ইমাম খামেনেয়ী কীভাবে ইসলামী বিপ্লবের নেতা হয়েছিলেন?
-
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী
পার্সটুডে-৪ জুন, ১৯৮৯ সালে বিশেষজ্ঞ পরিষদে, ইরানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীকে বিশেষজ্ঞ পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ইসলামী শাসন ব্যবস্থার নেতা নির্বাচিত করা হয়।
ইমাম খোমেনির ইন্তেকালের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর, নেতা নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যদেরকে তেহরানে ডেকে পাঠানো হয়। ৪ জুন, ১৯৮৯ তারিখ সকালের অধিবেশনে, বিশেষজ্ঞদের ওপর ন্যস্ত ইমাম খোমেনির অসিয়্যতনামা পাঠ করেন আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী। সন্ধ্যার অধিবেশনে, ইসলামী শাসন ব্যবস্থার সর্বোচ্চ নেতৃত্বের জন্য একজন ব্যক্তি (রাহবার) নির্বাচনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। ওই অধিবেশনে, বিশেষজ্ঞ পরিষদে উপস্থিত ৭৪ জন সদস্যের মধ্যে প্রায় ষাট জনের ভোটে আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীকে সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচন করা হয়। পার্সটুডে'র এই প্রবন্ধে, আমরা ইমাম খামেনেয়ীর জীবন এবং কীভাবে তাকে ইসলামী বিপ্লবের নেতা নির্বাচিত করা হয়েছিল তার ওপর সংক্ষিপ্ত নজর দেব।
জন্ম
মরহুম হোজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল-মুসলিমিন হাজ্জ সাইয়্যেদ জাভেদ হোসেইনি খামেনেয়ীর পুত্র হযরত আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী ১৯৩৯ সালের ১৯ এপ্রিল তারিখে মাশহাদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পরিবারের দ্বিতীয় পুত্র।

ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
তিনি স্কুল থেকে মাদ্রাসায় প্রবেশ করেন। সেখানে তাঁর বাবা এবং তৎকালীন অন্যান্য শিক্ষকদের কাছে সাহিত্য ও মৌলিক নীতিমালা অধ্যয়ন করেন। আঠারো বছর বয়সে আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী মাশহাদে আইনশাস্ত্র এবং নীতিমালা অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯৫৭ সালে পবিত্র মাজার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে নাজাফ আশরাফের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন তিনি। নাজাফ মাদ্রাসার মহান মুজতাহিদদের পাঠ পর্যবেক্ষণ এবং দারসে অংশগ্রহণের পর তিনি সেই মাদ্রাসার পাঠ, শিক্ষাদান ও গবেষণার পরিস্থিতি পছন্দ করেন। তাঁর ভালো লাগার কথা এবং তাঁর উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত করেন। কিন্তু তার বাবা তাতে রাজি হন নি। সুতরাং কিছুকাল পর তিনি মাশহাদে ফিরে আসেন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত, আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী কোম সেমিনারি বা ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আইনশাস্ত্র, নীতি এবং দর্শনের ওপর উচ্চশিক্ষায় নিযুক্ত হন। ১৯৬৪ সালে বিপ্লবের নেতার সাথে তার বাবার চিঠিপত্র থেকে তাঁরা জানতে পারেন যে "ছানির কারণে" তাঁর বাবার একটি চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। তিনি খুব দুঃখিত হন এবং কোমে থাকা, সেমিনারিতে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া আবার মাশহাদে গিয়ে তাঁর বাবার যত্ন নেওয়া-কীভাবে কী করবেন দ্বিধায় পড়ে যান। আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেন যে কোম থেকে মাশহাদে চলে যাবেন এবং বাবার যত্ন নেবেন।

বিবাহ
১৯৬৪ সালের শরতের শুরুতে তিনি দুশিযে খোজাস্তেহকে বিয়ে করেন। ওই বিয়ের ফলে তাঁর ৬ সন্তানের (দুই মেয়ে এবং চার ছেলে) জন্ম হয়।

