কাল্পনিক পরমাণু বোমা:
নিউ ইয়র্ক পোস্ট কীভাবে মার্কিন নির্বাচনে ইরান সম্পর্কে ভীতি সৃষ্টি করছে
পার্সটুডে- নিউ ইয়র্ক পোস্টের দাবির বিপরীতে, ট্রাম্পের নীতির কারণে তার আন্তর্জাতিক কূটনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং কার্যত ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির উন্নতির পথ প্রশস্ত হয়েছে।
মার্কিন দৈনিক নিউ ইয়র্ক পোস্ট সম্প্রতি দেশটির আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইরানের কথিত হস্তক্ষেপ সম্পর্কে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। নিবন্ধের নাম দেয়া হয়েছে, “বাইডেনের দয়ায় ইরান পারমাণবিক শক্তিধর দেশে পরিণত হওয়ার পথে- মোল্লারা হ্যারিসের বিজয় চান।” “Iran is set to go nuclear, thanks to Biden — and the mullahs want Harris to win” নিবন্ধটিতে প্রমাণ অযোগ্য ও অতিরঞ্জিত ভাষা প্রয়োগ করে ইরানের পরমাণবিক কর্মসূচি এবং এই কর্মসূচির ওপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের নীতির প্রভাব সম্পর্কে একটি ভুল চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। পার্সটুডে ফার্সি জানিয়েছে, নিবন্ধটিতে নানারকম পরিসংখ্যান তুলে ধরে এমন কিছু দাবি করা হয়েছে যা শুধু যে ভুল তাই নয় বরং সত্যের অপলাপ যা মার্কিন জনগণের মধ্যে ভীতি ও অনাস্থা তৈরি করার সুদূরপ্রসারি লক্ষ্যে তুলে ধরা হয়েছে।
নিবন্ধটির শুরুতে বলা হয়েছে: “বাইডেন প্রশাসনের মেয়াদের শেষ নাগাদ ইরান ১২টির বেশি পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ফেলতে পারবে।” এই দাবির স্বপক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি বরং এখানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পরিস্থিতিকে গুরুতর হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরান এখন পর্যন্ত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার অবস্থায় পৌঁছেনি এবং দেশটির পরমাণু কর্মসূচি আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আইএইএ’র তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া, ইরান বহুবার একথা ঘোষণা করেছে যে, দেশটির পরমাণু কর্মসূচি কেবলমাত্র বেসামরিক লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে এবং পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কোনো পরিকল্পনা তেহরানের নেই।
নিউ ইয়র্ক পোস্ট এরপর দাবি করেছে:
“তেহরান ৬২০০ কেজি ইউরেনিয়াম ৫%, ২০% ও ৬০% মাত্রায় সমৃদ্ধ করেছে।” কারিগরি দিক দিয়ে এই পরিসংখ্যান সত্য হতে পারে, কিন্তু যে বিষয়টি এই নিবন্ধে উপেক্ষা করা হয়েছে তা হলো, এই মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার অর্থ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া নয়। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার জন্য ইউরেনিয়ামকে ৯০% এর বেশি মাত্রায় সমৃদ্ধ করতে হয়, যে মাত্রায় ইরান এখনও পৌঁছেনি এবং সে মাত্রায় পৌঁছালে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের আওতায় ইরানকে কঠোর পরিস্থিতির মোকাবিলা করা হবে।
নিউ ইয়র্ক পোস্টের নিবন্ধের আরেকটি ভুল দাবি হচ্ছে: “ইরানের কাছে বর্তমানে অন্তত ৭২০০ অত্যাধুনিক সেন্ট্রিফিউজ রয়েছে যা দিয়ে দ্রুতগতিতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা সম্ভব।” কোনো নির্ভরযোগ্য দলিল ছাড়াই এই দাবিটি করা হয়েছে মার্কিন জনমতকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে। বাস্তবতা হচ্ছে, পাশ্চাত্যের সঙ্গে ইরানের স্বাক্ষরিত পরমাণু সমঝোতাসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক চুক্তির কারণে এসব সেন্ট্রিফিউজের বেশিরভাগ কঠোর আন্তর্জাতিক নজরদারিতে রয়েছে। এছাড়া, সেন্ট্রিফিউজের এই সংখ্যা সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসনের আক্রমণাত্মক নীতির কারণে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ানো হয়েছে। নিউ ইয়র্ক পোস্টের দাবির বিপরীতে, ট্রাম্পের নীতির কারণে তার আন্তর্জাতিক কূটনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং কার্যত ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির উন্নতির পথ প্রশস্ত হয়েছে।
