মহামানবী হযরত যাইনাব (সা.আ)'র ওফাত দিবস
(last modified Sun, 08 Dec 2019 20:30:00 GMT )
ডিসেম্বর ০৯, ২০১৯ ০২:৩০ Asia/Dhaka
  • মহামানবী হযরত যাইনাব (সা.আ)'র ওফাত দিবস

মহামানবী হযরত যাইনাব (সা.আ)'র শাহাদতবার্ষিকীতে আপনাদের সবাইকে জানাচ্ছি সমবেদনা এবং এই মহামানবীর শানে পেশ করছি অসংখ্য সালাম ও দরুদ। হযরত যাইনাব (সা.আ) সম্মান-মর্যাদা আর অতুলনীয় বীরত্বের কারণে ইতিহাসে স্বর্ণোজ্জ্বল হয়ে আছেন।

কুফায় ইবনে জিয়াদের দরবারসহ নানা স্থানে এবং দামেস্কে ইয়াজিদের দরবারে বন্দী অবস্থায় ইমাম হুসাইন (আ.)’র বোন হযরত যাইনাব যেসব সাহসী বক্তব্য রেখেছিলেন তা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। হযরত যাইনাব ষষ্ঠ হিজরীর ৫ই জমাদিউল আউয়াল  জন্মগ্রহণ করেন এবং শাহাদত বরণ করেন হিজরি ৬২ সনের ১৫ ই রজব। তিনি ছিলেন হযরত আলী ও ফাতেমার তৃতীয় সন্তান। তাঁর জন্মের সংবাদে খুশি হয়ে মহানবী (সা) বলেছিলেন: "আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, এই কন্যার নাম রাখো যাইনাব, অর্থাৎ বাবার অলংকার। রাসূলে খোদা যাইনাবকে কোলে নিয়ে চুমু খেয়ে বললেন-সবার উদ্দেশ্যে বলছি, এই মেয়েটিকে সম্মান করবে, কেননা সে-ও খাদিজার মতো। "

হযরত যাইনাবের জীবন রাসূলে খোদা (সা), হযরত আলী এবং  হযরত ফাতেমার এর মতো মহান ব্যক্তিবর্গের সান্নিধ্য পেয়ে ধন্য ও পবিত্র হয়েছে। এঁরা ছিলেন পূত-পবিত্র এবং মানবীয় সব মহতী গুণের আদর্শ।  হযরত যাইনাব সেই শিশুকাল থেকেই ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এবং আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্যে ভরপুর। সেই ছোট্ট বেলায় তিনি একবার তাঁর মা ফাতেমার গুরুত্বপূর্ণ একটা ধর্মীয় ভাষণ শুনেছিলেন। সেই ভাষণ তাঁর মুখস্থ হয়ে যায় এবং পরবর্তীকালে ঐ ভাষণের একজন বর্ণনাকারী হয়ে যান তিনি। তাঁর এই সচেতনতা এবং তীক্ষ্ম স্মৃতিশক্তির জন্যে তাঁকে সবাই 'আকিলা'  তথা বুদ্ধিমতী ও চিন্তাশীল নামে অভিহিত করতেন।

 

হযরত যাইনাব শিশু বয়সে প্রিয় নানা হযরত মুহাম্মাদ (সা.) কে হারান। তার অল্প পরেই হারান মা ফাতেমাকে। এরপর তাঁকে লালন পালন করেন প্রিয় পিতা হযরত আলী। পিতার তীক্ষ্ম জ্ঞান-গরিমা, আধ্যাত্মিকতা,নীতি-নৈতিকতা আর সচেতন প্রজ্ঞার ঐশ্বর্যে নিজেও সমৃদ্ধি অর্জন করেন এবং এভাবেই তিনি বেড়ে ওঠেন। যে যুগে অধিকাংশ নারীই ছিল প্রায় মূর্খ ও নিরক্ষর, সে সময় হতেই হযরত যাইনাব ছিলেন ইসলামী সংস্কৃতির প্রচার ও প্রশিক্ষক। তাঁর জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ফলে তাঁর প্রশিক্ষণ ক্লাস ও কুরআন তাফসিরের ক্লাসে যোগ দিতে নারীরা উদগ্রীব থাকত। তিনি যতদিন মদিনায় ছিলেন ততদিন মদিনার মানুষ তাঁর জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয় এবং যখন তিনি কুফায় ছিলেন তখনো তিনি সেখানকার জনগণকে জ্ঞানের ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ করেন।

 

