ঈদুল ফিতরের বিশেষ আয়োজন "আনন্দমেলা"
ঈদ মোবারক! ঈদ মোবারক! প্রিয় পাঠক শ্রোতা! রেডিও তেহরানের ঈদ আয়োজন “আনন্দমেলার’ পক্ষ থেকে আপনাদের সবার প্রতি রইলো পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ। আমাদের এবারের আনন্দমেলা সাজিয়েছি অনেকটা ঘরোয়া আড্ডার মতো করে। কথোপকথনধর্মী এই ঈদ ম্যাগাজিন আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে।
- বাহ বাহ! বেশ তো হাসি খুশি লাগছে সবাইকে। কিন্তু এই আনন্দের মূল কারণ প্রসঙ্গে একটু জানিয়ে দিলে ভালো হয় না?
: হুমম.. ভালো প্রসঙ্গ। আনন্দ কেন? আরবি ভাষায় বারবার ফিরে আসাকে ঈদ বলা হয়। আল্লাহ রাববুল আলামিন ঈদুল ফিতরে তাঁর বান্দাদেরকে নিয়ামাত ও অনুগ্রহ দিয়ে বারবার ধন্য করেন সেজন্যই আনন্দ। বারবার তাঁর ইহসানের দৃষ্টি দান করেন, সেজন্যই আনন্দ। সেজন্যই এর নাম ঈদ।
:- আসল ব্যাপারটা কি জানেন! আল্লাহ যা বলেছেন তা করাটাই ইবাদাত। ইবাদাত মানে হলো তাঁর প্রতি সকল ক্ষেত্রে অনুগত থাকা। আল্লাহ এক মাস রোজা রাখতে বলেছেন। যারা রোজা রেখেছেন তারা ইবাদাত করেছেন। ঈদের দিন আবার পানাহার করার আদেশ দিয়েছেন, তাই আজ রোজা না রাখাটাই ইবাদাত।
- হুমমম.. আজ কিন্তু ইবাদাতকারীর সংখ্যা অনেক বেশি।
: বুঝলাম না...
:- মানে রমজানে যারা রোজা রাখে নি তারা তো ইবাদাত করলো না। কিন্তু আজ তারাও রোজা না রেখে ইবাদাত করছে...
- ঠিক বলেছেন, আজ কিন্তু তারাই সাজগোজ, হাসি উল্লাস, খাবার দাবার নিয়ে বেশি উল্লসিত...
: তবে ঈদের দিনটির আলাদা তাৎপর্য রয়েছে বিশেষ করে রোজাদারদের জন্য।
:- কী তাৎপর্য?
- তাৎপর্যটা হলো... যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করার জন্য বা তাকওয়া অর্জন করার জন্য রোজা রেখেছে আল্লাহ তাদেরকে নিজ হাতে তার পুরস্কার দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রকৃত রোজাদাররা সেই খুশিতেই আজ উল্লসিত। তাদের উল্লাস মনে মনে, হৃদয়ের গভীরে, আত্মার ভুবনে।
: কথাটা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ...
:- আসলেই তাই....
- প্রকৃত রোজাদাররা তাই বাদ্য বাজনা, খাবার দাবার নিয়ে মেতে না উঠে বরং পাড়া প্রতিবেশি,গরীব-দুখিদের খোজখবর একটু বেশি নেয়। বাংলাদেশের জাতীয় কবির গানেও সে কথাগুলো রয়েছে....
: আহা..! তাই তো.. কী কাণ্ড দেখেন তো... ঈদুল ফিতরের অনুষ্ঠান,অথচ জাতীয় কবির গানটাই শোনা হলো না এখনো...
:- ঠিক বলেছেন, চলুন তাহলে গানটা এখনই শুনি... তবে মনোযোগ দিয়ে...
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।
তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে
যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমণ, হাত মেলাও হাতে,
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী
সেই গরীব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।
ঢাল হৃদয়ের তশতরীতে শিরনি তৌহিদের,
তোর দাওয়াত কবুল করবেন হজরত হয় মনে উম্মীদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
তোরে মারল’ ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট পাথর যারা
সেই পাথর দিয়ে তোলরে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ
- বাহ বাহ বাহ... সে কি গান...!
: হৃদয়টা ভরে গেল একেবারে...
