ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের শিকার সিলেটবাসী, ৩ জেলাকে ‘বন্যাদুর্গত’ ঘোষণার দাবি
(last modified Mon, 20 Jun 2022 12:13:27 GMT )
জুন ২০, ২০২২ ১৮:১৩ Asia/Dhaka

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত রয়েছে। এসব অঞ্চলের সব প্রধান নদ-নদীর পানির উচ্চতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ‌‘দেশের চারটি প্রধান নদী অববাহিকার মধ্যে দুটিতে পানি এখন বিপদসীমার অনেক উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ২০০৪ সালের বন্যার পর থেকে এটি হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি।

এ অবস্থায় আবহাওয়া অধিদপ্তরের জানিয়েছে, সিলেট বিভাগে ২৯ জুন পর্যন্ত বৃষ্টি কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। ভারী বৃষ্টি হবে বলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতিরও সম্ভাবনা নেই। পাশাপাশি ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টি হবে চট্টগ্রাম–বরিশালেও। এ ছাড়া রংপুর, রাজশাহী ও ঢাকায় কাল মঙ্গলবার এক দিনের জন্য বৃষ্টি কমলেও পরদিন বুধবার থেকে আবারও বাড়বে।

এদিকে, বন্যাদুর্গত মানুষদের সরেজমিনে দেখতে মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী দুর্যোগ কবলিত এলাকা সফর করবেন বলে সরকারি সুত্রে জানানো  হয়েছে। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান আজ (সোমবার) সিলেট পৌঁছেছেন। 

ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের শিকার সিলেটবাসী

সিলেটের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় পাঁচদিন ধরে আটকে আছেন কয়েক লাখ মানুষ। অধিকাংশ ভবনের নিচতলা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় দুই ও তিনতলায় আশ্রয় নিয়েছেন অনেকে। এ অবস্থায় ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়েছেন সিলেটের প্রায় ২০ লক্ষাধিক মানুষ। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে থাকা প্রায় আড়াই লাখ মানুষ রয়েছেন তীব্র খাবার সংকটে।

এখনো মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রের খোঁজে আছে। সেনাবাহিনী তাদের উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণ এবং চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তবে তা প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রতুল।

আজ সকালে সরেজমিন ঘুরে এসে  স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, সিলেট নগরের বিভিন্ন এলাকায় পানি স্থির রয়েছে। কিছু উঁচু এলাকা থেকে পানি নেমেছে। তবে নিম্নাঞ্চল এখনো আগের মতোই প্লাবিত। সেখানে কোমর থেকে গলাসমান পানি। বিশেষ করে, নগরের অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত উপশহরের অবস্থা খুবই খারাপ। এ এলাকার অধিকাংশ স্থানে বুক থেকে গলাসমান পানি। এ ছাড়া কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, দক্ষিণ সুরমা, সিলেট সদর, বিশ্বনাথসহ বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকায় এখনো বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে, জেলায় ৪৯৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২ লাখ ৩০ হাজার ৬৩২ জন আশ্রয় নিয়েছে। এ ছাড়া ৩১ হাজার গবাদিপশুকে ঠাঁই দেওয়া হয়েছে।

সিলেটে ভয়াবহ বন্যা

মৌলভীবাজারে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

মৌলভীবাজারে বন্যা পরিস্থিতিরর অবনতি হবার ফলে বন্যার্ত মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছেন। এ অঞ্চলে প্রতিঘণ্টায় পানি বাড়ছে। ফুলে ফেঁপে উঠছে স্থানীয় নদী ও হাওর। এরই সাথে বাড়ছে দুশ্চিন্তা ও দূর্ভোগ।

রবিবার রাত পর্যন্ত বসতবাড়ি ও ঘরে কোমর ও হাটু পানি থাকলেও রাতে বৃষ্টি হওয়াতে ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে কয়েক ইঞ্চি পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সকাল হতে ঘর বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছেন বানভাসিরা। হাকালুকি হাওরের তীরবর্তী ভূকশিমইল ইউনিয়নের সাদীপুর, মীরশংক, গৌরিশংকর, কালেশারসহ বিভিন্ন এলাকার একাধিক বাসিন্দারা জানান সকাল থেকে পানি বাড়ার কারণে তারা অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছেন।

