কামরুজ্জামান বললেন অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’র নামে
'সংখ্যাগুরুদের নিয়ম সংখ্যালঘুদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র মানা হবে না'
সারা বাংলা সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের সম্পাদক মুহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেছেন, অভিন্ন দেওয়ানি বিধির নামে সংখ্যাগুরুদের নিয়ম সংখ্যালঘুদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র মানা হবে না। মুসলিমরা তা কখনওই মানতে পারবে না।
তিনি আজ (রোববার) রেডিও তেহরানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওই মন্তব্য করেছেন। এরইমধ্যে ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’র তীব্র বিরোধিতা করে ল' কমিশনকে লিখিত মতামত জানিয়েছে ‘সারা বাংলা সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশন’। গতকাল (শনিবার) যুব ফেডারেশনের রাজ্য সম্পাদক মুহাম্মদ কামরুজ্জামান দেশের ২১-তম ল' কমিশন ২০১৮ সালে যে রিপোর্ট দিয়েছিল তাকেই মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। মুহাম্মদ কামরুজ্জামান আজ বলেন, ‘মুসলিমদের পারিবারিক আইন- বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি বন্টন ইত্যাদি ইসলামী নিয়ম অনুযায়ী সম্পন্ন করা হয়। হিন্দু ভাইয়েদের নিয়ম আলাদা। শিখ, জৈন পার্সিদের নিয়ম সব আলাদা আলাদা। এমনকি হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেও নানা রকমের নিয়ম আছে।’
তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল যে বিজেপির এক মুখপাত্র বলেছেন, ৫ আগস্ট সংসদে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিল নিয়ে আসা হবে। এবং সেটি সংসদের উভয় কক্ষে পাস করা হবে। ধর্মনিরপেক্ষ দেশের প্রধানমন্ত্রী ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’তে সাফাই দিয়ে বক্তব্য রাখছেন। কিন্তু ভারতের যেসব সমস্যা আছে সে সবের মধ্যে কোনও সমস্যাই নয় ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’। মূলত সমস্যা হল- বেকারত্ব, শিক্ষার সমস্যা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ইত্যাদি। কিন্তু এগুলোকে পিছনে রেখে ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’র, মতো একটি বিষয়কে সামনে নিয়ে এসে প্রধানমন্ত্রী মেরুকরণের রাজনীতি করতে চাচ্ছেন।’
মুহাম্মদ কামরুজ্জামান আরও বলেন, ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’বোর্ড ইতোমধ্যে দেশের সমস্ত মুসলিম সংগঠন এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যে সংগঠন আছে তাদের কাছেও আবেদন করেছে কেন্দ্রীয় আইন কমিশনে এই বিষয়ে আপত্তি জানানোর জন্য। আমরা ‘সারা বাংলা সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশন’-এর পক্ষ থেকে গতকালই আইন কমিশনে ওই বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে লিখিত মতামত জানিয়েছি। কোনোভাবেই যেন অভিন্ন দেওয়ানি বিধির মতো কোনও বিধি যা মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের বিধি বা নিয়মকে দেশের সমস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার একটা ষড়যন্ত্র। এটাকে কোনোভাবেই যেন কার্যকরী না করা হয়। আইন কমিশন যেন এই বিষয়ে তাদের মতামত বলিষ্ঠভাবে প্রকাশ করে। ভিন্নতার মধ্যে ঐক্যের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে ভারতবর্ষ সেটাকে যেন আইন কমিশনও সম্মান জানায়’ বলেও মন্তব্য করেন সারা বাংলা সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের সম্পাদক মুহাম্মদ কামরুজ্জামান।
প্রসঙ্গত,মুসলিম পার্সোনাল ল’বোর্ড ইতোমধ্যেই প্রকাশ্যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিরোধিতা করেছে। গত(মঙ্গলবার)গভীর রাতে বোর্ডের ভার্চুয়াল বৈঠকে সুপ্রিম কোর্টে এ বিষয়ে আবেদন জানানোর জন্য আইনি দিকগুলোও খতিয়ে দেখা হয়।
