রোহিঙ্গা সংকটের চার বছর
২৫শে আগস্টকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে রোহিঙ্গারা
মিয়ানমারের মুসলিম অধ্যুষিত রাখাইণ প্রদেশে সরকারি বাহিনীর গণহত্যা ও ব্যাপক নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে বাস্তচ্যুত হয়ে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেবার চার বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। বর্তমানে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফের ৩০টিরও বেশি অস্থায়ী ক্যাম্পে মানবেতর জীবন যাপন করছে। ইতোমধ্যে বিশ হাজারের মতো রোহিঙ্গাকে বঙ্গোপসাগরের দ্বীপ ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে।
রোহিঙ্গা নেতারা দাবি করেন, ২০১৭ সনে মিয়ানমার সেনাদের হাতে ১০০ নারী ধর্ষিত, ৩০০ গ্রামকে নিশ্চিহ্ন, ৩৪ হাজার শিশুকে এতিম, ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে হত্যা, ৯ হাজার ৬০০ মসজিদ, ১২০০ মক্তব, মাদ্রাসা ও হেফজখানায় অগ্নিসংযোগ, আড়াই হাজার রোহিঙ্গা মুসলিমকে বন্দি ও ৮ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আরকান রাজ্য থেকে বাস্তচ্যুত হয়।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ নিয়ে নানা দেনদরবার, কূটনৈতিক তৎপরতা এমনকি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হবার পরও গত চার বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি মিয়ানমার। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য দু’বার উদ্যোগ নিলেও তা ভেস্তে যায়। রোহিঙ্গারা তাদের নাগরিকত্ব প্রদান, জমিজমা ফেরত, সেনাদের বিচারে মুখোমুখি সহ ছয়টি দাবি জানিয়ে আসছে। সন্মানজনকভাবে এবং নিরাপত্তার সাথে নিজ বাসভূমে বসবাসের অধিকার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও স্বদেশ ফিরতে রাজি নয়।
এ প্রসঙ্গে রোহিঙ্গা এডুকেশন ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম-এর সাধারণ সম্পাদক জয়নুল আবেদিন রেডিও তেহরানকে জানান, ক্যাম্প জীবন রোহিঙ্গাদের জন্য বাঞ্ছিত জীবন নয়। তারা সন্মানের সাথে নিজ দেশদে ফেরত যেতে চায়। বাংলাদেশ তাদের প্রত্যাবসনের জন্য যেভাবে চেষ্টা করছে তাতে তারা আশাবাদী ।
উল্লেখ্যা, ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর ও ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট দুইবার প্রত্যাবাসনের তারিখ নির্ধারণ করা হলেও নিরাপত্তা ও নাগরিকত্ব নিশ্চিত না হওয়ায় একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফেরেনি। বাংলাদেশও জোর করেনি। প্রত্যাবসন প্রক্রিয়া নিয়ে কথাবার্তাও চলছে কচ্ছপ গতিতে। ইতোমধ্যে ২০২১ সালের শুরুতে ইয়াঙ্গুনে সেনা অভ্যুত্থানের কারণে থমকে যায় এ প্রক্রিয়াটি। এ প্রসঙ্গে উপজেলা রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মোজাম্মেল হক বলেন, যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন জরুরি। নয়তো একদিন ফিলিস্তিনের মতো পরিণতি ভোগ করতে হবে। তাদের কারণে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থা চরম ক্ষতি হচ্ছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন,‘আমাদের উচিত হবে-আন্তর্জাতিক কমিউনিটির সঙ্গে আরও বড় আকারে কথা বলা, এমনকী রোহিঙ্গা ডায়াসপোরা, বাংলাদেশের গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ—সবারই উচিত হবে এই ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসে মহামারিজনিত পরিস্থিতি যখনই ভালো অবস্থায় যাবে, তখনই যেন এই প্রত্যাবাসন এবং বিশেষ করে তাদের আইডেন্টিটি যেন দেওয়া হয়, সে ব্যাপারে বড় আকারে মিয়ানমারের ওপর চাপ দেওয়া।’
এদিকে ২৫শে আগস্টকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে রোহিঙ্গারা। ঘোষণা দেয়ার পর শুরুর দুই বছর বিক্ষোভ আর জনসমাবেশ করতে পারলেও করোনার (কোভিড-১৯) কারণে এবং সরকারের নিষেধ থাকায় জনসমাবেশ এড়িয়ে এবার মসজিদে মসজিদে নামাজের পর বিশেষ দোয়া করবেন বলে জানা গেছে। যে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সদস্যরা প্রতিটি পয়েন্টে নিয়োজিত রয়েছে। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে টহল জোরদার করা করেছে।
১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) অধিনায়ক এসপি তারিকুল ইসলাম জানান, রোহিঙ্গারা চেয়েছিল এ দিবসটি উপলক্ষ্যে কর্মসূচি পালন করতে। কিন্তু আমরা তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি বিধায় তারা কর্মসুচী পালন করা থেকে বিরত রয়েছে। এখন পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক রয়েছে। যদি নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে কঠোর হস্তে দমন করা হবে।
রোহিঙ্গাদের কারণে বিক্ষুব্ধ স্থানীয়রা:
উখিয়া-টেকনাফের প্রায় আট হাজার ৫০০ হেক্টরের বেশি জমিতে রোহিঙ্গারা আশ্রয় শিবির গড়ে তুলেছে। প্রায় সাড়ে এগারো লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের এই দুই উপজেলাতে অবস্থান করায় নানা সংকট ও বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন দ্রব্য মূল্য উর্ধ্বগতি দেখা দিয়েছে। । রোহিঙ্গাদের কারণে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে স্থানীয়রা।
বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাফেরার কারণে স্থানীয়দের যাতায়াত ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। টেকনাফ হতে কক্সবাজারের পথে পথে প্রায় ৮টির বেশি বিভিন্ন আইনশৃংখলা বাহিনীর তল্লাশি পয়েন্ট বসিয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ ও সময় ব্যয় করে যেতে হচ্ছে স্থানীয়দের । শুধু তাই নই, দেখাতে হচ্ছে জাতীয় পরিচয়পত্র। অনেক সময় হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে। স্থানীয়দের পাশাপাশি লেমোনেটিং আইডি কার্ড দেখিয়ে সহজেই পার হয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গারাও।
এদিকে, রোহিঙ্গারা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধের সাথে । মাদক ইয়াবা পাচার ও বহন, হত্যা, গুম, সংঘাত, দ্বন্দ্ব ইত্যাদি অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েছে রোহিঙ্গারা। শুধু তাই নই, পতিতাবৃত্তি, উঠতি যুবকদের চারিত্রিক অবনতি ও আইনশৃংখলার অবনতি ঘটছে এই রোহিঙ্গাদের কারণে। #
পার্সটুডে/ আব্দুর রহমান খান/ বাবুল আখতার/২৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।