হযরত যাইনাবের বিয়ে হয়েছিল চাচাতো ভাই ও সম্পদশালী ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইবনে জাফরের সাথে। কিন্তু হযরত যাইনাব কখনও বস্তুবাদী ছিলেন না। তিনি শিখেছিলেন, কখনোই এবং কোনোভাবেই অত্যাচারীদের লোভনীয় মোহের কাছে সত্যের অমূল্য সম্পদ বিসর্জন দেয়া যাবে না। তাই তিনি তাঁর ভাই ইমাম হুসাইন (আ.) এর সাথে দ্বীনকে উজ্জীবিত রাখার সংগ্রামে শরিক হন। বিয়ের সময় হযরত যাইনাব শর্ত দিয়েছিলেন যে তিনি সারাজীবন তাঁর ভাই ইমাম হুসাইনের (আ.) পাশে থাকবেন। আব্দুল্লাহও তাঁর এই শর্ত মেনে নিয়েছিলেন। সেজন্যেই তিনি মদিনা থেকে কারবালায় ইমাম হুসাইনের (আ.) ঐতিহাসিক সফরকালে তাঁর সাথে গিয়ে এবং জালিম ইয়াজিদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বীরত্বের অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। 

হযরত যাইনাবের (সা.) ব্যক্তিত্বকে ভালোভাবে চেনা যায় আশুরার ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর মধ্যে এবং বিশেষ করে নবীজীর আহলে বাইতের সদস্যদের বন্দী হবার ঘটনায়। বিনয় ও নম্রতা, সত্যবাদীতা ও ভদ্রতা, আত্মত্যাগের পাশাপাশি বীরত্ব ছিল তাঁর চরিত্রের ভূষণ। পিপাসায় কাতর হওয়া সত্ত্বেও তিনি কারবালায় নিজের অংশের পানিটুকু দান করেছিলেন শিশুদেরকে। হযরত যাইনাবের ভূমিকা ছাড়া কারবালার বিপ্লব পূর্ণতা পেত না ও এর প্রকৃত ইতিহাসও প্রকাশ হত না। আল্লাহকে তিনি গভীরভাবে চিনেছিলেন। আল্লাহর ইবাদাতের প্রতি তাঁর ছিল প্রবল আকর্ষণ। নামায বা আল্লাহর স্মরণই ছিল তাঁর মানসিক প্রশান্তির রহস্য। খোদাপ্রেমে ডুবে থাকতেন বলেই দুনিয়ার কোনো দুঃখ-কষ্টই তাঁকে বিচলিত করত না।

হযরত যাইনাব তাঁর ভাই ইমাম হুসাইন (আ.) ও অন্য প্রিয়জনদের শাহাদাতের পর কঠিনতম সেই দিনগুলোতে অত্যন্ত ধৈর্য নিয়ে বীরত্বের সাথে সুস্পষ্ট ও উপযুক্ত বক্তব্য রেখে ইসলামের শত্রুদের অপদস্ত করেন। আর এভাবে মহান আল্লাহর প্রতি তাঁর গভীর আস্থা ও নির্ভরশীলতা এবং ধৈর্যশক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন তিনি। তিনি রক্তপিপাসু উমাইয়া শাসকদের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে নবীজীর আহলে বাইতের সত্যতাকে সংরক্ষণ করেন এবং কারবালায় ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের বিজয় হয়েছে বলে ঘোষণা করেন। ইয়াজিদের দরবারে যিনি যেরকম তেজস্বী বক্তব্য রেখেছেন তা সবার অন্তরে স্থায়ীভাবে গেঁথে গিয়েছিল এবং আলী (আ.) এর স্মৃতিকেও জাগিয়ে তুলেছিল। তিনি সবসময় কুরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে বক্তব্য রাখতেন যাতে তা প্রামাণ্য হয়।

 

বাকপটু ইবনে কাসির একজন আরব ছিলেন। তিনি হযরত যাইনাবের (সা.) বক্তৃতা শুনে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন: "আমার বাবা-মা তোমার জন্যে উৎসর্গিত, তোমার গুরুজনেরা সবচেয়ে উত্তম মুরব্বি, তোমাদের ঘরের শিশুরাই সবচেয়ে ভালো এবং তোমাদের ঘরের রমণীরা সর্বোত্তম নারী। তোমাদের বংশ সব বংশের উপরে এবং কখনোই পরাজিত হবে না।"

হযরত যাইনাব (সা.) দ্বীনের ব্যাপারে সচেতনতা, দুর্দশায় ধৈর্য ধারণ এবং সৎ জীবন যাপনের মাধ্যমে ঈমানের আদর্শ তুলে ধরেছিলেন। তাঁর দৃষ্টিতে সত্যের পথে এবং আল্লাহর পথে জীবন বিলানো এমন এক সৌন্দর্য যা চিরন্তন প্রশংসার দাবিদার। তাই তিনি আশুরার বীরদের অনন্য আত্মত্যাগের প্রশংসা করে জালিম ইবনে জিয়াদের পরিহাসের জবাবে বলেছিলেন-"আমি তো সৌন্দর্য ছাড়া অন্য কিছু দেখি না।"

হযরত যাইনাবের (সা.আ.) শাহাদতবার্ষিকীতে আমাদের উচিত তাঁর জীবন থেকে অন্যায়ের মোকাবেলায় খোদা-নির্ভরতাকে প্রাধান্য দিয়ে ধর্মের জন্য সর্বোচ্চ কুরবানির শিক্ষা নেয়া। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই তৌফিক দিন।#

 

পার্সটুডে/মু.আ.হুসাইন/মো.আবুসাঈদ/০৯

ট্যাগ