মরহুম আয়াতুল্লাহ ইয়াজদির ঘটনাবহুল জীবন ও ইসলামি বিপ্লব রক্ষায় তাঁর অবদান
ইরানের প্রখ্যাত আলেম, মুজতাহিদ, দার্শনিক ও মুফাসসিরে কুরআন আয়াতুল্লাহ মোহাম্মাদ তাকি মেসবাহ ইয়াজদি গত ১ জানুয়ারি শুক্রবার ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। তিনি ইরানের বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্য এবং 'ইমাম খোমেনী(রহ.) শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা'র প্রধান ছিলেন। আজকের আলোচনায় আমরা আয়াতুল্লাহ মোহাম্মাদ তাকি মেসবাহ ইয়াজদির কর্মবহুল জীবনের কিছু দিক তুলে ধরব।
আয়াতুল্লাহ মেসবাহ ইয়াজদি গত কিছুদিন ধরে পরিপাকতন্ত্রের সমস্যায় ভুগছিলেন এবং তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। আয়াতুল্লাহ মেসবাহ ইয়াজদি ১৯৩৫ সালের ৩১ জানুয়ারি ইরানের ইয়াজদ প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৯ সালে মার্কিন-সমর্থিত ইরানের রেজা শাহ পাহলাভির নেতৃত্বাধীন রাজতন্ত্রের উৎখাত ও ইসলামি বিপ্লব বিজয়ে তিনি অসামান্য অবদান রাখেন। তার এই অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী(রহ.) তাকে বাকিরুল উলুম গবেষণা সংস্থার প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেন। পরবর্তীতে সংস্থাটির নাম দেয়া হয় ‘ইমাম খোমেনী (রহ.) শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা' এবং আয়াতুল্লাহ মেসবাহ ইয়াজদি আমৃত্যু এই সংস্থার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাফসির, দর্শন ও ইসলামি শিক্ষা বিষয়ে তিনি বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে 'দর্শন শিক্ষা'., ‘ইসলামের রাজনৈতিক তত্ত্ব', ‘কুরআনে বর্ণিত নৈতিকতা' ইত্যাদি।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী মরহুম মেসবাহ ইয়াজদিকে অন্যতম সেরা চিন্তাবিদ ও দক্ষ পরিচালক হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, 'তিনি সবসময় সত্য ও হকের পথে ছিলেন এবং দৃঢ় মনোবলের অধিকারী ছিলেন। তিনি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করা ছাড়াও সুনামধন্য অনেক যোগ্য ছাত্র গড়ে তুলেছিলেন। বিপ্লবী শাসন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যেখানেই প্রয়োজন হয়েছে সেখানেই তিনি উপস্থিত থেকেছেন। এক কথায় তিনি ছিলেন নজিরবিহীন একজন মানুষ।'
ইসলামি বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম ইমাম খোমেনির তত্বাবধানে থেকে তিনি ধর্মতত্ব ও ইসলামি দর্শনের ওপর জ্ঞানার্জন করেন। এ ছাড়া, তিনি আয়াতুল্লাহ বোরুজেরদি, আয়াতুল্লাহ আরাকি, আল্লামা সাইয়্যেদ মোহাম্মদ হোসেন তাবাতাবাঈ ও আয়াতুল্লাহ বেহযাতের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্য পাওয়ার ও তাদের তত্বাবধানে থেকে জ্ঞানার্জনের সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন।
ইমাম খোমেনি(র.)এর নেতৃত্বে ইসলামি বিপ্লবের প্রথম থেকেই ইরানের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং সারা বিশ্বের নজর ছিল ইরানের দিকে। এ রকম একটি অবস্থায় ইরানের প্রখ্যাত ধর্মীয় নেতারা ও বুদ্ধিজীবী মহল ইসলামি বিপ্লবী লক্ষ্য উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অসামান্য অবদান রাখেন। তারা এমন একটি ইসলামি সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যান যাতে এ বিপ্লব সারা বিশ্বের ন্যায়বিচারকামী ও স্বাধীনচেতা মানুষের জন্য আদর্শে পরিণত হয়। সেসময় বিপ্লবের শত্রুরা ইরানের খ্যাতনামা ধর্মীয় নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সুনাম নষ্ট করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র করতে থাকে। শত্রুদের বড় টার্গেট ছিলেন আয়াতুল্লাহ মেসবাহ ইয়াজদি।
আয়াতুল্লাহ ইয়াজদির জীবনের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তিনি সারা জীবন কুসংস্কার ও বিকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। যখনই কোনো কুচক্রী মহল ইসলাম ধর্ম কিংবা ইসলামি বিপ্লবী আদর্শকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করেছে তখনই তিনি তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন এবং অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে ও যৌক্তিকপন্থায় ইসলাম ও বিপ্লবকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন।