গেল কয়েকদিনের টানা ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি এখন চরম অবনতির দিকে। সোমবার রাত থেকে নতুন করে অনেক এলাকায় বন্যা কবলিত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। হাকালুকি ও কাউয়াদিঘি হাওরসহ মনু, ধলাই ও কুশিয়ারাসহ অন্যান্য নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। রাতে বৃষ্টি হওয়াতে ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে হাকালুকি হাওর ও মনু নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বাড়ছে তীরবর্তী বাসিন্দাদের।

সিলেট, সুনামগঞ্জসহ সারা দেশে বন‍্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় নিরাপত্তার স্বার্থে সেখানের বিদ‍্যুৎ উপকেন্দ্র আংশিক বা সম্পূর্ণ বন্ধ রাখতে হচ্ছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। আজ সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পিডিবির পরিচালক সাইফুল হাসান এসব কথা জানান।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পরিচালক আরও জানান, বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র আংশিক বা সম্পূর্ণ বন্ধ রাখায় ওই এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

 বন্যাদুর্গত অঞ্চল ঘোষণার দাবিতে রাজধানীতে মানববন্ধন

এ অবস্থায় সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ জেলাকে ‘বন্যাদুর্গত অঞ্চল’ ঘোষণার দাবিতে রাজধানীতে মানববন্ধন করেছেন ঢাকায় বসবাস করা বৃহত্তর সিলেটবাসী। জালালাবাদ সংস্কৃতি ফোরামের আয়োজনে আজ সোমবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ জেলায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরবাড়ি বানের পানিতে ভেসে যাচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি। বানভাসিদের ঘরে খাবার নেই। সেখানে এক চরম দুর্যোগ দেখা দিয়েছে।

বন্যাদুর্গত এলাকায় স্বাস্থ্যব্যবস্থার চরম অবনতি নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করেন বক্তারা। তাঁরা বলেন, বিশুদ্ধ পানির অভাবে নানা রকম পানিবাহিত রোগ বেড়ে চলছে।

চিকিৎসার অভাবে মানুষের জীবনের ঝুঁকি বাড়ছে। যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন থাকায় ত্রাণসামগ্রী বন্যাকবলিত মানুষের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না। এ অবস্থায় সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ জেলাকে বন্যাদুর্গত অঞ্চল ঘোষণার দাবি জানান বক্তারা।

বক্তারা বলেন, বন্যায় দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে দ্রুত ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানো দরকার। সরকারসহ দেশের বৃত্তবান নাগরিকদের বন্যাদুর্গতদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।

পদ্মা-যমুনায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত

পদ্মায় পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীতে স্রোত ও ঢেউ বেড়েছে। এ কারণে রবিবার (১৯ জুন) রাতে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ও শরীয়তপুরের ছাত্তার মাদবর  মাঝিরঘাট নৌপথে ফেরি চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউটিসি)। অনির্দিষ্টকালের জন্য এ নৌপথে ফেরি চলাচল বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিটিসির অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক (মেরিন) আহম্মেদ আলী।

ওদিক, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ফলে যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জের দুটি পয়েন্টে বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলে নিম্নাঞ্চল দ্রুত প্লাবিত হওয়ায় দুর্ভোগে পড়ছেন সেখানকার বাসিন্দারা।

জানা গেছে, জেলার কাজীপুর পয়েন্টে গত ১২ ঘণ্টায় যমুনার পানি ৯ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া গত ১২ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধ এলাকায় আরও ১১ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে যেমন যমুনার চরের নতুন ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে, তেমনি বন্যার আশঙ্কা করছে নদীপাড়ের মানুষ।

উজানের পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ নদ- নদীর পানিও বাড়ছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় শনিবার সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকার পুঠিয়াবাড়ি, চরমালশাপাড় কালিয়াহরিপুর ইউনিয়নের চররামগাঁতী, পাইকপাড়া, মোড়গ্রাম, সয়দাবাদ ইউনিয়নের পূর্ব মোহনপুর, পূর্ব বাঐতারাসহ বাঁধ অভ্যন্তরে বিভিন্ন এলাকার বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এছাড়া জেলার অভ্যন্তরীণ করতোয়া, ফুলজোড়, ইছামতি, বড়ালসহ বিভিন্ন নদ-নদী খাল বিলের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। #

পার্সটুডে/আবদুর রহমান খান/আশরাফুর রহমান/২০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