আগস্ট ০৮, ২০২১ ২১:১৪ Asia/Dhaka

ইরানের পক্ষ থেকে কারবালা-৪ অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর ওই পরাজয়ের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য কারবালা-৫ অভিযানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

ইরানি নীতি নির্ধারকরা এমন একটি অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করেন যা সফল হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে অনেক বেশি। খোররামশাহর পুনরুদ্ধার হওয়ার পর ইরাকের বসরা নগরীর অন্যতম প্রবেশদ্বার ‘শালামচে’র ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকে কারবালা-৫ অভিযানের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। অভিযান শুরু করার পর ইরানি যোদ্ধারা ইরাকের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে দ্রুত গতিতে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পান। এই অভিযান প্রতিহত করার জন্য ইরাকিরা ব্যাপকভাবে প্রস্তুতি নিলেও ঠিক যে সময়টিকে অভিযান চালানোর জন্য বেছে নেয়া হয় সে সময়ের জন্য ইরাকিরা প্রস্তুত ছিল না। তারা ভেবেছিল, একটি অভিযান শেষ হওয়ার পর এত দ্রুত ইরানি যোদ্ধারা আরেকটি অভিযান চালাবে না।  

ইরাকি কর্তৃপক্ষ শালামচে অঞ্চল দখলে রাখার জন্য শক্তিশালী বাহিনী মোতায়েন করে রেখেছিল এবং বলা হতো, ইরানিরা কখনোই এটি পুনরুদ্ধার করতে পারবে না। ইরাকি বাহিনীর এই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণেই মূলত তাদের মধ্যে ঢিলেঢালা ভাব তৈরি হয়। ফলে ইরানি যোদ্ধাদের হামলার মুখে তারা দ্রুত পরাস্ত হয়। কারবালা-৫ অভিযানের জন্য ৩৩ কিলোমিটার চওড়া ও ১০ কিলোমিটার গভীর এলাকা নির্ধারণ করা হয়। এই এলাকা রক্ষা করার জন্য সাদ্দাম বাহিনী ৪৫টি ভারী কামান ও এক হাজার গোলা এবং অন্যান্য ভারী অস্ত্র সজ্জিত করে রেখেছিল। অভিযান শেষে বেঁচে যাওয়া ইরানি যোদ্ধারা শত্রু বাহিনীর কামানের বিস্ফোরিত গোলার ধোঁয়ায় সবাই কালো হয়ে গিয়েছিলেন।  

এ সম্পর্কে ইরানের একজন সেনা কমান্ডার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে রিপোর্ট করেন এভাবে: “আমি কখনো এত গোলা আর আগুন দেখিনি। যুদ্ধ এখানে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। মাটিতে পড়ে থাকা খাবারের পাত্র পর্যন্ত নিরাপদ নেই। আমি বুঝলাম সাদ্দাম সরকারের কাছে এখানকার গুরুত্ব এত বেশি কেন? ইরাকিরা এত বেশি গোলা নিক্ষেপ করছে যে, ইরাকি যুদ্ধবন্দিদের পর্যন্ত নিয়ে আসা যাচ্ছে না। নিজ সেনাদের গোলার আঘাতেই তারা মারা যাচ্ছে।”

শালামচে এলাকা বসরা নগরীতে প্রবেশদ্বার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল বলে ইরাকি বাহিনী এটি রক্ষা করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। ফলে ইরানি কমান্ডাররা উপলব্ধি করেন এত সহজে এই এলাকা দখল করা সম্ভব হবে না। যুদ্ধের আট বছরে ইরাকিরা এই ফ্রন্টে সবচেয়ে বেশি মাইন ও অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছিল।

পাশাপাশি কারবালা-৫ অভিযানের গোটা এলাকা ছিল নদী-খালে ভরা। কাজেই যদিও বা ইরানি যোদ্ধারা ইরাকি বাহিনীর সৃষ্টি করা প্রতিবন্ধকতা পার হতে পারতেন কিন্তু তাদেরকে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য এসব নদী-খাল পার হতে হতো। চূড়ান্তভাবে এসব নদী-খাল ইরাকি বাহিনীর পক্ষে প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করত।

