ঈদুল আজহা উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান 'ত্যাগের আনন্দ'
ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে উৎসব। তবে ঈদুল আজহা বল্গাহীন কোনো আনন্দের দিন নয়। ঈদুল আজহার অপর নাম 'কুরবানির ঈদ'। মহান আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ এবং তার জন্য একনিষ্ঠ আত্মত্যাগের সবচেয়ে বড় উৎসবের নাম 'ঈদুল আজহা'।
এই দিনটি খোদার প্রতি ভালোবাসাকে প্রমাণ করার দিন। এই ঈদ আমাদের শেখায় ভোগ নয়, ত্যাগেই রয়েছে আনন্দ। প্রতিবছর জিলহজ মাসের ১০ তারিখে ত্যাগের উজ্জ্বল মহিমা আর অফুরন্ত আনন্দের সওগাত নিয়ে হাজির হয় এই ঈদ।
ঈদুল আজহা উপলক্ষে প্রতিবছরের মতো এবারো একটি বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করেছে রেডিও তেহরান। এতে বাংলাদেশ, ভারত ও মালয়েশিয়া থেকে তিনজন বন্ধু অংশ নিয়েছেন। অনুষ্ঠানটি শুনতে উপরের ছবিতে ক্লিক করুন।
ঈদুল আজহার দিনটি প্রতিটি মুসলমান বিশেষকরে হাজীদের জন্য বিশেষ আনন্দের দিন। কারণ, এ দিনে তারা পশু জবাইয়ের মাধ্যমে নিজের মনের সব পশুপ্রবৃত্তিকে কুরবানি করার অনুশীলন করেন। যেমনটি করেছিলেন মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.), আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের এই দিনে। তবে, তিনি প্রথমেই পশু কুরবানির অনুমতি পাননি। স্বপ্নযোগে তিনবার আদেশ পান তাঁর প্রিয়বস্তুকে আল্লাহর রাস্তায় কুরবানি করার। অনেক চিন্তাভাবনার পর আল্লাহর নবী তার প্রিয়পুত্র হযরত ইসমাইলকে কুরবানি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। পুত্র ইসমাইলকেও তাঁর স্বপ্নের কথা বলেন।
যেমন পিতা, তেমন পুত্র! নিজের কুরবানির কথা শুনেও ঘাবড়ালেন না তিনি। ইসমাইল বললেন, 'হে আমার পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তা-ই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন।'
আল্লাহর প্রতি এরকম একনিষ্ঠতা শয়তানের সহ্য হলো না। এই পরীক্ষাকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য শয়তান উঠেপড়ে লাগল। একবার যায় পিতার কাছে আরেকবার ছেলের কাছে। মায়ের কাছে গিয়েও প্ররোচনা দেয়ার কাজে লিপ্ত হলো ইবলিশ। কিন্তু কোনো কাজই হলো না। সবার কাছ থেকে বিমুখ হলো অভিশপ্ত শয়তান।
শয়তান চলে যাওয়ার পর সংবেদনশীল মুহূর্তটি ঘনিয়ে এলো। দয়ালু পিতা তাঁর প্রিয়পুত্রকে জমিনে শুইয়ে দিলেন। ধারালো ছুরি চালালেন পুত্রের গলায়। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছেন হযরত ইব্রাহিম! এমন সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে ঐশী আওয়াজ এলো:)
"হে ইব্রাহিম! তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছ। আল্লাহ ইসমাইলকে কুরবানি করার আদেশ রহিত করেছেন।"
এরপর আল্লাহ একটি দুম্বা পাঠালেন ইসমাইলের পরিবর্তে কুরবানি করতে। হযরত ইব্রাহিম তা-ই করলেন।
হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর ছেলে ইসমাইল (আ.)-এর আত্মত্যাগকে স্মরণ করে প্রতিবছর হাজীগণ আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্যের প্রমাণস্বরূপ পশু কুরবানি করেন। এছাড়া, সামর্থবান মুসলমানরাও এদিন কুরবানি দিয়ে থাকেন।
তবে, ঈদুল আজহা এলেই একশ্রেণীর মানুষ কুরবানিকে 'পশু হত্যার উৎসব' হিসেবে অভিহিত করে থাকে। তারা কুরবানির বিরোধিতা করতে গিয়ে নানা কুতর্কে লিপ্ত হয়। একবার মৌলভী তরিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি এক প্রবন্ধে লিখেন, কুরবানিতে পশু হত্যা হয়, এমন ভয়াবহ রক্তপাতের কোনো মানে নাই।' প্রবন্ধটি পড়ে ভীষণ ক্ষুব্ধ হন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি এর জবাবে লিখেন তার বিখ্যাত কবিতা 'কুরবানি'।
ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্বোধন।
দুর্বল! ভীরু! চুপ রহো, ওহো খাম্খা ক্ষুব্ধ মন!
ধ্বনি ওঠে রণি দূর বাণীর,–
আজিকার এ খুন কোর্বানির!
দুম্বা-শির রুম্-বাসীর
শহীদের শির-সেরা আজি। –রহমান কি রুদ্র নন?
বাস! চুপ খামোশ রোদন!
আজ শোর ওঠে জোর 'খুন দে, জান দে, শির দে বৎস' শোন!
ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্বোধন।
ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার ইমাম খোমেনী (রহ.)ও পবিত্র ঈদুল আজহার তাৎপর্য সম্পর্কে বলেছেন- "ঈদুল আজহা সচেতন মানুষকে হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এর মধ্যে রয়েছে ত্যাগ ও আল্লাহর পথে জিহাদের আদর্শ। হযরত ইব্রাহিম তাঁর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় সন্তানকে আল্লাহর পথে বিলিয়ে দিয়ে খোদায়ী পুরস্কার লাভের শিক্ষা দিয়ে গেছেন। আমরা যেন ইব্রাহিম (আ.)-এর মতোই নিজেকে এবং নিজের আপনজনকে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করে আল্লাহর দ্বীন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করি।"
আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের ছেড়ে যারা প্রবাসে অবস্থান করেন, ঈদের দিনও যারা কাজে ব্যস্ত থাকেন তাদের ত্যাগের কোনো শেষ নেই। তবে প্রবাসীদের চেয়েও বেশি কষ্টে আছেন আমরা যদি ফিলিস্তিন, ইরাক, সিরিয়া, বাহরাইন, মিয়ানমার ও কাশ্মিরের মুসলমানরা। তারা কেবল ত্যাগ ও কোরবানিই করে যাচ্ছে, ঈদের প্রকৃত আনন্দ পাচ্ছেন না। আমাদের উচিত সাধ্যানুযায়ী নির্যাতিত প্রতিটি জনপদের মানুষের পাশে দাঁড়ানো। কেননা, আল্লাহ আমাদের যা যা দিয়েছেন সেগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম বা সবচেয়ে প্রিয় বিষয়গুলোকে আল্লাহর পথে কাজে লাগানোর শিক্ষাই দেয় ঈদুল আজহা।#
পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/১