উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পোশাক শিল্পে দূষণ কমানোর আহ্বান
বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি আয়ের খাত পোশাক শিল্পকে আরও টেকসই করতে উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দূষণ কমানোর আহ্বান জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট মহল। গতকাল শনিবার রাজধানীর ব্রাক সেন্টারে বেসরকারী সাহায্য সংস্থা অ্যাকশনএইড এবং ফ্যাশন রেভোলিউশন আয়োজিত ‘ভয়েসেস অ্যান্ড সল্যুশনস’ শীর্ষক সেমিনারে অয়োজকগন এ আহবান জানান।
আলোচনা অনুষ্ঠানে গত এক দশকে দেশীয় পোশাক শিল্পের অবদান এবং অনেক সংস্কার উদ্যোগ প্রসঙ্গে বক্তাগণ তাদের অভিমত ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বর্তমানে সমস্ত শিল্প কর্মসংস্থানের ৪৫ শতাংশই হয় পোশাক এবং টেক্সটাইল খাতে, যা মোট জাতীয় আয়ের ৫ শতাংশ। দেশে রপ্তানি আয়ের ৭৮ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। এই তৈরী পোশাক শিল্পে কাজ করছে দেশের ৪০ লক্ষের বেশি শ্রমিক, যাদের বেশীরভাগই হচ্ছে নারী শ্রমিক। এ সব গুরুত্ব বিবেচনা করেই পোশাক শিল্প পরিচালনার ক্ষেত্র পরিবেশের উপর এর নেতিবাচক প্রভাব হ্রাস করা এবং এ শিল্পকে টেকসই করার প্রতি মনোযোগ দেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে দাড়িয়েছে।
এসময় উদ্যোক্তা সংগঠক অ্যাকশনএইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, শিল্পের ক্রমাগত বিকাশের ফলে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সম্পদের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আবার কারখানান বর্জ্যের কারণে প্রতক্ষ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রকৃতি ও পরিবেশ।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা এই পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, পোশাক শিল্পের বর্জ্য হতে নির্গত মিথেন বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। পোশাক প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত রাসায়নিক রং মাটির সঙ্গে মিশে ভূপৃষ্ঠ এবং ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত করে।
তারা পরামর্শ দিয়েছেন, পরিবেশের উপর পোশাক শিল্পখাতের এই নেতিবাচক প্রভাব কমাতে উদ্ভাবনী উদ্যোগ ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিল্প কলকারখানার পানি, জ্বালানী ব্যবহার হ্রাস করে বর্জ্য নিষ্কাশন কমানো প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান রেডিও তেহরানকে বলেন, দেশের গুরুত্ব পেশাক শিল্পের আর্থনীতির গুরুত্ব, কর্মসংস্থানের গুরুত্ব, জনস্বাস্থের বিবেচনা, এবং মালিকদের নিজেদের ভবিষ্যত বিবেচনায় এখনই তাদের কারখানার উৎপাদন ও বর্জ ব্যবস্থাপনা পরিবেশ সম্মত করতে হবে।
তবে পোশাক শিল্পে পানি ও পরিবেশ দূষণ নিয়ে আয়োজকদের কয়েকটি তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন কারখানা মলিকরা। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ার সুফল হিসেবে গড়ে ওঠা বিভিন্ন পরিবেশ বান্ধব কারখানার বিষয়টি তারা তুলে ধরেন ।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিল্পকারখানা হতে নিষ্কাশিত বর্জ্যরে পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে করতে হবে আরো উন্নত। উন্মুক্ত জলাশয়কে ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।
কিউটেক্স সল্যুশনস লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাহুরা খানম বলেন, বর্জ্য নিষ্কাশন শুধু পরিবেশ দূষণই করছে না বরং জ্বালানী খরচ বৃদ্ধি করছে। বর্তমানে গড়ে অধিকাংশ কারখানার জ্বালানী দক্ষতা মাত্র ২০-২৫ শতাংশ। শিল্পকারখানার এই নেতিবাচক প্রভাব রোধে সরকার, নগর কর্তৃপক্ষ এবং শিল্প কারখানাসমূহের ভালো উদ্যোগগুলো সমন্বয়ের অভাবে সঠিকভাবে কার্যকর হচ্ছে না।
বিজিএমইএ-এর সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফারুক হাসান জানান, “বর্জ্য নিষ্কাশনের পরিমাণ কমিয়ে আনতে আমরা কাজ করছি। এজন্য কর্মচারী ও শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। এজন্য আরো উন্নয়ন ও বিনিয়োগ দরকার।”
ঢাকা চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি-এর সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম বলেন, সমমানের বিকল্প খাতের অভাবে আগামী ১০-১৫ বছর এই শিল্পখাতের উপর নির্ভর করেই বাংলাদেশকে এগোতে হবে। বিজিএমইএ টেকসই পণ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কার্যক্রমে গুরুত্ব দিচ্ছে। উৎপাদনের সাথে ব্যবসায়িক চাহিদার সমন্বয় ঘটাতে হবে। একইসাথে, পরিবেশ রক্ষা, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করবে এই সংগঠন।
ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমরান রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের উচিৎ তাদের নীতিমালায় টেকসই উৎপাদন ও ব্যবহারের উপর জোর দেওয়া। এখন পর্যন্ত ফ্যাশন শিল্প নিয়ে নীতিমালা তৈরির জন্য পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্ত নেই। তাই আরো বেশি গবেষণার প্রয়োজন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. সুলতান আহমেদ দিনব্যাপি এই আলোচনার দ্বিতীয় অধিবেশনে বলেন, দেশের কারখানাগুলোর পরিবশ বিষয়ক তদারকি ব্যবস্থাপনা আছে। তবে তদারকির জন্য যথেষ্ট লোকবল নেই। আমাদের পরিবেশ রক্ষার জন্য প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা। একইসঙ্গে দরকার সকলের মানসিকতার পরিবর্তন।#
পার্সটুডে/আব্দুর রহমান খান/বাবুল আখতার/২১