:- আমার হৃদয় কিন্তু গতকাল থেকেই ভরা...
- কেন রে ভাই....
:- আমি গতকাল আমার পুরোনো জামাকাপড় যা ছিল সব গরীবদেরকে দান করে দিয়েছি....
- দেখেন কাণ্ড। তাহলে মনোযোগ দিয়ে এই গান শুনে কী লাভ হলো...
: তাই তো... গানে কী বলা হয়েছে?
:- কী বলা হয়েছে?
: বলা হয়েছে... যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা,নিত্য উপবাসী/
সেই গরিব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ..
- হুমমম.. যা কিছু মুফিদ মানে উৎকৃষ্ট তাই দিতে বলেছে। পুরোনো জিনিস দিলে হবে? নতুন কিনে দিতে হবে।
: আরেকটি কথা... জামা কাপড় দেন বা না দেন, তাদের প্রাপ্য কিন্তু বুঝিয়ে দিতেই হবে।
:- তাদের প্রাপ্য?
- হুমম, প্রাপ্য.. দান নয়..
:- কী সেটা..
: ফিতরা... গানে বলা হয়েছে: “আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ”
- তার মানে শুধু ফিতরা দিলেই চলবে না, নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে।
:- হুমম বুঝলাম! যার যেটুকু সামর্থ আছে সেটুকু দিয়ে গরীব দুখিদের মুখে হাসি ফোটাতে হবে। তবেই সার্থক হবে ঈদ।
- ভারি হয়ে গেল পরিবেশটা।
: আসলে আমাদের ঈদ মানেই নিরানন্দ একটা ব্যাপার...
:- এই তো.. সর্বনাশা কথাবার্তা...
- কেন?
:- আমাদের ঈদ নিরামিষ কে বললো..আসলে আমরা আমাদের বিধিবিধানগুলো ঠিকমতো জানি না বলেই এরকম মনে হয়। ঈদ একটি ইবাদাত একথাটা আগে বুঝতে হবে। আনন্দ ফুর্তি করার মাধ্যমেও যে ইবাদাত পালন করা যায়, ঈদ তার অন্যতম উদাহরণ।
- মানে কী? শরীয়ত সম্মতভাবে আনন্দ করা যায় নাকি?
: যায় মানে? অবশ্যই যায়। আনন্দ প্রকাশ করার বিষয়ে কুরআনে এসেছে, ‘বল, এটা আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত, সুতরাং এ নিয়েই যেন তারা খুশি হয়। এটি যা তারা জমা করে তা থেকে উত্তম।’
- হুমম! আমিও পড়েছিলাম: কবিতা আবৃত্তি, হামদ, নাত পরিবশেন, উপহার দেয়া, উজ্জ্বল রংয়ের জামা কাপড় পরা, সুগন্ধি ব্যবহার করা, সুন্দর সাজে সজ্জিত হওয়া, বাবা-মা, ভাই-বোন,আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করা সর্বোপরি কর্ম ও সাধনায় জড়িত থাকা এগুলোর সবই আনন্দের মাধ্যম এবং ইসলাম সমর্থিত।
: তাহলে তো এই আনন্দগুলোর সবই রয়েছে ঈদের মধ্যে...
:- হুমম তাই তো...
- তাহলে আর দেরি করে কী লাভ... হয়ে যাক..
: কী হয়ে যাক...
:- কবিতা আবৃত্তি টাবৃত্তি কিছু হয়ে যাক...
- ঠিক বলেছেন....
বেলাল! বেলাল! হেলাল উঠেছে পশ্চিম আসমানে,
লুকাইয়া আছ লজ্জায় কোন মরুর গরস্থানে।
হের ঈদগাহে চলিছে কৃষক যেন প্রেত- কংকাল
কশাইখানায় যাইতে দেখেছ শীর্ণ গরুর পাল?
রোজা এফতার করেছে কৃষক অশ্রু- সলিলে হায়,
বেলাল! তোমার কন্ঠে বুঝি গো আজান থামিয়া যায়।
থালা, ঘটি, বাটি বাঁধা দিয়ে হের চলিয়াছে ঈদগাহে,
তীর খাওয়া বুক, ঋণে- বাঁধা- শির, লুটাতে খোদার রাহে।
জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ
মুমুর্ষ সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?