কলামটিতে আরো বলা হয়েছে: “ইরান বর্তমানে তার নাতাঞ্জ স্থাপনার কাছে এমন একটি পারমাণবিক স্থাপনা তৈরি করছে যা ভূপৃষ্ঠের এতটা গভীর নির্মাণ করা হচ্ছে যে, বিমান হামলা চালিয়েও সেটিকে ধ্বংস করা সম্ভব নয়।” এই তথ্যটিও অতিরঞ্জিত এবং মার্কিন জনগণের মনে আতঙ্ক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। ইরান তার পরমাণু কর্মসূচির ক্ষেত্রে যতগুলো নতুন প্রকল্পই হাতে নিয়েছে তার সবগুলো আইএইএ’র তত্ত্বাবধানে করা হয়েছে।
নিউ ইয়র্ক পোস্টের নিবন্ধটির অন্যত্র বলা হয়েছে:
“ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে ইরান স্বল্প মাত্রায় ২৪০০ কেজিরও কম ইউরেনিয়াম উৎপাদন করেছিল।” ট্রাম্প ও বাইডেন প্রশাসনের শাসনামলে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির তুলনামূলক পার্থক্য তুলে ধরতে গিয়ে এই অতিরঞ্জনটি করা হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, ট্রাম্প পরমাণু সমঝোতা থেকে বেরিয়ে যাওয়াসহ যেসব নীতি গ্রহণ করেছিলেন তার ফলে কার্যত ইরানের পরমাণু তৎপরতা বেড়ে গিয়েছিল। এর কারণ হচ্ছে, ট্রাম্প আমেরিকাকে পরমাণু সমঝোতা থেকে বের করে নেয়ার পর ইরান নিজের পরমাণু কর্মসূচির ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে দিয়েছিল।
নিউ ইয়র্ক পোস্টের সবচেয়ে বিতর্কিত অংশটি হচ্ছে, এটিতে পরোক্ষভাবে এই দাবি করা হয়েছে যে, আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইরান কমলা হ্যারিসের বিজয় চায়। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে, ইরানের জনগণ ও সরকার মনে করে যে, আমেরিকার ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটরা ইরানের ব্যাপারে দ্বৈত নীতি ও ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নিয়েছে। নিউ ইয়র্ক পোস্ট লিখেছে: “আসন্ন নির্বাচনে কমলা হ্যারিস বিজয়ী হলে মার্কিনীদের হত্যা ও রক্তপাতের মুখোমুখি হতে হবে।” নিঃসন্দেহে এই বাক্যটির যে শুধুমাত্র কোনো ভিত্তি নেই তা নয় সেইসঙ্গে এর পক্ষে কোনো দলিল-প্রমাণও উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। এ ধরনের হুমকির ভাষা প্রয়োগে কলামটির লেখকের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই কেবল প্রকাশ পেয়েছে। তিনি ডেমোক্র্যাট প্রার্থীকে আক্রমণ করার পাশাপাশি ইরানের সঙ্গে ডেমোক্র্যাটদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের একটি মিথ্যা ও কাল্পনিক চিত্র তুলে ধরার অপপ্রয়াস চালিয়েছেন।
পরিশেষে বলা যায়, নিউ ইয়র্ক পোস্টের নিবন্ধে বাস্তবতা ও নির্ভরযোগ্য বিশ্লেষণ তুলে ধরার পরিবর্তে মার্কিন সমাজে ভীতি ও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরির অপচেষ্টা করা হয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রবিহীন তথ্য ও পরিসংখ্যানের ব্যবহার কেবল এ বিষয়টিই প্রমাণ করে যে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচিতে রাজনৈতিক রঙ লাগানোর অশুভ উদ্দেশ্যে কলামটি লেখা হয়েছে; এটি লেখার পেছনে একটি নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ তুলে ধরার কোনো ইচ্ছেই ছিল না।#
পার্সটুডে/এমএমআই/১৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।