জুন ২৩, ২০২১ ১৫:০৩ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা গাফির বা মু'মিনের ৬৯ থেকে ৭৬ নম্বর নম্বর পর্যন্ত আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৬৯ থেকে ৭২ নম্বর নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يُجَادِلُونَ فِي آَيَاتِ اللَّهِ أَنَّى يُصْرَفُونَ (69) الَّذِينَ كَذَّبُوا بِالْكِتَابِ وَبِمَا أَرْسَلْنَا بِهِ رُسُلَنَا فَسَوْفَ يَعْلَمُونَ (70) إِذِ الْأَغْلَالُ فِي أَعْنَاقِهِمْ وَالسَّلَاسِلُ يُسْحَبُونَ (71) فِي الْحَمِيمِ ثُمَّ فِي النَّارِ يُسْجَرُونَ (72)

“আপনি কি লক্ষ্য করেন না যারা আল্লাহ্‌র আয়াত (বা নিদর্শন) সম্পর্কে বিতর্ক করে, তারা (সত্য পথ থেকে) কিভাবে বিচ্যুত হয়ে যায়?” (৪০:৬৯)

“যারা (আল্লাহর) কিতাব এবং যাসহ আমি আমার রাসূলগণকে পাঠিয়েছি তা অস্বীকার করে; অতএব, তারা শীঘ্রই (তাদের কৃতকর্মের ফল সম্পর্কে) জানতে পারবে।” (৪০:৭০)

“যখন তাদের গলায় বেড়ী থাকবে এবং শিকল দিয়ে তাদেরকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে।” (৪০:৭১)

“ফুটন্ত পানিতে, তারপর তাদেরকে পোড়ানো হবে আগুনে।”(৪০:৭২)

যারা আল্লাহর কিতাব ও নবী-রাসূলদের প্রদর্শিত দলিল গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয় বরং সব সময় তর্ক ও গলাবাজিতে লিপ্ত এই চার আয়াতে তাদের পরিণতির কথা বলা হয়েছে। আল্লাহর নিদর্শনাবলী বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে না নিয়ে যারা অনর্থক তা নিয়ে তর্ক করে ও গোয়ার্তুমি দেখায় তারা স্বাভাবিকভাবেই সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় দেখা গেছে, কখনো অন্ধভাবে পূর্বপুরুষ কিংবা নেতাদের আদর্শ অনুসরণ আবার কখনো নবী-রাসূলদের প্রতি আক্রোশের কারণে মানুষ সত্যের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এ ধরনের মানুষ ‘মনচাহি’ জীবনযাপনে অভ্যস্ত এবং তারা সত্য অনুসন্ধান দূরে থাকে। তারা তাদের মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কিছু গ্রহণ করতে রাজি নয়।  

তবে কেউ যদি প্রকৃত অর্থেই সত্যের সন্ধানে আত্মনিয়োগ করে কিন্তু শত চেষ্টা সত্ত্বেও সত্যের সন্ধান না পায় তাহলে আল্লাহ তায়ালা তার একনিষ্ঠ চেষ্টার কারণে তাকে ক্ষমা করে দেবেন।  কিন্তু কেউ যদি সত্য উপলব্ধি করার পরও তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তাহলে তাকে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।

অবশ্য পৃথিবীর জীবনে মানুষকে তার চলার পথ বেছে নেয়ার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে বলে সে কুফর বা শিরকের পথে চললে পার্থিব জীবনে তাকে শাস্তি দেয়া হয় না। মানুষ যদি গোয়ার্তুমি ও আক্রোশের কারণে কুফরি বা সত্য প্রত্যাখ্যান করে তাহলে তাকে কিয়ামতের দিন গলায় বেড়ী পরিয়ে শেকল দিয়ে বেধে টেনে নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

এই  চার আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে:

১- অতীতের যেসব জাতি নবী-রাসূলদের দাওয়াতের বাণী প্রত্যাখ্যান করে বিপথগামী হয়েছে তাদের পরিণতি সম্পর্কে জানতে উৎসাহিত করেছে আল-কুরআন।

২-সত্য উপলব্ধি করার পরও শুধুমাত্র জেদের বশবর্তী হয়ে তা প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয়।

৩- জাহান্নামের নানা ধরনের শাস্তির বর্ণনা দেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষ যেন তার কৃতকর্মের পরিণতি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করে যেকোনো কাজে হাত দেয়। সে যেন না ভাবে যে, তাকে তার কৃতকর্মের ব্যাপারে জবাবদিহী করতে হবে না।

সূরা গাফিরের ৭৩ ও ৭৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

ثُمَّ قِيلَ لَهُمْ أَيْنَ مَا كُنْتُمْ تُشْرِكُونَ (73) مِنْ دُونِ اللَّهِ قَالُوا ضَلُّوا عَنَّا بَلْ لَمْ نَكُنْ نَدْعُو مِنْ قَبْلُ شَيْئًا كَذَلِكَ يُضِلُّ اللَّهُ الْكَافِرِينَ (74)

“তখন তাদেরকে বলা হবে, যাদেরকে তোমরা শরীক করতে তারা কোথায়?”  (৪০:৭৩)