রাজনৈতিক সংগ্রাম
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী'র নিজের ভাষ্যমতে তিনি "ইমাম খোমেনি (রহ.)-এর আইনশাস্ত্র, উসূল, রাজনৈতিক এবং বিপ্লবী ছাত্রদের একজন। ১৯৬২ সালে মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভির ইসলাম-বিরোধী এবং আমেরিকাপন্থী নীতির বিরুদ্ধে ইমাম খোমেনির প্রতিবাদ এবং বিপ্লবী আন্দোলনের সমর্থনে রাজনৈতিক সংগ্রামের অঙ্গনে প্রবেশ করেন। তিনি অনেক উত্থান-পতন, নির্যাতন, নির্বাসন এবং কারাবাস সত্ত্বেও ষোল বছর ধরে লড়াই করেছিলেন এবং এই পথে কোনও বিপদের আশঙ্কা করেন নি। পাহলভি শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সময় আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীকে ৬ বার গ্রেপ্তার করা হয় এবং প্রতিবারই তাঁর ওপর নির্যাতন চালানো হয়।
নির্বাসন
১৯৭৭ সালের শেষের দিকে, স্বৈরাচারী পাহলভি সরকার আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীকে গ্রেপ্তার করে এবং তিন বছরের জন্য দক্ষিণ-পূর্ব ইরানের ইরানশাহরে নির্বাসন দেয়। ১৯৭৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে, ইরানের সাধারণ মুসলিম এবং বিপ্লবী জনগণের সংগ্রাম তুঙ্গে ওঠার সাথে সাথে, তিনি নির্বাসন থেকে মুক্তি পেয়ে পবিত্র মাশহাদে ফিরে আসেন। তিনি পাহলভি শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রামের অগ্রভাগে ছিলেন। আল্লাহর পথে বহু বছরের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম এবং প্রতিরোধের পর, সমস্ত কষ্ট ও তিক্ততা সহ্য করার পর বিদ্রোহ, প্রতিরোধ ও সংগ্রামের মিষ্টি ফল অর্জন করেন অর্থাৎ ইরানের মহান ইসলামী বিপ্লব বিজয় লাভ করে আর নির্লজ্জ ও নিপীড়ক পাহলভি সরকারের অপমানজনক পতনের মধ্য দিয়ে ইরানে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

বিজয়ের প্রাক্কালে
ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের প্রাক্কালে ইমাম খোমেনী প্যারিস থেকে তেহরানে ফিরে আসার আগে, ইমাম খোমেনী কর্তৃক ইরানের বিপ্লবী ব্যক্তিত্ব শহীদ মোতাহারী, শহীদ বেহেশতি, হাশেমী রাফসানজানী প্রমুখের... মতো যোদ্ধাদের অংশগ্রহণে "ইসলামী বিপ্লবী কাউন্সিল" গঠিত হয়। ইমাম খোমেনীর আদেশে আয়াতুল্লাহ খামেনীও এই কাউন্সিলের সদস্য হন।

