রোহিঙ্গা নির্যাতন: নিরাপত্তা পরিষদে ড. ইউনূসসহ ১৩ নোবেলজয়ীর খোলা চিঠি
(last modified Thu, 29 Dec 2016 18:32:46 GMT )
ডিসেম্বর ৩০, ২০১৬ ০০:৩২ Asia/Dhaka
  • রোহিঙ্গা নির্যাতন: নিরাপত্তা পরিষদে ড. ইউনূসসহ ১৩ নোবেলজয়ীর খোলা চিঠি

মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সেনাবাহিনীর আগ্রাসনের প্রতিবাদে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতিকে খোলা চিঠি দিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৩ নোবেল জয়ী এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ১০ বিশিষ্ট ব্যক্তি। বৃহস্পতিবার ইউনূস সেন্টার থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানা যায়।  

নিরাপত্তা পরিষদ সদস্যদেরকে উদ্দেশ করে লেখা ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, “আপনারা অবগত আছেন যে, জাতিগত নিধন ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধতুল্য একটি মানবীয় বিপর্যয় মিয়ানমারে বিস্তৃতি লাভ করছে। গত দুই মাসে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক রাখাইন রাজ্যে যে সামরিক আগ্রাসন চালানো হচ্ছে, তাতে শত শত রোহিঙ্গা নাগরিক হত্যার শিকার হচ্ছে। ৩০ হাজারের বেশি মানুষ এর ফলে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে, নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, বেসামরিক মানুষদের নির্বিচারে আটক করা হচ্ছে, শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। আরও ভয়ের ব্যাপার, মানবিক সাহায্য সংস্থাগুলোকে সেখানে প্রবেশ করতে বাধা দেয়া হচ্ছে। যার ফলে আগে থেকেই চরম দরিদ্র এই এলাকাটিতে মানবীয় সংকট ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। হাজার হাজার মানুষ নিকটবর্তী বাংলাদেশে পালিয়ে যাচ্ছে, যেখান থেকে তাদের ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। কোনো কোনো আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ঘটনাটিকে গণহত্যা বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। নিকট অতীতে রুয়ান্ডা, দারফুর, বসনিয়া ও কসোভোয় সংগঠিত গণহত্যাগুলোর সব বৈশিষ্ট্য এখানে দৃশ্যমান।”

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ

ওই বিবৃতিতে বলা হয়, “জাতিসংঘ রিফিউজি হাইকমিশনের বাংলাদেশ কার্যালয় প্রধান জন ম্যাককিসিক মিয়ানমার সরকারকে জাতিগত নিধন পরিচালনার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংহি লি রাখাইন রাজ্যে প্রবেশের ওপর বিধিনিষেধ আরোপকে অগ্রহণযোগ্য বলে অভিযোগ করেছেন।“

চিঠিতে বলা হয়, “রোহিঙ্গারা পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর একটি; যারা দশকের পর দশক পরিকল্পিত প্রান্তিকীকরণ ও অমানবিক আচরণের শিকার। ১৯৮২ সালে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয় ও তাদের রাষ্ট্রহীন করে ফেলা হয়। যদিও তারা বংশ পরম্পরায় মিয়ানমারে বসবাস করে আসছে। তাদের চলাচল, বিবাহ, শিক্ষা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। তাদের দুর্দশা নাটকীয়ভাবে ঘনীভূত হয় ২০১২ সালে যখন দু’টি ভয়াবহ সহিংসতার ঘটনায় লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় এবং পাশাপাশি অবস্থিত মুসলিম ও বৌদ্ধ রাখাইনদের বর্ণবৈষম্যের ভিত্তিতে আলাদা করে ফেলা হয়। এরপর থেকে তারা চরম পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে দিনাতিপাত করে আসছে।” 

বিবৃতিতে বলা হয়, “এ বছরের ৯ অক্টোবরে মিয়ানমার বর্ডার পুলিশের ওপর আক্রমণের একটি ঘটনায় বর্ডার পুলিশের নয়জন সদস্য নিহত হন। এ আক্রমণ কারা, কীভাবে ও কেন করল, সে সত্য এখনো উদ্‌ঘাটিত হয়নি। তবে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের একটি পক্ষকে দায়ী করছে। এ অভিযোগ যদি সত্য হয়েও থাকে, এতে সামরিক বাহিনীর প্রতিক্রিয়া একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ জন্য সন্দেহভাজনদের আটক, জিজ্ঞাসাবাদ ও বিচারের মুখোমুখি করা এক বিষয়, আর হাজার হাজার নিরীহ বেসামরিক নাগরিকের ওপর হেলিকপ্টার গানশিপ দিয়ে গুলিবর্ষণ করা, নারীদের ধর্ষণ করা এবং শিশুদের আগুনে নিক্ষেপ করা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।”

