ইমাম খোমেনী (রহ.): ইতিহাস বদলে দেওয়া এক মহাপুরুষ
(last modified Tue, 03 Jun 2025 12:50:46 GMT )
জুন ০৩, ২০২৫ ১৮:৫০ Asia/Dhaka
  • ইমাম খোমেনী (রহ.): ইতিহাস বদলে দেওয়া এক মহাপুরুষ

সাইফুল খান: ইতিহাসে এমন কিছু মহান ব্যক্তি আছেন, যাঁরা শুধু একটি জাতিকেই নয়, বরং গোটা মানবজাতিকেই আলো দেখিয়েছেন। ২০ শতকের শেষভাগে এমনই এক মহান নেতা ছিলেন আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ রুহুল্লাহ মুসাভি খোমেনী (রহ.)। যাঁকে দুনিয়া চেনে ‘ইমাম খোমেনী’ নামে।

তিনি ছিলেন ইসলামি বিপ্লবের স্থপতি, যিনি শাহ শাসিত ইরানে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা। যার মূলনীতি ছিল ‘লা গারিবা ফিল ইসলাম’ (ইসলামে বৈষম্য নেই)। যা বৈষম্যবিরোধী নতুন বাংলাদেশেও প্রাসঙ্গিক।

জন্ম ও শিক্ষা

ইমাম খোমেনী জন্মগ্রহণ করেন ১৯০২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর, ইরানের খোমেন শহরে এক সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারে। তাঁর পুরো নাম ছিল সাইয়্যেদ রুহুল্লাহ মুসাভি খোমেনী। খুব অল্প বয়সে পিতাকে ব্রিটিশ-সমর্থিত জুলুমকারীরা শহীদ করে। ফলে জীবনের শুরুতেই তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে শিখেছিলেন।

তেহরান, ইস্পাহান ও কোম শহরের বিখ্যাত মাদ্রাসাগুলোতে তিনি ফিকহ, দর্শন, তাসাউফ ও রাজনীতি নিয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি ছিলেন ইসলামী দর্শনের এক বিশিষ্ট দার্শনিক, মুজতাহিদ ও মুর্শিদ।

রাজনৈতিক জাগরণ ও শাহ-বিরোধী আন্দোলন

১৯৬৩ সালে যখন শাহ রেজা পাহলভি ‘হোয়াইট রেভল্যুশন’ নামে পশ্চিমাপন্থী সংস্কার শুরু করেন। যার মধ্যে ছিল ইসরাইলের সঙ্গে চুক্তি, ভূমি সংস্কারের নামে কৃষকদের জমি কেড়ে নেওয়া, নারীকে ইসলামের বিধানহীনভাবে রাজনীতিতে টেনে আনা। তখনই ইমাম খোমেনী সর্বপ্রথম সরাসরি বিরোধিতা করেন। এই কারণে তাঁকে বন্দি করা হয়, পরে দেশ থেকে নির্বাসিত করে ইরাক পাঠানো হয়। ১৪ বছর নির্বাসনের সময় তিনি ইরাকের নাজাফ, ফ্রান্সের প্যারিসে থেকেও ইরানের জনগণকে জাগিয়ে তুলেছিলেন তাঁর অডিও টেপ, ফতোয়া, পত্র ও বার্তার মাধ্যমে।

ইসলামী বিপ্লবের বিজয় (১৯৭৯)

১৯৭৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ইমাম খোমেনী স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ তাঁকে বরণ করে নেয় এবং এর ঠিক ১০ দিনের মধ্যেই শাহের পতন হয় ও ইসলামী বিপ্লব চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে।

ইমাম বলেন: "আমরা এমন এক রাষ্ট্র চাই, যেখানে ইসলাম হবে নীতি, এবং জনগণ হবে মালিক।"

এই বিপ্লব ছিল অনন্য, কারণ এটি ছিল গণভিত্তিক ও আদর্শভিত্তিক। শুধু শাহকে নয়, বরং সাম্রাজ্যবাদ ও দুঃশাসনকেও প্রত্যাখ্যানের বিপ্লব।

ইমাম খোমেনীর দর্শন: 'বেলায়াতে ফকীহ' ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ

ইরানে ইমাম খোমেনীর সবচেয়ে বড় অবদান ছিল "বেলায়াতে ফকীহ"-এর বাস্তবায়ন। এটি হলো এমন এক ইসলামি শাসনব্যবস্থা, যেখানে যোগ্য আলেম রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকবেন; তবে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে। এই ব্যবস্থায় ইসলামি শরিয়াহ, সামাজিক ন্যায়, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা ও মুসলিম ঐক্য ছিল মূল ভিত্তি।