বিজয়ের পর
ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের পর, আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীও মূল্যবান ইসলামী কর্মকাণ্ডে এবং ইসলামী বিপ্লবের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য উৎসাহী এবং পরিশ্রমী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর ভূমিকার সবকটিই ছিল নিজস্ব উপায়ে এবং সমকালের পরিপ্রেক্ষিতে অনন্য ও গুরুত্বপূর্ণ। এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে আমরা কেবল প্রধান বিষয়গুলো উল্লেখ করব:
- ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে তাঁর সহযোদ্ধা এবং সমচিন্তার সহযোগিতায় "ইসলামী গণতান্ত্রিক দল" প্রতিষ্ঠা।
- ১৯৭৯ সালে প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী।
- ১৯৮০ সালে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর নেতৃত্ব।
- ১৯৮০ সালে তেহরানে জুমার নামাজের ইমাম।
- ১৯৮১ সালে সুপ্রিম ডিফেন্স কাউন্সিলে ইমাম খোমেনির প্রতিনিধি।
- ১৯৮০ সালে ইরানের সংসদ মজলিশে শুরায় তেহরান থেকে জনগণের প্রতিনিধি।
- ১৯৮১ সালে ইরানের বিরুদ্ধে ইরাকের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে এবং সাদ্দামের সেনাবাহিনীর আক্রমণের সাথে সাথে পবিত্র প্রতিরক্ষা ফ্রন্টে যুদ্ধের পোশাকে সক্রিয় উপস্থিতি।
- ২৭ জুন ১৯৮১ সালে তেহরানের আবুজার মসজিদে তাঁর ওপর এমকেও সন্ত্রাসী গোষ্ঠির ব্যর্থ হত্যাকাণ্ড।
- প্রেসিডেন্ট; ইরানের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী রাজায়ির শাহাদাতের পর, আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী ১৯৮১ সালের অক্টোবরে ষোল মিলিয়নেরও বেশি ভোট পেয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয়বারের মতো ওই পদ এবং দায়িত্বে নির্বাচিত হন।
- সাংস্কৃতিক বিপ্লবী কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, ১৯৮১।
- সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী পরিষদের চেয়ারম্যান, ১৯৮৭।
- সাংবিধানিক সংশোধন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, ১৯৮৯।
নেতা হিসেবে কীভাবে নির্বাচিত হবেন
ইমাম খোমেনির মৃত্যুর পর ভবিষ্যতের নেতা নির্বাচন সংবিধান অনুসারে ইরানের বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যগণ সম্পন্ন করবেন। ১৯৭৯ সালে অনুমোদিত সংবিধানের ৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে:
“ইমাম মাহদী (আ.)-এর অদৃশ্যায়ন বা লোকচক্ষুর আড়ালে থাকার সময়, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে, জাতির অভিভাবকত্ব এবং ইমামত একজন ন্যায়পরায়ণ ও ধার্মিক ফকীহর ওপর ন্যস্ত থাকবে। তিনি হবেন সময় সম্পর্কে সচেতন, সাহসী, প্রশাসনিক জ্ঞান সম্পন্ন, যাকে অধিকাংশ জনগণ নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং গ্রহণ করেছে। যদি কোনও ফকীহর এরকম সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকে, তাহলে ১০৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে উপরোক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন ফকীহদের সমন্বয়ে গঠিত নেতা অথবা নেতৃত্ব দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।”#
এভাবে, ৪জুন ১৯৮৯ তারিখে বিশেষজ্ঞ পরিষদে, ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী, বিশেষজ্ঞদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে (উপস্থিত ৭৪ সদস্যের মধ্যে প্রায় ষাট জন) ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচিত হন।
ইসলামী উম্মাহর পতাকাবাহী
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর প্রতি ইরানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ইমাম খোমেনির পরিবার, মহান ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ, অভিজাত শ্রেণী, মাদ্রাসা ও শিক্ষাবিদ, শহীদদের পরিবারসহ ইরানি জনগণের বিভিন্ন অংশের ব্যাপক আনুগত্য ও সমর্থন বিশ্ববাসীর সামনে প্রমাণ করেছে যে আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর নেতৃত্বে ইরান এখনও ইসলামী উম্মাহর পতাকাবাহী।

ইমাম খোমেনীর পুত্র (রহ.) আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী সম্পর্কে কী বলেছিলেন?
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীকে সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচিত করার কয়েক ঘন্টা পর, ইমাম খোমেনি (রহ.)-এর পুত্র হাজ্জ সাইয়্যেদ আহমদ খোমেনি তাঁকে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়ে বলেন:
"ইমাম বারবার আপনাকে একজন মুসলিম পণ্ডিত এবং আমাদের ইসলামী শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য সেরা ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আমি এবং ইমামের পরিবারের সকল সদস্য সম্মানিত বিশেষজ্ঞদের আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাই, কারণ আমরা বিশ্বাস করি যে আমাদের প্রিয় ইমামের আত্মা এই নির্বাচনের মাধ্যমে খুশি এবং প্রশান্ত হয়েছে। আমি আবারও একজন ছোট ভাই হিসেবে সর্বোচ্চ নেতার আদেশ আমার ওপর বাধ্যতামূলক বলে মনে করি।"

ইমামের পথ অব্যাহত রাখা
নির্বাচিত হওয়ার পর, আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী ইমাম খোমেনিকে "বিপ্লবের পবিত্র বৃক্ষের মূল" হিসেবে উল্লেখ করেন এবং ঘোষণা করেন: "আমরা ইমাম খোমেনি (রহ.)-এর পথের ওপর ভিত্তি করে আমাদের পথে অগ্রসর হয়ে যাব।"
পার্সটুডে/এনএম/৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।