আসমাউল হুসনা (পর্ব-৪৩)
মহান আল্লাহর নানা গুণ, ক্ষমতা ও দয়ার ওপর নির্ভর করেই টিকে আছে অস্তিত্বের জগত ও সৃষ্টি জগত।
একটি বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালাতে হলে যেমন তার, বিদ্যুৎ উৎপাদক ইত্যাদির দরকার হয় তেমনি সৃষ্টিকুলও তাদের সব ধরনের চাহিদার জন্য মহান আল্লাহর নানা ধরনের দয়া ও নেয়ামতের মুখাপেক্ষী। মহান আল্লাহর এইসব দয়া ও ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা অর্জনের জন্য তাঁর মহান নাম ও গুণগুলোর পরিচয় জানা জরুরি। আর আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতার মনোভাব সৃষ্টির জন্যও এসব নামের অর্থ ও তাৎপর্য জানা দরকার। অসুস্থ হলে আল্লাহকে আমরা ডাকি ইয়া শাফিই বা আরাগ্যদানকারী বলে। মহান আল্লাহর দয়া লাভের আশায় আমরা তাঁকে ডাকি ইয়া রাহিম, ইয়া রাহমান ও ইয়া কারিম ইত্যাদি মহান নামে। জ্ঞানের চাহিদা মেটাতে আমরা তাঁকে ডাকতে পারি ইয়া আলিম বলে।
মহান আল্লাহর আসমাউল হুসনার তালিকায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হল রাক্বিব। এর অর্থ যত্নশীল দেখাশোনাকারী ও লালনকারী। মহান আল্লাহ সর্বাবস্থায় সৃষ্টিকুলের রক্ষক, যত্নশীল ও পর্যবেক্ষক। সৃষ্টিকুলের কোনো কিছুই আল্লাহর কাছে পর্দাবৃত বা গোপন নয়। সৃষ্টিকুলের সব কিছুই রয়েছে মহান আল্লাহর কর্তৃত্বের আওতায়।
আমরা যদি আমাদের জান-মালের প্রতি যত্নশীল হওয়ার ও সুরক্ষার চাহিদা মেটাতে চাই তাহলে মহান আল্লাহর রাক্বিব নামের চেয়ে বড় কোনো সুরক্ষা নেই। তাই সুরক্ষা পেতে আমরা আল্লাহকে এ নামেও ডাকতে পারি। আসলে বিভিন্ন নামে মহান আল্লাহকে ডাকার মাধ্যমে আল্লাহর পরিচয় জানার যেমন চর্চা হয় তেমনি মহান আল্লারহ সঙ্গে আত্মিক ও আধ্যাত্মিক বন্ধনও জোরদার হয়।
রাক্বিব শব্দের মূল হল রাক্বাবা যার অর্থ হল চালক অথবা সম্পন্নকারী। তবে এ শব্দের মাধ্যমে হেফাজতকারীকেই বেশি বোঝানো হয়। পবিত্র কুরআনে এ শব্দ ৫ বার এসেছে। এর মধ্যে তিন বার মহান আল্লাহকেই বোঝানো হয়েছে এই নামের মাধ্যমে। সুরা নিসার প্রথম আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর রাক্বিব নাম ব্যবহার করে বলেছেন: নিশ্চয়ই আল্লাহ সব সময় তোমাদের ওপর যত্নশীল ও সংরক্ষক।–
মহান আল্লাহ সব কিছু দেখেন ও সব কিছুর ওপর কর্তৃত্বশীল ও পর্যবেক্ষক। চোখের একটি পলক ফেলতে যে সময় লাগে সেই সামান্য সময় বা তারও চেয়ে ক্ষুদ্র সময় এবং এমনকি ক্ষুদ্রতম সময়ের জন্যও যদি মহান আল্লাহ সৃষ্টিকুলের ওপর যত্নশীল ও সুরক্ষক না থাকেন তাহলে সমগ্র সৃষ্টিকুল ধ্বংস হয়ে যাবে।
মহান আল্লাহ সৃষ্টি করে রেখেছেন কোটি কোটি ছায়াপথযুক্ত আকাশমণ্ডল। এক একটি ছায়াপথে রয়েছে কোটি কোটি গ্রহ-নক্ষত্র। বড় বড় গ্রহ-নক্ষত্র সংরক্ষণ করতে গিয়ে তিনি ছোট ছোট গ্রহ নক্ষত্রের সুরক্ষায় উদাসীন হন না ও ক্লান্তও হন না। প্রকৃতিতে ও সৃষ্টিকুলের মধ্যে চলমান কোনো ঘটনা তার নজর এড়াতে পারে না।
বীজ থেকে চারার অঙ্কুরোদগম ও মায়ের গর্ভ থেকে শিশুর জন্মলাভের প্রক্রিয়া –এসবকিছুতেই রয়েছে মহান আল্লাহর দেখাশোনা ও যত্ন। মানুষের হৃদপিণ্ডের স্পন্দন ও শরীরে রক্ত-প্রবাহের প্রক্রিয়া- এ-সবই চলছে মহান আল্লাহর সুরক্ষায়। এক মুহূর্তের জন্যও যদি আল্লাহ এসব ক্ষেত্রে উদাসীন হতেন তাহলে গোটা সৃষ্টি জগত ধ্বংস হয়ে যেত। আল্লাহ কখনও ঘুমান না ও তন্দ্রাও যান না এবং তিনি কখনও কোনো কিছু ভুলেও যান না।