একটি বিন্দু দুধ নাহি পেয়ে যে খোকা মরিল তার
উঠেছে ঈদের চাঁদ হয়ে কি সে শিশু- পাঁজরের হাড়?
আসমান- জোড়া কাল কাফনের আবরণ যেন টুটে।
এক ফালি চাঁদ ফুটে আছে, মৃত শিশুর অধর পুটে।
কৃষকের ঈদ!ঈদগাহে চলে জানাজা পড়িতে তার,
যত তকবির শোনে, বুকে তার তত উঠে হাহাকার।
মরিয়াছে খোকা, কন্যা মরিছে, মৃত্যু- বন্যা আসে
এজিদের সেনা ঘুরিছে মক্কা- মসজিদে আশেপাশে।
কোথায় ইমাম? কোন সে খোৎবা পড়িবে আজিকে ঈদে?
চারিদিকে তব মুর্দার লাশ, তারি মাঝে চোখে বিঁধে
জরির পোশাকে শরীর ঢাকিয়া ধণীরা এসেছে সেথা,
এই ঈদগাহে তুমি ইমাম, তুমি কি এদেরই নেতা?
:- বাহ! আবৃত্তি তো বেশ করেছেন আবৃত্তিকার জোহা ভাই। নজরুলের কৃষকের ঈদ কবিতাটাও যা লিখেছেন না... একেবারে নির্বিকল্প।
: হুমম কবিতা তো ভালোই ছিল কিন্তু আমার মনটা পড়ে ছিল ইয়েমেনে, ফিলিস্তিনের গাযায়, সিরিয়ায়... কবি নজরুল যেন তাদের কথাই বলেছেন এখানে।
- হুমম ! সমগ্র বিশ্বের যত মজলুম জাতি আছে, যত ক্ষুধার্ত গরীব মানুষ আছে সবার প্রতি উদার দুহাত বাড়িয়ে দেওয়ার দিন আজ।
:- মরিয়াছে খোকা, কন্যা মরিছে, মৃত্যু-বন্যা আসে / এজিদের সেনা ঘুরিছে মক্কা-মসজিদে আশেপাশে।
- এই চিত্রের দ্রুত অবসান ঘটুক আমরা সেই কামনা করছি।
: শ্রোতাবন্ধুরা! অনেক তো কথা হলো। এবার বিদায় নেওয়ার পালা। তার আগে একটি কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। তাহলো এক মাস রোজা রেখে আমরা কতোটা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পেরেছি জানি না। তবে আচার আচরণে, চলাফেরা, কথাবার্তায় যে কিছুটা হলেও সংযমি হয়েছি তা বোধ হয় ভুল নয়।
- রমজান উপলক্ষে আমরা চেষ্টা করেছি সকল প্রকার পাপাচার ও অশ্লীলতায় নিমজ্জিত হওয়া থেকে নিজেকে ও পরিবারকে রক্ষা করতে। রমজান তো চলে গেল। কিন্তু রমজানের সেই অনুশীলন আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। পরবর্তী রমজান পর্যন্ত আমরা সকল প্রকার পাপাচার ও অশ্লীলতা থেকে নিজেদের এবং পরিবারের সবাইকে রক্ষা করার চেষ্টা করবো-তবেই সার্থক হবে রমজানের কৃচ্ছতা সাধন, সিয়াম সাধনা।
কবি গোলাম মোস্তফা লিখেছেন
“আজি সকল ধরা মাঝে বিরাট মানবতা মূর্তি লভিয়াছে হর্ষে,
আজিকে প্রাণে প্রাণে যে ভাব জাগিয়েছে রাখিতে হবে সারা বর্ষে,
এই ঈদ হোক আজি সফল ধন্য নিখিল-মানবের মিলন জন্য,
শুভ যা জেগে থাক,অশুভ দূরে যাক
খোদার শুভাশীষ স্পর্শে।”
:- তো শ্রোতাবন্ধুরা! চলুন শিল্পী ও গীতিকার মনির হোসাইনের কণ্ঠে আরেকটি ঈদের গান শুনতে শুনতে বিদায় নেবো। যারা সঙ্গে ছিলেন সবাইকে আবারও জানাচ্ছি ঈদের শুভেচ্ছা-ঈদ মোবারক।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/২৬