আগস্ট ১০, ২০২১ ১৯:২২ Asia/Dhaka

কারবালা-৫ অভিযান ছিল ইরান-ইরাক আট বছরের যুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। শত্রুসেনাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে ইরাকের বসরা প্রদেশের পূর্ব অংশে ইরানি যোদ্ধাদের অনুপ্রবেশ ইরাকি বাহিনীর সামরিক সক্ষমতাকে আরেকবার প্রশ্নবিদ্ধ করে।

এর আগে ফাও দখলের অভিযানে ইরাকি বাহিনীর দুর্বলতা মারাত্মকভাবে প্রকাশ হয়ে পড়েছিল। প্যারিস থেকে প্রকাশিত দৈনিক অবজারভার জানায়, “পশ্চিমা বিশ্লেষকরা যুদ্ধের শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রথমবারের মতো ইরাকের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন।” একজন ব্রিটিশ বিশ্লেষকের বরাত দিয়ে সাপ্তাহিক এক্সপ্রেস জানায়, “ইরানিরা যদি বসরার কাছাকাছি পৌঁছে যায় তাহলে বাগদাদে সাদ্দাম সরকারের মনস্তাত্ত্বিক পতনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।”

ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র সাবেক কমান্ডার ও সর্বোচ্চ নেতার সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল ইয়াহিয়া রহিম সাফাভি এ সম্পর্কে বলেন, “কারবালা-৫ অভিযানের ফলে ইরাকের প্রধান পৃষ্ঠপোষক আমেরিকা এই সংশয়ে পড়ে যায় যে, যুদ্ধ এভাবে চলতে থাকলে ইরাকের শাসনব্যবস্থার পতন হতে পারে। এ কারণে আমেরিকা নিজে এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।  মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন মার্কিন সেনারা ইরানের একটি যাত্রীবাহী বিমান গুলি করে ভূপাতিত করে, পারস্য উপসাগরে ইরানের তেল স্থাপনা ও খার্গ দ্বীপে ইরানের তেল রপ্তানিকারক প্ল্যাটফর্মে হামলা চালায়।”

জেনারেল সাফাভি আরো বলেন, “আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ ফ্রান্স ও জার্মানির মতো কিছু ইউরোপীয় দেশ কারবালা-৫ অভিযান দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। কারণ, তারা একথা ভাবতেই পারেনি যে, ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইরাকের ফাও দ্বীপ দখল করার পর ইরান আরেকটি বড় ধরনের সফল অভিযান চালাতে পারবে।” ইরানের হাতে আটক একজন ইরাকি যুদ্ধবন্দি এই অভিযান সম্পর্কে বলেন, “কারবালা-৫ অভিযানে ইরানি যোদ্ধাদের ক্ষিপ্রগতির সঙ্গে ইরাক পেরে ওঠেনি। ইরানের নিখুঁত ও একটানা গোলাবর্ষণে বেশিরভাগ ইরাকি সেনা হতাহত হয়েছে। ইরাকি কমান্ডারদের পক্ষে ইরানের অভিযান প্রতিহত করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। অর্থাৎ তারা পাল্টা আঘাত হেনে ইরানি যোদ্ধাদের ক্ষতি করার কোনো সুযোগই পাননি।”

কারবালা-৫ অভিযান শুরু করার আগে অভিযানের এলাকা রক্ষা করার কাজে ইরাকের ৮ ব্রিগেড সেনা মোতায়েন ছিল। অভিযান শুরু করার পর শালামচে এলাকা রক্ষা করার জন্য মোট ৮৬ ব্রিগেড সেনা পাঠায় ইরাক সরকার। ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী এ অভিযানে ১৬ ডিভিশন ও ৮ ব্রিগেড যোদ্ধাকে কাজে লাগায়। তবে ইরান মাত্র দু’সপ্তাহ আগে কারবালা-৪ অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর ইরাকিরা ভাবতেই পারেনি যে, ইরান এত দ্রুত আরেকটি বড় অভিযান চালাতে পারবে। কাজেই কারবালা-৫ অভিযানের শুরুতে ইরাকি বাহিনী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।  অভিযান শুরুর পরপরই ইরানের হাতে আটক ইরাকি সেনারা জানায়, তাদের বেশিরভাগ কমান্ডার ছুটিতে রয়েছে এবং যারা আছে তারাও অভিযানের রাতে নিজেদেরকে ঠিকভাবে প্রস্তুত করে উঠতে পারেনি।

