মে ২০, ২০২১ ১৭:২৬ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা পাশ্চাত্যে গৃহহীনতা সমস্যা নিয়ে খানিকটা আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি, আমেরিকার বিপুল সংখ্যক মানুষ রাস্তায় ঘুমান, কারণ তাদের কোনো ঘরবাড়ি নেই।

যখন যেখানে জায়গা পান সেখানেই ঘুমান। ২০১৯ সালের ৭ ডিসেম্বর নিউ ইয়র্কের গভর্নর অ্যান্ড্রু এম. কুওমো, মহানগর পরিবহন কর্তপক্ষ বা এমটিএ'র কাছে লেখা চিঠিতে জানিয়েছেন, ২০১৮ সালে কেবল সাবওয়েতে বসবাসকারী গৃহহীন মানুষের সংখ্যা ছিল এক হাজার ৭৭১ জন। এই সংখ্যা ২০১৯ সালে ২৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ১৭৮ জনে। ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি আরও জানিয়েছেন, ট্রেন লাইনে গৃহহীন মানুষের হেঁটে চলার কারণে ট্রেন চলাচলে বিলম্বের ঘটনা কয়েক বছরে ৫৪ শতাংশ বেড়েছে। ইউরোপেও গৃহহীনদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।

গৃহহীনতা এমন একটি সমস্যা যা বিশ্বের বেশিরভাগ বড় শহরেই দেখা যায়। এটা কোনোভাবেই বলা যাবে না যে, একটি নির্দিষ্ট বয়সের মানুষ এর অন্তর্ভুক্ত। গৃহহীনদের মধ্যে  সব বয়স ও সব শ্রেণীর মানুষই রয়েছে। আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই আছেন গৃহহীনদের তালিকা। শিক্ষিত মানুষ যেমন আছেন তেমনি আছেন অশিক্ষিত ও নিরক্ষর মানুষও। অসুস্থ মানুষের পাশাপাশি আছেন সুস্থ মানুষেরাও। এমন লোককেও গৃহহীনদের তালিকায় পাওয়া যায় যারা সমাজের ধনী পরিবারের সদস্য। তবে দরিদ্র পরিবারের মানুষের সংখ্যাই বেশি। গৃহহীন হওয়ার পেছনে যেসব বিষয় কাজ করে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বেকারত্ব, মাদকাসক্তি, মদপান, মানসিক অসুস্থতা, পারিবারিক অশান্তি ও ভাঙন, শারীরিক অসুস্থতা এবং অপুষ্টি।  এসব বিষয় নিজেও যেমন সামাজিক সমস্যা তেমনি নতুন সমস্যার উৎস হিসেবে কাজ করে।  দারিদ্র্য ও সামাজিক বঞ্চনা বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে গৃহহীনতার অন্যতম প্রধান কারণ।

বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা ভিত্তিক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ইউরোপীয় দেশগুলোতে গৃহহীনতার প্রবণতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। বেকারত্ব এ ক্ষেত্রে একটি বড় কারণ। ইউরোপের কোনো কোনো দেশে গত কয়েক বছরে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ১৫০ শতাংশেরও বেশি। রাষ্ট্রীয় এবং বেসরকারি প্রতিবেদনগুলোর তথ্যে দেখা যাচ্ছে, এর আগে ইউরোপের দেশগুলোতে যারা গৃহহীন ছিল তাদের বেশিরভাগই মাদকাসক্তি, মদপান ও জুয়া খেলার কারণে অর্থাভাবে পড়তো এবং ঘরবাড়ি বিক্রি করে নিঃস্ব হতো। এরপর রাস্তায়, পার্ক বা স্টেশনে ঘুমাতে বাধ্য হতো তারা। কিন্তু নতুন প্রতিবেদনগুলোতে দেখা যাচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে অর্থনৈতিক সমস্যা বাড়ছে। এরফলে যারা কাজ করে জীবন নির্বাহ করতো এবং এক সময় নিজস্ব বাড়ি ছিল তারাও এখন কাজ হারিয়ে গৃহহীন হয়ে পড়েছে। এদের সঙ্গে তাদের ছোট সন্তানেরাও রয়েছে।