“(সেইসব উপাস্য) আল্লাহর স্থলে যাদের উপাসনা করতে? তারা বলবে: তারা তো আমাদের দৃষ্টি থেকে উধাও হয়ে গেছে; বরং আগে আমরা কোন কিছুর উপাসনা করিনি।  এভাবে আল্লাহ্ কাফিরদেরকে বিভ্রান্ত করেন।” (৪০:৭৪)

আগের আয়াতগুলোতে কিয়ামতের দিন কাফেরদের শাস্তিদানের কথা উল্লেখ করার পর এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: জাহান্নামের মধ্যে কাফেরদেরকে প্রশ্ন করা হবে: আল্লাহর জায়গায় তোমরা যাদের উপাসনা করতে এবং সৃষ্টিজগত পরিচালনায় যাদেরকে তোমরা আল্লাহর সঙ্গে শরীক করতে তার আজ কোথায়? তোমরা যাদেরকে নিজেদের মুক্তিদাতা বলে মনে করতে তারা আজ কেন তোমাদেরকে জাহান্নামের এই ভয়াবহ আজাব থেকে রক্ষা করতে আসছে না? এ প্রশ্নের উত্তরে তারা অবনত মস্তকে জবাব দেবে: আমরা যাদের উপাসনা করতাম তারা হয় ধ্বংস হয়ে গেছে অথবা আমাদের মতো জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। তাদেরকে আমরা দেখতে পাচ্ছি না; মনে হয় যেন তারা উধাও হয়ে গেছে।

তারা আরো বলবে: অথচ আমরা পার্থিব জীবনে এই আশায় তাদের উপাসনা করেছিলাম যে, আজকের দিনে তারা আল্লাহর কাছে সুপারিশ করে আমাদেরকে করে জান্নাতে নিয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখছি তা হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন, তারা উপাসনা করার যোগ্যই ছিল না এবং আমরা কখনো তাদের উপাসনা করিনি। এখন আমরা উপলব্ধি করছি সেইসব উপাস্য আসলে ছিল মনের অলীক কল্পনা যাদেরকে আমরা বাস্তবতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছিলাম। 

প্রকৃতপক্ষে কিয়ামতের দিনের এই স্বীকারোক্তি বা উপাস্যদের অস্বীকার কাফির ও মুশরিকদের কোনো কাজে আসবে না। কারণ, কুফর ও শিরকের পরিণতি পার্থিব জীবনে সত্য থেকে বিচ্যুতি এবং পরকালে জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তির মুখোমুখি হওয়া।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে:

১- কিয়ামতের দিন মানুষের সামনে থেকে সব অস্পষ্টতা দূর হয়ে যাবে এবং কাফির ও মুশরিকরা তাদের বিভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতা উপলব্ধি করবে।

২- কিয়ামতের বিচার দিবসে অপরাধ স্বীকার বা অস্বীকার মানুষের কোনো উপকারে আসবে না। কারণ, আল্লাহ মানুষের অন্তর সম্পর্কে সম্যক অবহিত এবং তিনি তার ওপর ভিত্তি করে বিচারের রায় দেবেন।

সূরা গাফিরের ৭৫ ও ৭৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

ذَلِكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَفْرَحُونَ فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَبِمَا كُنْتُمْ تَمْرَحُونَ (75) ادْخُلُوا أَبْوَابَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا فَبِئْسَ مَثْوَى الْمُتَكَبِّرِينَ (76)

“এই (শাস্তি) এজন্য যে, তোমরা পৃথিবীতে অযথা (ও বেপরোয়া) উল্লাস করতে এবং দম্ভ ও অহংকার করতে।”

“(এখন) জাহান্নামের দরজাসমূহ দিয়ে প্রবেশ করো চিরকাল সেখানে অবস্থান করার জন্য এবং অহংকারীদের আবাসস্থল কতই না নিকৃষ্ট।”

এই দুই আয়াতে জাহান্নানবাসীর এত ভয়ঙ্কর দুর্ভোগের কারণ উল্লেখ করে বলা হচ্ছে: পার্থিব জীবনে তারা আল্লাহ ও পরকালকে অস্বীকার করার কারণে ইন্দ্রীয়সুখ উপভোগ ও পাপকাজে নিমজ্জিত ছিল। সমাজের দুর্বল ও অসহায়দের ওপর অত্যাচার করে তারা আনন্দ পেত এবং পাপ ও আইন ভঙ্গকারী কাজ করে মজা লুটত। এ ধরনের অন্যায় আনন্দ ও দম্ভ তাদেরকে আল্লাহর কাছ থেকে আরো দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। আল্লাহর সামনে এরকম উদ্ধত আচরণ করার কারণে আজ কিয়ামতের দিন তারা এমন অবমাননাকর পরিস্থিতিতে উপনীত হয়েছে। অহংকার ও দম্ভের শাস্তি হিসেবে আজ তাদেরকে জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হচ্ছে।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:

১- ইসলামে জায়েয আনন্দ ও বিনোদন নিষিদ্ধ নয় বরং এই ধর্মে গোনাহ ও পাপকর্মযুক্ত আনন্দ-উল্লাস করতে নিষেধ করা হয়েছে।

২- পার্থিব জীবনে কাফেরদের উল্লাস ও মদমত্ততা কিয়ামতের দিন তাদের অবর্ণনীয় দুঃখ ও কষ্টের কারণ হবে।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/২৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।