মহান আল্লাহ মানুষের কাজকর্ম, চাহিদা ও চিন্তা-ভাবনা এবং কল্পনাগুলোরও খবর রাখেন। রাক্বিব হিসেবে তিনি মানুষের দোয়া ও মুনাজাতও শোনেন। মহান আল্লাহর যত্নশীলতা ও রক্ষণের মধ্যে রয়েছে তাঁরই জ্ঞান ও সুরক্ষার সমন্বয়। তাই অনেক আলেম বলেন, মহান আল্লাহর রাক্বিব নাম হচ্ছে মূলত তাঁর হাফিজ ও আলিম নামেরই সমন্বয়। অনেকে মনে করেন আল্লাহর এই নাম তাঁর শাহিদ নামেরও প্রায় সমার্থক এবং এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য খুবই সামান্য।
সুরা মায়েদার ১১৭ নম্বর আয়াতে এসেছে: ঈসা বলছেন আমি তো তাদেরকে কিছুই বলিনি, শুধু সে কথাই বলেছি যা আপনি বলতে আদেশ করেছিলেন যে, তোমরা আল্লাহর দাসত্ব অবলম্বন কর যিনি আমার ও তোমাদের পালনকর্তা আমি তাদের সম্পর্কে অবগত বা রাক্বিব ও সাক্ষ্য ছিলাম যতদিন তাদের মধ্যে ছিলাম। অতঃপর যখন আপনি আমাকে লোকান্তরিত তথা উঠিয়ে নিলেন, তখন থেকে আপনিই তাদের সম্পর্কে অবগত বা রাক্বিব রয়েছেন। আপনি সর্ববিষয়ে পূর্ণ পরিজ্ঞাত।
মানুষের ছোট-বড় সব কাজের রেকর্ড বা আমলনামার লেখক সম্মানিত ফেরেশতাকেও কুরআনে রাক্বিব বলে উল্লেখ করা হয়েছে যদিও মহান আল্লাহ নিজেই সব কিছু সবার আগেই জানেন ও দেখেন। অল্লাহ ফেরেশতাদের এই কাজে নিয়োগ দিয়েছেন বাড়তি যত্নশীলতা ও সুরক্ষার অংশ হিসেবে যাতে তারা কিয়ামত- দিবসে সাক্ষ্য দিতে পারে এবং মানুষকে তা জানিয়ে দেয়ার কারণে মানুষও যেন জবাবদিহিতার ব্যাপারে স্বাভাবিক অবস্থার চেয়েও বেশি সতর্ক থাকে। সত্যবাদী এই ফেরেশতারা নিজ স্মৃতির ওপর নয় বরং লিখে রাখার ওপরই নির্ভর করেন মানুষের কাজকর্ম রেকর্ডের তৎপরতায়। আমরা কতবার শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়েছি তাও তাঁদের কলমে লেখা হচ্ছে।
মহান আল্লাহ তাঁর রাক্বিব নামের মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন যে আমাদের কাজ ও চিন্তাধারাসহ সব কিছুর খবর তিনি রাখেন। তাই আমরা যেন আল্লাহর আদেশ-নিষেধকে অমান্য না করি ও পাপে জড়িয়ে না পড়ি।
একজন আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষক তার একজন বিশেষ ছাত্রকে বেশি গুরুত্ব দিতেন ও তার আদর-যত্ন বেশি করতেন। অন্য ছাত্ররা এর কারণ সম্পর্কে তাকে প্রশ্ন করলে তিনি জানান এর কারণ তোমরা শিগগিরই জানতে পারবে। কিছু সময় পর তিনি তার সব ছাত্রদের হাতে একটি মোরোগ দিয়ে বলেন, এমন স্থানে এটা জবাই করবে যে কেউ যেন তোমাকে না দেখে! সব ছাত্র মোরগ জবাই করে নিয়ে আসে ওস্তাদের কাছে। কিন্তু কেবল ওই বিশেষ ছাত্র জীবন্ত মোরগ নিয়েই ফিরে এলো। তাকে প্রশ্ন করলেন ওস্তাদ: কেন জবাই করলে না? ওই ছাত্র জবাব দিলেন, এমন কোনো স্থান পেলাম না যেখানে কেউই আমাকে দেখছে না, কারণ যেখানে দৃশ্যত কেউ নেই সেখানেও আল্লাহ আমাকে দেখছেন! ওই আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষক অন্য সবার উদ্দেশে বললেন: এবার বুঝতে পেরেছ কেন এই ছাত্রকে আমি এত বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি!#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ২৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।