অসংখ্য কাঁটাতারের বেড়া এবং মাইন পাতা বিশাল বিশাল ময়দানের মতো কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি এসব প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতার বিষয়টি বিবেচনায় নিলে কারবালা-৫ অভিযানে ইরানি যোদ্ধাদের বিজয়ের গুরুত্ব ভালোভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে। সাপ্তাহিক নিউজউইক সে সময় কারবালা-৫ অভিযানে ইরানের বিজয় এবং যুদ্ধক্ষেত্রের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছে এভাবে: “বসরা নগরীর কাছাকাছি ইরানের হামলা ইরাক-ইরান যুদ্ধ সম্পর্কে অন্তত একটি ধারনা বদলে দিতে পেরেছে। আর সেটি হচ্ছে, গত কয়েক বছর ধরে দু’পক্ষ সমান তালে যুদ্ধ করলেও এবার প্রথম বোঝা যাচ্ছে, একটি পক্ষ আরেক পক্ষের ওপর বিজয়ী হওয়ার ক্ষমতা রাখে।

এ সম্পর্কে বিবিসি রেডিও তার বিশ্লেষণে জানায়, খরস্রোতা আরভান্দ নদী অতিক্রম করে ফাও উপত্যকা দখল করার পর ইরান এবার অসংখ্য কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে কারবালা-৫ অভিযানে বিজয়ী হয়েছে। ইরাকিরা কৃত্রিমভাবে মাছ চাষের জন্য যে বিশাল জলাশয় তৈরি করেছিল তা অতিক্রম করে ইরানিরা প্রমাণ করেছে তারা যেকোনো পানিপথ অতিক্রম করতে সক্ষম।  অবশ্য এই অভিযানে ইরানি যোদ্ধাদের বীরত্বের সবচেয়ে সুন্দর বর্ণনা উঠে এসেছে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র কমান্ডারদের মন্তব্যে।

আইআরজিসি’র প্রধানের কাছে পাঠানো প্রতিবেদেনে নাজাফ-৮ ব্রিগেডের কমান্ডার ইরানি যোদ্ধাদের মনোবল বর্ণনা করেন এভাবে: “আমাদের যোদ্ধারা নজীরবিহীন মনোবল নিয়ে লড়াই করছে। ধুলা, বালি ও ছাইয়ে মেখে তারা সবাই কালো হয়ে গেলেও প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।” আল-মাহদি-৩২ ব্রিগেডের কমান্ডার তার প্রতিবেদনে জানান, “আল্লাহ সাক্ষী, আমি আমাদের যোদ্ধাদের এত উচ্চ মনোবল আগে কখনও দেখিনি। অন্য সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রে কেউ আহত হলে তাকে পেছনের দিকে সরিয়ে নেয়ার জন্য যোদ্ধাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা লেগে যেত। কিন্তু এই অভিযানে কেউ পেছনে যেতে রাজি নয়। সবাই বলছে- আমি যোদ্ধা, আমাকে যুদ্ধ করতে হবে। ”

কারবালা-৫ অভিযানের সুন্দরতম বর্ণনা দিয়েছেন এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী জেনারেল শহীদ কাসেম সোলেইমানি।  তিনি বলেন, “যুদ্ধের বীরোচিত ইতিহাসের পাতা উল্টালে কারবালা-৫ অভিযানের মতো গৌরবোজ্জ্বল অভিযান দ্বিতীয়টি চোখে পড়বে না। আমি যদি একথা বলি যে, ইরানি সৈন্যরা এই অভিযানে কারবালার ময়দানে ইমাম হোসেইন (আ.)-এর সহযোদ্ধাদের মতো নিজেকে উৎসর্গ করে দিতে প্রস্তুত ছিল তাহলে মোটেই অত্যুক্তি করা হবে না। ” শহীদ সোলেইমানি আরো বলেন, বিশ্বের সবগুলো দেশ একত্রিত হয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের যে ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব লিখেছিল তা ছিল কারবালা-৫ অভিযানের ফসল। ইরাকের সবগুলো সহযোগী দেশ এই অভিযানে ইরানি যোদ্ধাদের বীরত্ব দেখে হতচকিত হয়ে পড়েছিল।”#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ০৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