জুন ১৭, ২০২১ ১৯:০৪ Asia/Dhaka

১৯৮৬ সালের গোড়ার দিক থেকেই কারবালা-৪ অভিযানের প্রস্তুতি নিতে থাকে ইরান। তেহরানের লক্ষ্য ছিল এই অভিযানে বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করে নিজের অনুকূলে যুদ্ধের সমাপ্তি টানা।

কিন্তু পরিস্থিতি পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোয়নি। এর আগে ফাও দ্বীপ দখলের অভিযানে ইরানি যোদ্ধারা অকল্পনীয়ভাবে খরস্রোতা আরভান্দ নদী পার হয়েছিল। ফলে এবার আর ইরাকিরা এই নদীর তীরকে অরক্ষিত রাখেনি। সেইসঙ্গে তারা ইরানের সম্ভাব্য পরবর্তী অভিযানের গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। ফলে তারা আগেই সব জেনে গিয়েছিল এবং ইরানি যোদ্ধারা কারবালা-৪ অভিযানের জন্য যাতে আরভান্দ নদী পেরুতে না পারে সেজন্য ইরাকি সেনাবাহিনীর সপ্তম ডিভিশন একাধিক প্রতিরক্ষা বলয় গড়ে তুলেছিল। সৌদি আরবে মোতায়েন মার্কিন সেনারা এক্ষেত্রে স্যাটেলাইট থেকে সংগৃহিত গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে বাগদাদকে সহযোগিতা করে।

ইরানের হাতে ফাও দ্বীপের পতনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে আরভান্দ নদীর পশ্চিম তীরে ইরাকি সেনাবাহিনীর সপ্তম ডিভিশন মোতায়েন করা হয়। ইরানি যোদ্ধারা প্রায় প্রতিটি অভিযান রাতের বেলা চালাত বলে ইরাকিরা রাত্রিকালীন সতর্কতা বাড়িয়ে দেয়। তারা নদীর পশ্চিম তীর থেকে সারারাত নদীর দিকে অসংখ্য সার্চ লাইট নিক্ষেপ করতে থাকে যাতে ইরানি কমান্ডোরা তাদের অগোচরে নদী পার হতে না পারে।  সেইসঙ্গে তারা মাঝেমধ্যে নদীর দিকে গোলাগুলি নিক্ষেপ করে যেতে থাকে যাতে ইরানি ডুবুরিরা নদী পার হওয়ার সাহস না দেখায়।

ইরাকিদের এমন পূর্ণ প্রস্তুতির মধ্যে ইরানের ৩০ ব্যাটেলিয়ন যোদ্ধা প্রাথমিকভাবে কারবালা-৪ অভিযান শুরু করে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা উপলব্ধি করে, ইরাকিরা পূর্ণ প্রস্তুত অবস্থায় রয়েছে এবং এবার আর ফাও দ্বীপ দখলের মতো সহজে আরভান্দ নদী পার হওয়া যাবে না। ইরানি যোদ্ধারা ইরাকি বাহিনীর কঠোর প্রতিরোধের সম্মুখীন হন। বিশেষ করে উম্মুর-রাসাস ও উম্মুত-তাভিল দ্বীপ এলাকায় যেখানে আরভান্দ নদী কিছুটা সরু হয়ে এসেছে সেখান থেকে ইরানি যোদ্ধারা নদী পার হতে পারে ভেবে ইরাকি সেনারা সেখানে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করে রেখেছিল।

ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র কমান্ডার মোহসেন রেজায়ি যখন বুঝতে পারেন এই অভিযান চালিয়ে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাওয়া যাবে না তখন তিনি অভিযান স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন এবং পরদিন ভোরবেলা যোদ্ধাদেরকে পশ্চাদপসরণ করতে বলেন। তার এ নির্দেশ এমন সময় জারি করা হয় যখন ইরানি যোদ্ধাদের কোনো কোনো ইউনিট আরভান্দ নদী পার হয়ে অনেকখানি অগ্রসর হয়েছিল এবং ইরাকি সেনাদের পরাস্ত করে আবুল-খাসিব এলাকার একাংশ দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি অনুযায়ী পশ্চাদপসরণই ছিল তখন সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত।

কারবালা-৪ অভিযান ঠেকাতে ইরাকের প্রস্তুতি এবং পরবর্তীতে ইরাকি সেনা কর্মকর্তাদের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, তারা শুধু ইরানি যোদ্ধাদের সম্মুখসারীর তৎপরতা দেখে এরকম প্রস্তুতি নেয়নি বরং আমেরিকার কাছ থেকে গোয়েন্দা তথ্য পেয়েই তারা এরকম সতর্ক হতে পেরেছিল। সে সময় যেকোনো উপায়ে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ক্ষতি করা ছিল আমেরিকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। ইরাকের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী আদদান খয়রুল্লাহ এ সম্পর্কে বলেন, “ইরানের প্রধান লক্ষ্য ছিল বসরা দখল করা। যদি তারা সফল হতো তাহলে তারা পুরো ফাও উপত্যকার পাশাপাশি ‘খোর আব্দুল্লাহ’ এবং বসরার উত্তরাঞ্চলও দখল করে নিত। কিন্তু আমরা ফাও হাতছাড়া করার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে পূর্ণ প্রস্তুত ছিলাম বলেই ইরানিরা পরাজিত হয়েছে।” এরপর তিনি আমেরিকার কাছ থেকে গোয়েন্দা তথ্য পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, “এসব তথ্য সরবরাহ করার জন্য আমরা তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই।”

ইরানের পক্ষ থেকে বড় ধরনের ও চূড়ান্ত অভিযান চালানো হতে পারে ভেবে বহু আগে থেকে দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের মধ্যে ছিল ইরাক। কিন্তু কারবালা-৪ অভিযানটি ব্যর্থ হওয়ার পর বাগদাদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার-প্রোগাগান্ডা শুরু করা হয়। বিষয়টিকে বড় করে তুলে ধরে ইরাক নিজেকে যুদ্ধের ময়দানে বিজয়ী বলে তুলে ধরতে থাকে। তারা বলতে থাকে, ইরান বসরা নগরী দখলের জন্য বিশাল এক অভিযান শুরু করেছিল যা অঙ্কুরেই বিনাশ করে দেয়া সম্ভব হয়েছে। ইরাকিরা এত বেশি প্রচারণা চালাতে থাকে যে, সে সময় গণমাধ্যমগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোনো খবরই ইরানের পরাজয়ের মতো অতো গুরুত্বসহ প্রচার হয়নি।

জার্মান পত্রিকা ডি ওয়াল্ট এক বিশ্লেষণে জানায়, “ইরাকিরা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের অংশ হিসেবে তাদের বিজয়ের খবর এত ফলাও করে প্রচার করছে। ইরাকি জনগণের মনোবল চাঙ্গা করার উদ্দেশ্যে বাগদাদ যে প্রচারণা শুরু করেছে তাতে বোঝা যায়, দেশটির জনগণ ইরানের হাতে পরাজিত হতে হতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।” একইসময়ে টাইমস পত্রিকা ইরাকিদের প্রচারণাকে ‘প্রোপাগান্ডা ক্যু’ বলে অভিহিত করে। পত্রিকাটি তার বিশ্লেষণে জানায়, “বাগদাদে নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকদের পাশাপাশি ওয়াশিংটনের কর্মকর্তারা জানতেন যে, ইরাকিরা যে পরিমাণ প্রচারণা চালাচ্ছে তাদের বিজয়টি আসলে ততো বড় নয়। তারা আসলে এর মাধ্যমে ইরানের হাতে ফাও দ্বীপের পতনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চায়।”#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