আয়াতুল্লাহ মেসবা ইয়াজদি ধর্মতত্ব গবেষণা কেন্দ্রেও একজন জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি ইরান, বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তিত পরিস্থিতি এবং ইসলামি বিপ্লবের ভবিষ্যত নিয়ে অত্যন্ত গভীর আলোচনা করতেন। তিনি বিভিন্ন ইস্যুতে জ্ঞানগর্ভ বিতর্ক করতেন। ইরানে ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের আগে বেশিরভাগ সংগ্রামী ও বিপ্লবীরা মনে করতেন প্রথমে রাজনৈতিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হবে এবং এরপর বিপ্লব বিজয় ও সমাজ সংস্কারের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। কিন্তু আয়াতুল্লাহ মোতাহহারি ও আয়াতুল্লাহ মেসবাহ ইয়াযদির মতো বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদগণ মনে করতেন রাজনৈতিক আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়া, ইসলামি বিপ্লব ও সংগ্রাম চলার একই সময়ে সমাজ সংশোধন তথা যেকোনো বিকৃতি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে এবং সমূলে উপড়ে ফেলতে হবে। ইরানসহ সারা বিশ্বে প্রকৃত ইসলামের ঝাণ্ডা তুলে ধরতে হবে।
স্বৈরাচারী শাহের শাসনামলে সরকারের বিরুদ্ধে আমজনতার যে তীব্র রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাতে আয়াতুল্লাহ মেসবাহ ইয়াজদির বিরাট অবদান ছিল। প্রাদেশিক সংগঠন গড়ে তোলা এবং ইমাম খোমেনি(র.) নেতৃত্বে ধর্মীয় নেতাদের আন্দোলন সংগ্রামসহ এ ধরনের আরো বহু কর্মকাণ্ডে মেসবাহ ইয়াজদি জড়িত ছিলেন। ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের আগে থেকেই তিনি ইরানে ধর্ম বিরোধী কমিউনিজমের প্রভাব বিস্তারের বিপদ সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক করে দেন এবং বিভিন্ন বক্তব্যে বিপ্লবের শত্রুদের ষড়যন্ত্রের নানা দিক সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলেন। এসব ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে তিনি এতোটাই স্পর্শকাতরতা ও কঠোরতা দেখিয়েছিলেন যে, তার অনেক বিপ্লবী বন্ধুও তাকে এসব বিষয়ে ধীরে চলার পরামর্শ দিতেন। কিন্তু তিনি তার অবস্থানে অটল থাকতেন এবং কমিউনিস্টদের মিথ্যা প্রচারণার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন। তিনি বক্তব্য দেয়া, বিতর্কে অবতীর্ণ হওয়া, বই লিখে প্রভৃতির মাধ্যমে বিকৃতি ও অপপ্রচারের জবাব দিতেন এবং কাউকে ভয় পেতেন না।
বিপ্লব বিজয়ের শুরু থেকেই শত্রুরা ইরানের জনগণের ধর্ম বিশ্বাসকে টার্গেট করে একের পর এক জঘন্য ষড়যন্ত্র করে গেছে। এ অবস্থায় আয়াতুল্লাহ মেসবাহ ইয়াজদি বিপ্লবী আদর্শ ও ধর্মকে রক্ষার জন্য সরব হয়ে ওঠেন এবং দেশের সর্বত্র ধর্মীয় আলেম ও ব্যক্তিত্বদেরকে প্রেরণ করেন। তিনি নিজেও ধর্মীয় মাদ্রাসায় শিক্ষাদান কার্যক্রম আপাতত স্থগিত রেখে দেশের অন্যান্য ধর্ম শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে ছুটে যান এবং বিভিন্ন ভাষণে বিপ্লবের সাফল্য ও উজ্জ্বল ভবিষ্যত তুলে ধরার পাশাপাশি শত্রুর ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে দেন এবং জনগণের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। এ ছাড়া অত্যন্ত স্পর্শকাতর ওই সময়টিতে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টির জন্য আয়াতুল্লাহ মেসবাহ ইয়াজদি 'মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ক বিশেষ কেন্দ্র স্থাপন করেন। তার উদ্যোগে সাধারণ ও ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থার সমন্বয়ের ফলে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা হয়। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, আয়াতুল্লাহ মেসবাহ ইয়াজদির একটি বড় সাফল্যের দিক হচ্ছে তিনি অসংখ্য যোগ্য ছাত্র গড়ে তুলতে সক্ষম হন।
আয়াতুল্লাহ মেসবাহ ইয়াজদি শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও অসামান্য অবদান রাখেন। তিনি গুরুত্বপূর্ণ অসংখ্য বই রচনা করেছেন যার কোনো কোনোটি বিপ্লব পূর্ববর্তী সময়ের সঙ্গে সম্পর্কিত আবার কোনো কোনোটি বিপ্লব পরবর্তী সময়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। #
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/৮