এমনকি কিছু ইরাকি কমান্ডার তাদের সামরিক পোশাক পরারও সময় পায়নি। তাদেরকে বেসামরিক পোশাকে আটক করেন ইরানি যোদ্ধারা। আটক ইরাকি সেনা কমান্ডাররা জানান, “আমরা নিজেদের বাসাবাড়িতে বসে খবর পাই যে, বসরা হুমকির মুখে রয়েছে এবং আমরা যেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে ইরানের আক্রমণ প্রতিহত করি। কাজেই ইউনিফর্ম পরার সময়টুকুও আমরা পাইনি।” তবে ইরাকিরা কয়েক দিনের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ায় এবং অভিযানের সপ্তম দিনে তারা ভারী কামান ও ট্যাংক ব্যবহার করে ইরানি যোদ্ধাদের ওপর তুমুল গোলাবর্ষণ শুরু করে। তারা এভাবে টানা ২০ দিন ধরে গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এদিকে আইআরজিসি’ও এই অভিযানে আট বছরের যুদ্ধের সবচেয়ে ভারী গোলাবর্ষণ করতে থাকে। অর্থাৎ, অন্যান্য অভিযানের তুলনায় এই অভিযানে উভয় পক্ষ সবচেয়ে বেশি কামানের গোলা ব্যবহার করে। 

ইরাকি বাহিনী ইরানি যোদ্ধাদের হাতে দখল হয়ে যাওয়া এলাকা পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে নিজের ১৮০ ব্রিগেড সেনার মধ্যে ১১০ ব্রিগেড সেনাকে অর্থাৎ প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সেনাকে কাজে লাগায়। ইরাকিরা পাল্টা হামলা চালাতে গিয়ে এত ভারী গোলাবর্ষণ করে যে, ভূপৃষ্ঠের উপর কোনো বস্তুই অক্ষত থাকেনি। অবস্থা এতটা ভয়াবহ হয়ে ওঠে যে, প্রচণ্ড ধোঁয়ার কারণে ইরানি যোদ্ধাদের নিঃশ্বাস নেয়াই কষ্টকর হয়ে পড়ে। তবে টানা ২০ দিন ধরে গোলাবর্ষণ করেও ইরাকি বাহিনী ইরানি যোদ্ধাদের হাত থেকে শালামচে এলাকাকে মুক্ত করতে পারেনি। অবশেষে ব্যর্থ মনোরথে তারা গোলাবর্ষণ বন্ধ করে এবং এই ব্যর্থতার দায়ে ইরাকি বাহিনীর থার্ড কোরের কমান্ডারকে বরখাস্ত করা হয়। পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর ইরানি যোদ্ধারা কয়েকদিনের মধ্যে কারবালা-৮ নামক অভিযান চালিয়ে ইরাকের আরো দুই কিলোমিটার এলাকা দখল করতে সক্ষম হন।

কারবালা-৫ অভিযানের তুমুল লড়াই চলার সময় ইরাকের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী আদনান খয়েরুল্লাহ বলেন, ইরানিদের অবস্থানে দুই হাজারের বেশি ভারী গোলাবর্ষণ করা সত্ত্বেও তাদেরকে নিজেদের অবস্থান থেকে টলানো যাচ্ছে না। ইরাকি বাহিনী তাদের প্রচলিত অস্ত্রের অকার্যকারিতা দেখার পর নিষিদ্ধ রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করতে শুরু করে।  রাসায়নিক গ্যাস এতটা বিষাক্ত ছিল যে, এই গ্যাসের সংস্পর্শে আসা যেকোনো মানুষ সঙ্গে সঙ্গে মারা পড়ছিল।  কারবালা-৫ অভিযানে শহীদ ইরানি যোদ্ধাদের বেশিরভাগই রাসায়নিক গ্যাসের আঘাতে নিহত হন। #

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ১০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