খোলা চিঠিতে আরও বলা হয়, “মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কাছে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে একজন রোহিঙ্গা বলেন, পলায়নরত মানুষদের ওপর তারা গুলিবর্ষণ করে। তারা গ্রামটি ঘিরে ফেলে এবং ঘরে ঘরে তল্লাশি চালাতে শুরু করে। তারা গালিগালাজ করছিল এবং নারীদের ধর্ষণের হুমকি দিচ্ছিল। আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী নারী জানান, কীভাবে তাঁর দুই ছেলেকে কোনো কারণ ছাড়াই আটক করা হয়।”

চিঠিতে ২৩ বিশিষ্ট ব্যক্তি আরও উল্লেখ করেন, “নোবেলজয়ী অং সান সু চির কাছে বারবার আবেদনের পরও তিনি রোহিঙ্গাদের পূর্ণ ও সমনাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় আমরা হতাশ হয়েছি। সু চি মিয়ানমারের নেত্রী এবং দেশটিকে সাহস, মানবিকতা ও সমবেদনার সঙ্গে পরিচালনা করার দায়িত্ব তাঁরই।”

বিবৃতিতে বলা হয়, “মিয়ানমার সরকারকে মানবিক সহায়তার ওপর সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার নিতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সম্ভাব্য সব উদ্যোগ নিতে জাতিসংঘের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি, যাতে মানুষ জরুরি সহায়তা পেতে পারে। সাংবাদিক ও মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদেরও সেখানে প্রবেশের অনুমতি দেয়া উচিত এবং বর্তমান পরিস্থিতি বিষয়ে প্রকৃত সত্য উদ্‌ঘাটনের উদ্দেশ্যে একটি নিরপেক্ষ, আন্তর্জাতিক তদন্ত পরিচালিত হওয়া প্রয়োজন। একইসঙ্গে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি জরুরি এজেন্ডা হিসেবে সংকটটিকে উপস্থাপনের জন্য আমরা নিরাপত্তা পরিষদকে বিশেষভাবে আহ্বান জানাচ্ছি এবং জাতিসংঘ মহাসচিবকে জরুরি ভিত্তিতে সামনের সপ্তাহগুলোতে মিয়ানমার পরিদর্শন করতে অনুরোধ করছি। বর্তমান মহাসচিবের পক্ষে এটা সম্ভব হলে আমরা তাঁকেই সেখানে যেতে অনুরোধ করব; অন্যথায় নতুন মহাসচিবকে জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেয়ার পরই এ বিষয়টিকে তাঁর কর্মতালিকায় অন্যতম অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করতে অনুরোধ জানাব।”

বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী ব্যক্তিরা হলেন-
১. ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী
২. হোসে রামোস হোর্তা, ১৯৯৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী
৩. আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু, ১৯৮৪ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী
৪. মেইরিড মাগুইর, ১৯৭৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী
৫. বেটি উইলিয়াম্স, ১৯৭৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী
৬. অসকার অ্যারিয়াস, ১৯৮৭ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী
৭. জোডি উইলিয়াম্স, ১৯৯৭ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী
৮. শিরিন এবাদি, ২০০৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী
৯. তাওয়াক্কুল কারমান, ২০১১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী
১০. লেইমাহ বোয়ি, ২০১১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী
১১. মালালা ইউসুফজাই, ২০১৪ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ী
১২. স্যার রিচার্ড জে রবার্টস, ১৯৯৩ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার জয়ী
১৩. এলিজাবেথ ব্ল্যাক বার্ন, ২০০৯ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার জয়ী

এছাড়া চিঠিতে সই করেন, ইতালির ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী রোমানো প্রাদি, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমা বোনিনো, চলচ্চিত্র কাহিনিকার, প্রযোজক ও পরিচালক রিচার্ড কার্টিস, লিবীয় নারীঅধিকার প্রবক্তা আলা মুরাবিত, অ্যারিয়ানা হাফিংটন, স্যার রিচার্ড ব্র্যানসন,পল পোলম্যান, মো. ইব্রাহিম, জোকেন জাইট্জ  ও কেরি কেনেডি।#

পার্সটুডে/এআর/৩০ 


 

ট্যাগ