গত ১৪ জুন কেন্দ্রীয় সরকার নিযুক্ত ২২তম আইন কমিশনের পক্ষ থেকে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুর বিষয়ে বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন এবং আমজনতার মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল। এর পর ভোপালে বিজেপির কর্মসূচিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুর পক্ষে সরব হন। এই পরিস্থিতিতে সংসদের আসন্ন বর্ষাকালীন অধিবেশনেই নরেন্দ্র মোদী সরকার দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুর জন্য বিল আনতে পারে বলে জল্পনা শুরু হয়েছে।
আগামী ২০ জুলাই থেকে শুরু হবে সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশন। চলবে ১১ আগস্ট পর্যন্ত। ২৩ দিনের অধিবেশন পর্বে ১৭ দিন কাজ হবে বলে জানিয়েছেন সংসদীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী। চলতি সপ্তাহে সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ইস্যুতে কেন্দ্রীয় আইন কমিশন এবং আইন মন্ত্রণালয়ের মত জানতে চাওয়া হয়েছে। আগামী ৩ জুলাই প্রতিনিধি পাঠিয়ে এ বিষয়ে মত জানানোর জন্য নোটিস পাঠানো হয়েছে আইন কমিশন এবং আইন মন্ত্রণালয়কে।
দিল্লির বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র গত (শুক্রবার) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া বার্তায় বলেছেন, ‘৫ আগস্ট কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার হয়েছিল। ৫ আগস্ট রামমন্দিরের শিলান্যাস হয়েছিল। আর আগামী ৫ আগস্ট অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আসতে চলেছে।’
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বলবীর সিংহ চৌহানের নেতৃত্বাধীন ২১-তম আইন কমিশনের মত ছিল, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করে বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকারের মতো পারিবারিক বিষয়ে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান, পার্সি, জৈন সকলের একই আইন চালু করার প্রয়োজন নেই। পারিবারিক আইনে সংস্কার নিয়ে কমিশনের বক্তব্য ছিল, ‘সংঘাতের সমাধান ফারাক মুছে ফেলা নয়। অধিকাংশ দেশ এখন ফারাককে স্বীকৃতি দেওয়ার পথে এগোচ্ছে। ফারাক থাকাটাই মজবুত গণতন্ত্রের প্রতীক। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি এখন কাঙ্ক্ষিত নয়, প্রয়োজনও নেই। তার বদলে যেখানে বৈষম্য রয়েছে, সেগুলো দূর করা উচিত।’
কংগ্রেস, সিপিএমসহ একাধিক রাজনৈতিক দল ২১তম আইন কমিশনের ২০১৮ সালের রিপোর্টকেই হাতিয়ার করে প্রশ্ন তুলেছে, এক বার যখন আইন কমিশন এ বিষয়ে মত দিয়েছে, তখন ফের তা নিয়ে কাঁটাছেড়া করা হচ্ছে কেন?
সংখ্যালঘু শিখ সম্প্রদায়ের আপত্তির কথা স্পষ্ট করে বলেছেন শিরোমণি অকালি দলের নেতা দলজিৎ সিংহ চিমা। তিনি বলেন, ‘এই অভিন্ন বিধি দেশের সংখ্যালঘুদের স্বার্থে নয়। ২১তম আইন কমিশন বলে দিয়েছিল, এর দরকার নেই। এতে সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হবে। দেশে অস্থিরতা, উত্তেজনা বাড়বে।’ প্রায় একই কথা বলেছেন ন্যাশনাল কনফারেন্সের প্রধান ও জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ডা. ফারুক আবদুল্লাহও।
‘আজসু’ (অল ঝাড়খণ্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়ন) প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক বিধায়ক সূর্য সিং বেসরা বলেছেন, অভিন্ন দেওয়ানী আইন আদিবাসী সমাজের বিরোধী। কেন্দ্রীয় সরকার তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করলে আদিবাসী সমাজ এর তীব্র বিরোধিতা করবে। গতকাল (শনিবার) দুমকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সূর্য সিং বেসরা এ সংক্রান্ত মন্তব্য করেন।
ঝাড়খণ্ডের ৩০টি উপজাতি সংগঠন একটি বিবৃতি জারি করেছে বলেছে, তারা আইন কমিশনকে এটি প্রত্যাহার করতে বলবে। আদিবাসী নেতারা বলছেন, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকর হলে তা তাদের প্রথাগত ঐতিহ্যের অবসান ঘটাবে। এর পাশাপাশি জমি সংক্রান্ত ছোটনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন এবং সাঁওতাল পরগনা প্রজাস্বত্ব আইনেও প্রভাব পড়বে বলেও মনে করছেন তারা।
পার্সটুডে/এমএএইচ/২
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।