করোনাকালে বাংলাদেশ সরকারের রেকর্ড ব্যাংক ঋণ, দুই অর্থনীতিবিদের প্রতিক্রিয়া
বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৩১ মে পর্যন্ত অর্থাৎ ১১ মাসে (জুলাই-মে) বাংলাদেশ সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৯৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এত বেশি ঋণ নেয়নি সরকার।
করোনাভাইরাস মহামারীতে বিশ্বেসহ দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য থেকে এ চিত্র উঠে এসেছে। ব্যাংক থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ বা ধার করার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। পরে তা বাড়িয়ে ৭২ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা করা হয়। কিন্তু করোনাভাইরাস সঙ্কটের মধ্যে এই বিশাল লক্ষ্যকেও ছাড়িয়ে যায় সরকারের ঋণ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মূল বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ায় এ খাত থেকে ঋণ পাওয়ায় সংশোধিত বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ৩০ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ১৯ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সরকার নিয়েছিল মাত্র ৯২৬ কোটি টাকা। তার আগের বছর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকার যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছিল, পরিশোধ করেছিল তার চেয়ে ১৮ হাজার ২৯ কোটি টাকা বেশি। তার আগের অর্থবছরে নিয়েছিল মাত্র ৪ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছর সরকারের ঋণ কমেছিল ৬ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “সরকারের রাজস্ব আয় কমেছে। আবার করের হার বৃদ্ধি এবং আইনকানুন কঠোর করায় সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যও কমিয়ে এনেছে। ফলে সরকারের এখন একটাই পথ ব্যাংক ঋণ। আর সেটাই করছে। এছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই। দেশ চালাতে হলে এটা করতেই হবে।”
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চলতি অর্থবছরে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্য ধরেছিল ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আদায়ে ধীরগতির কারণে তা কমিয়ে ৩ লাখ ৫০০ কোটি টাকা করা হয়। গত এপ্রিল পর্যন্ত ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি আদায় হয়েছে, যা ওই সময়ের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৬২ হাজার কোটি টাকা কম।
আহসান মনসুর বলেন, “করোনাভাইরাসের কারণে আয়কর, আমদানি শুল্ক, ভ্যাট-কোনো খাতেই এখন কর আদায় হচ্ছে না। আমি হিসাব করে দেখেছি, অর্থবছর শেষে সংশোধিত লক্ষ্যের চেয়েও প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার মতো রাজস্ব কম আদায় হবে।”
অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে ৭ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭৫ শতাংশ কম। এ জন্য চলতি অর্থবছরের সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ২৭ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ১২ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। এর ফলে খরচ মেটাতে সরকার পুরোপুরি ব্যাংক ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর।
এ বিষয়ে ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, “করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে সারা বিশ্বেই ভোক্তা চাহিদা কমে গেছে। বাংলাদেশেও আমদানি কমছে, রপ্তানিও কমে গেছে। যতদিন রাজস্ব আদায়ে গতি না আসবে অথবা বড় অংকের বিদেশি ঋণ সহায়তা না পাওয়া যাবে, ততদিন ব্যাংক থেকে সরকারকে ঋণ নিয়েই যেতে হবে। সবমিলিয়ে সামনে খুবই কঠিন সময় আসছে। তাই অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বিনিয়োগ বাড়াতেই হবে বলে মন্তব্য করেন মির্জ্জা আজিজ। সেইসঙ্গে তার প্রশ্ন, ব্যাংকের সব টাকা যদি সরকার নিয়ে নেয়, তাহলে বেসরকারি খাত ঋণ পাবে কোথা থেকে?’
“আমাদের এখন জোর দিতে হবে, বিদেশি ঋণ সহায়তার দিকে। সরকার চেষ্টা করছে, কিন্তু সেটা যাতে দ্রুত আসে সেটা নিশ্চিত করতে হবে,” বলেন তিনি।
পাইপলাইনে যে ঋণ-সহায়তা আছে সেগুলো দ্রুত ছাড় করার উদ্যোগ নেওয়ার পরমর্শও দেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত এক বছর ধরে টানা নামছে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি। ফেব্রুয়ারি শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৮৯৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এই অঙ্ক গত বছরের ফেব্রুয়ারির চেয়ে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে গত বছরের জানুয়ারির চেয়ে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরের চেয়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ। আগের মাস নভেম্বরে ছিল ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। অক্টোবরে ছিল ১০ দশমিক ০৪ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আগস্টে ছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। তার আগের মাস জুলাইয়ে ছিল ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ।
তার আগে জুনে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ; মে মাসে ১২ দশমিক ১৬ শতাংশ। এপ্রিলে ছিল ১২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, মার্চে ১২ দশমিক ৪২ শতাংশ।
জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ছিল যথাক্রমে ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ ও ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এভাবে প্রতি মাসেই কমছে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ।#
পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।