইরাকের কুর্দিস্তানের একটি আধাসামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় দেশটির কিরকুক শহরে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৮৬ সালের ১১ অক্টোবর ইরানি যোদ্ধারা ইরাকের ২০০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে এই অভিযান চালান। ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র প্রায় ৩০০ কমান্ডো ইরাকের অভ্যন্তরে ঢুকে এই অভিযান পরিচালনা করেন।

প্রায় ১৫০ টন সমরাস্ত্র ও গোলাবারুদ ৪০ দিন ধরে গোপনীয়তা বজায় রেখে ইরাকের কিরকুক শহরের আশপাশে মোতায়েন করা হয়। ইরাকের কুর্দিস্তান প্যাট্রিয়টিক ইউনিয়নের প্রায় দুই হাজার যোদ্ধার সহযোগিতা ফতেহ-১ অভিযানটি পরিচালনা করা হয়। অভিযানে ইরাকের কয়েকটি তেল স্থাপনা, বিমান ঘাঁটি ও দেশটির পদাতিক বাহিনীর এক নম্বর ভিডিশনের ওপর হামলা চালানো হয়। ইরাকে ঘাঁটি গেড়ে বসা ইরানের ইসলামি সরকার বিরোধী মোনাফেকিন গোষ্ঠীর একটি আস্তানায়ও অভিযান পরিচালনা করা হয়। রাতের অন্ধকারে অভিযানটি পরিচালনা করে ইরাকের কুর্দিস্তান প্যাট্রিয়টিক ইউনিয়নের সহযোগিতায় সকাল হওয়ার আগেই ইরানি যোদ্ধারা নিজেদের ভূমিতে ফিরে আসতে সক্ষম হন। ফলে এই অভিযানে তাদের কেউ হতাহত হয়নি।

অভিযানের আকস্মিকতায় ইরাকি বাহিনী হতচকিত হয়ে যায়। এই অভিযান শেষ হলে সিরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল-আসাদ এটি পরিচালনার ধরন সম্পর্কে জানতে চান।  সব শুনে তিনি বলেন, যে ইরানি যোদ্ধাদের পক্ষে কিরকুক পর্যন্ত গিয়ে অভিযান চালিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে তাদের পক্ষে ইরাকের রাজধানী বাগদাদেও হামলা চালানো সম্ভব।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