ইরানের ৪৬তম ইসলামী বিপ্লব দিবস: ইতিহাস, সংগ্রাম ও স্বাধীনতার প্রতীক
সাইফুল খান: ১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। ইরানের ইতিহাসে একটি রক্তাক্ত অধ্যায়ের সমাপ্তি এবং নতুন যুগের সূচনা ঘটে। শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটিয়ে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনীর নেতৃত্বে ইরানি জনতা প্রতিষ্ঠা করেছিল একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র।
প্রতি বছর এই দিনটি ইরানে "ইসলামী বিপ্লব দিবস" হিসেবে পালিত হয়। এই বিপ্লবের ৪৬তম বার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে, ইরানের জনগণ শুধু অতীতের গৌরবই স্মরণ করে না বরং জাতীয় সংহতি, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার দৃঢ় প্রত্যয়ও প্রকাশ করে।
ঐতিহাসিক পটভূমি: কেন এই বিপ্লব?
বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইরান পাহলভি রাজবংশের অধীনে একটি পশ্চিমাপন্থী, স্বৈরাচারী শাসনের শিকার হয়। শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির নীতিগুলো ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। ইসলামি মূল্যবোধকে প্রান্তিক করে, আধুনিকায়নের নামে পশ্চিমা সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়া হয় ইরানের ধর্মপ্রান মুসলমানদের উপর। শাহের শাসনামলে সৃষ্টি হয় ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং সেন্সরশিপ। গোয়েন্দা সংস্থা সাভাকের নৃশংসতা হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ভয়াবহ আতঙ্ক।
অন্যদিকে, ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনী ১৯৬৩ সালে শাহের "শ্বেত বিপ্লব" (সামাজিক সংস্কার) এর বিরুদ্ধে সরব হন। তিনি শাহের পশ্চিমা নির্ভরতাকে "সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ" আখ্যা দিয়ে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দেন। ১৯৬৪ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনীকে নির্বাসিত করা হলেও তার বক্তব্য ক্যাসেট ও লিফলেটের মাধ্যমে ইরানে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭০-এর দশকে তেলের দাম কমে যাওয়া, মুদ্রাস্ফীতি এবং রাজনৈতিক দমন বিপ্লবের পথকে আরো প্রশস্ত করে।
বিপ্লবের অগ্নিগর্ভ দিনগুলো
১৯৭৮ সালের শুরুতে ইরানের ধর্মীয় নগরী কোম শহরে শাহবিরোধী বিক্ষোভ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। শাহের সেনাবাহিনী ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮ বিক্ষোভকারীদের ওপর মুহুর্মুহু গুলি চালালে শতাধিক শহীদ হন। এই ঘটনা "ব্ল্যাক ফ্রাইডে" (৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮) নামে পরিচিত। এরপর প্রতিবাদ আরো তীব্রতর হয়। দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। ক্ষোভের আগুনে জ্বলে ওঠে সমগ্র ইরানের পথ-ঘাট। সারাদেশে ধর্মীয় নেতারা শাহের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেন। ডিসেম্বর নাগাদ লক্ষাধিক মানুষ প্রতিদিন রাজপথে নেমে আসে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গনমানুষের শহীদী কাফেলা ধর্ম, সংস্কৃতি ও দেশের জন্য রক্ত দিতে প্রতিদিনই নামতে থাকে রাজপথে। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। পৃথিবীর কোন শক্তির ক্ষমতা নেই এই মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদী কাফেলার দূর্বার গতিকে রোধ করে। সকলের রক্তেই শহীদি তামান্নার সুধা পান করার আকুলতা, যা কেবল অনুভবেই প্রকাশ করা সম্ভব।
১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি, পৃথিবীর পঞ্চম সামরিক শক্তির দেশ ইরানের স্বৈরাচারী শাহ দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। ১ ফেব্রুয়ারি আয়াতুল্লাহ খোমেনী ১৫ বছর নির্বাসনের পর ফ্রান্স থেকে তেহরানে ফিরে আসেন এবং বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। অপরদিকে ১১ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষতা ঘোষণা করলে শাহের শাসনের আনুষ্ঠানিক অবসান হয়। এই দিনটিই ঐতিহাসিক "ইসলামী বিপ্লব দিবস" হিসেবে চিহ্নিত।

বিপ্লবের মূলনীতি ও লক্ষ্য
আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ মুসাভি খোমেনীর নেতৃত্বে গঠিত নতুন রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল তিনটি মূলনীতি:
১. এস্তেকলাল বা স্বাধীনতা: যেকোনো বিদেশি প্রভাব মুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্র।
২. আজাদি বাস্বা ধিকার: গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ ও ন্যায়বিচার।
৩. জুমহুরি ইসলামি বা ইসলামি প্রজাতন্ত্র: ইসলামি শরিয়াভিত্তিক শাসনব্যবস্থা।
বিপ্লবের পর ইরান যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রত্যাখ্যান করে এবং ইসরাইলের বিরোধিতা শুরু করে।
"মার্গ-এ বার-এ খোদা" বা “আল্লাহর পথে” নীতির ভিত্তিতে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গ্রামীণ উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ হয়।
৪৬তম বার্ষিকীর তাৎপর্য
১১ ফেব্রুয়ারি তেহরানের আজাদি স্কয়ারে লাখো মানুষের জমায়েত হয়। প্রেসিডেন্টের ভাষণে ওঠে আসে বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা এবং পারমাণবিক কর্মসূচির প্রতি অটল থাকার প্রত্যয়। " আমেরিকা ধ্বংস হোক", "ইসরাইল ধ্বংস হোক" স্লোগানে মুখরিত হয় রাজপথ।
তরুণদের কাছে বিপ্লবের আদর্শ হস্তান্তরকে কেন্দ্র করে আয়োজিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কবিতা পাঠ ও বিপ্লবী চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী। মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে ভার্চুয়াল র্যালিও সংযুক্ত হয় বিশ্বব্যাপী ইরানিদের।
বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ ও সমালোচনা
ইসলামী বিপ্লবের ৪৬ বছরে ইরান বহু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, করোনা মহামারি এবং জলবায়ু সংকট অর্থনীতিকে দুর্বল করেছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো রাজনৈতিক দমন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অভাবের সমালোচনা করে।
তবে, সরকারের সমর্থকরা যুক্তি দেখান যে, ইরান বৈশ্বিক চাপের মুখেও তার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছে। পারমাণবিক চুক্তি (JCPOA) থেকে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা প্রস্থান সত্ত্বেও ইরান কূটনৈতিক সমাধানের পথে রয়েছে। এছাড়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইরানের ভূমিকা তার আঞ্চলিক প্রভাবকে শক্তিশালী করেছে।
অতীতের গৌরব, ভবিষ্যতের পথ
ইসলামী বিপ্লব কেবল একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়। এটি ইরানি জনগণের আত্মপরিচয় ও সংগ্রামের প্রতীক। ৪৬ বছর পরও এই দিনটি ইরানিদের মনে করিয়ে দেয় যে সংহতি ও বিশ্বাসের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব। তবে, নতুন প্রজন্মের দাবিগুলোকে গুরুত্ব দেওয়াও প্রয়োজন। যাতে বিপ্লবের আদর্শ সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পারে।
ইরানের ইসলামী বিপ্লব দিবস শুধু ইরানেই নয়। বিশ্বজুড়ে স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্য একটি প্রেরণা। এই বিপ্লব প্রমাণ করে যে, জনগণের collective will অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে।#
লেখক: ইতিহাস, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক
পার্সটুডে/এমএআর/১১