ইউরোপীয় দেশগুলোতে বসবাসকারী গৃহহীনদের নিয়ে কাজ করে ব্রাসেলস ভিত্তিক সংগঠন ‘ফিএনটিএসএ’। এই সংগঠনটি ২০১৯ সালের মার্চ মাসের প্রতিবেদনে, গৃহহীনতাকে ইউরোপের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেছে। ইউরোনিউজ এই প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, আবাসন ব্যয় ক্রমেই আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছে। এর ফলে ইউরোপে গৃহহীনতা ও দারিদ্র ক্রমবর্ধমান সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। ব্রিটেনে গৃহহীনতার চিত্র তুলে ধরতে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে সহজেই। ব্রিটেনের বড় শহর ম্যানচেস্টারের প্রাণকেন্দ্রের একটি অন্ধকার গলির শেষ প্রান্তে পৌঁছালে চোখে পড়ে ভূগর্ভস্থ এক গুহা। গুহার ভেতরে ঢুকলেই চোখে পড়ে একদল গৃহহীন মানুষের উপস্থিতি। সেখানে গিয়ে দেখা গেল ইঁদুর ছুটোছুটি করছে। দৈনিক ইন্ডিপেন্ডেন্টের মতে, ভিক্টোরিয়া আমলের সামাজিক পর্যবেক্ষকেরা যদি বেঁচে থাকতেন তবে তারা এটি দেখে হতবাক হয়ে যেতেন। এই ভূগর্ভস্থ গুহাটি ম্যানচেস্টারের প্রাণকেন্দ্রে কাঁচে ঘেরা আধুনিক  আলো-ঝলমলে দোকানপাট এবং বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট ও কমপ্লেক্সগুলো থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরেই অবস্থিত।

ইরওয়েল নদীর তীরে অবস্থিত এই গুহা সদৃশ জায়গাটি খাবারের ক্যান, খালি বোতল এবং জরাজীর্ণ ঘুমের ব্যাগে পরিপূর্ণ। পুরানো কাপড়, ছেঁড়া কার্পেট ও আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেখানে। এর মধ্যে অসংখ্য সিরিঞ্জ রয়েছে যেগুলো মাদক গ্রহণের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। ব্রিটেনে খোলা আকাশের নিচে ঘুমান বর্তমানে এমন গৃহহীনের সংখ্যা অন্তত তিন লাখ ২০ হাজার। লন্ডনে ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত এই দশ বছরে গৃহহীনের সংখ্যা বেড়েছে ১৬৫ শতাংশ।   ২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যে পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঐ বছর প্রায় ছয়শ' গৃহহীন মানুষ রাস্তায় অথবা অস্থায়ী শিবিরে প্রাণ হারিয়েছেন। ঐ পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাস্তায় বা অস্থায়ী শিবিরে পাঁচ বছরে গৃহহীন মানুষের মৃত্যুর হার বেড়েছে ২৪ শতাংশ। এদিকে, গৃহহীনদের সহায়তার জন্য প্রতিষ্ঠিত দাতব্য সংস্থাগুলো বলছে, দেশে গৃহহীন মানুষের প্রকৃত সংখ্যা, ঘোষিত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি।

ব্রিটেনের সরকারি পরিসংখ্যানগুলোতে দাবি করা হয়েছে, ২০১৮ সালে ব্রিটিশ স্লিপিং ব্যাগে ঘুমানো মানুষের সংখ্যা ২ শতাংশ কমেছে। তবে পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, ব্রিটেনের রাস্তাগুলোতে বের হলে যে চিত্র দেখা যায় তার সঙ্গে সরকারি দাবির কোনো মিল নেই। বেশ কয়েকটি স্থানীয় কাউন্সিলের গণনা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার কারণে এ ধরণের ফলাফল এসেছে বলে জানা গেছে। কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন যে, উচ্চ মহল থেকে তাদেরকে ঐ পদ্ধতি অনুসরণ করতে বলা হয়েছিল। ব্রিটেনে এ সংক্রান্ত সরকারি প্রতিবেদন ও পরিসংখ্যানের ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে, কারণ ব্রিটেনের গৃহহীনতা সংকট মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় বাজেট এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এ পরিসংখ্যানকে ভিত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো ফ্রান্সেও গত এক দশকে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফ্রান্সের ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্স দপ্তর বা ইনসিই'র মতে, ফ্রান্সের ১২ হাজারের বেশি নাগরিক সারা রাত রাস্তায় কাটান। এসব মানুষ তাদের প্রাথমিক দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করতেও সক্ষম নন এবং তাদের আয় দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারীদের পর্যায়ে। তারা সরকারি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল।

বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ফ্রান্সে রাস্তায় ঘুমান এমন গৃহহীনদের মধ্যে প্রতিদিন  গড়ে একজন করে মারা যান। ২০১৮ সালে ফ্রান্সের জাতীয় স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট জানিয়েছে, সেদেশে ঐ বছর ৫৬০ জন গৃহহীন মারা গেছেন। দেশটির কয়েকটি দাতব্য সংস্থা দাবি করেছে, গৃহহীনতার কারণে ফ্রান্সে প্রাণ হারানো মানুষের প্রকৃত সংখ্যা সরকারি পরিসংখ্যানের অন্তত ছয় গুণ। ২০১৮ সালে প্যারিসে গৃহহীনদের বিষয়ে পরিচালিত দ্বিতীয় আদমশুমারির ফলাফলে দেখা গেছে, রাস্তায় ঘুমানো মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ইউরোপের এই বিখ্যাত শহরটিতে জীবনধারণের ব্যয় এতো বেড়েছে যে, অনেকেই বাড়ি কেনার কথা ভাবতেই পারে না।#

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ২০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