বেলায়াতে ফকীহ: ধারণার উৎপত্তি

‘বেলায়াতে ফকীহ’ (ولایت فقیه) শব্দটির অর্থ—‘আলেম শাসকের অভিভাবকত্ব’। এটি একটি ইসলামী রাজনৈতিক তত্ত্ব, যার ভিত্তি মূলত শিয়া ফিকহে হলেও, ইমাম খোমেনী তা নতুনভাবে রাজনৈতিক বাস্তবতায় রূপ দেন। তিনি মনে করতেন, যখন ইমাম মাহদী (আ.) গায়েব অবস্থায় আছেন, তখন সমাজের নেতৃত্ব এমন একজন যোগ্য, তাকওয়াবান, জ্ঞানী এবং ন্যায়ের প্রতীক ফকীহ বা আলেমের হাতে থাকা উচিত। যিনি শরীয়াহর মূলনীতিতে দক্ষ এবং জনগণের স্বার্থরক্ষায় নিবেদিত।

দর্শনের মূল স্তম্ভসমূহ

১. ইসলামি শরিয়াহর আধিপত্য

খোমেনীর মতে, ইসলাম কেবল ব্যক্তিগত ইবাদতের জন্য নয়; বরং একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। সুতরাং রাষ্ট্র পরিচালনায় কুরআন, সুন্নাহ এবং ইসলামী আইনের ভূমিকা অপরিহার্য। বেলায়াতে ফকীহ ব্যবস্থায় আইন প্রণয়ন শরিয়াহর কাঠামোর বাইরে হতে পারে না।

২. ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতা

এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব সমাজে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। ধনী-গরিব, আলেম-আমজনতা, নারী-পুরুষ সবার জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করাকে রাষ্ট্রীয় কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

৩. জনগণের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা

যদিও নেতৃত্ব থাকে একজন যোগ্য আলেমের হাতে, কিন্তু ইমাম খোমেনী গণতন্ত্রকে পুরোপুরি বাতিল করেননি। তিনি একটি নতুন ব্যবস্থা প্রস্তাব করেন, যেটি ‘ইসলামী গণতন্ত্র’ (Islamic Democracy)। জনগণ রাষ্ট্রপতি, সংসদ সদস্য ও অন্যান্য প্রতিনিধিকে নির্বাচন করে। তবে চূড়ান্ত রক্ষণশীল অভিভাবক থাকেন ‘ওলি-এ-ফকীহ’ যিনি শরিয়াহ এবং ইসলামী মূল্যবোধের সীমারেখা ঠিক করেন।

৪. সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা

ইমাম খোমেনীর দৃষ্টিতে সাম্রাজ্যবাদ শুধু একটি বৈদেশিক রাজনৈতিক বিষয় নয়, বরং এটা মুসলিম সমাজের আত্মার বিরুদ্ধে পরিচালিত সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। তাই বেলায়াতে ফকীহ দর্শনে পশ্চিমা আধিপত্য, ইসরায়েলি দখলবাদ ও ন্যাটোর প্রভাব প্রত্যাখ্যান করা হয়।

৫. মুসলিম উম্মাহর ঐক্য

খোমেনীর মতে, এই ব্যবস্থার একটি বৃহৎ উদ্দেশ্য ছিল গোটা মুসলিম বিশ্বের ঐক্য ফিরিয়ে আনা। তিনি বারবার আহ্বান জানিয়েছেন সুন্নি-শিয়া ঐক্যের প্রতি এবং উম্মাহকে জাগ্রত করার জন্য।

রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে বাস্তবায়ন (ইরান প্রেক্ষাপটে)

১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের পর ইরানের সংবিধানে ‘বেলায়াতে ফকীহ’ মূল ভিত্তি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। এখানে ওলি-এ-ফকীহ হচ্ছেন সর্বোচ্চ নেতা (Supreme Leader)। তিনি নির্বাহী, বিচার বিভাগ ও সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতে। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্র ও জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বও বজায় রাখা হয়।

উল্লেখযোগ্য দিক:

শুরা পরিষদ (Majlis) আইন প্রণয়ন করে। সংরক্ষণ পরিষদ (Guardian Council) নিশ্চিত করে যেন আইন শরিয়াহবিরোধী না হয়।

সর্বোচ্চ নেতা রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে চূড়ান্ত ভূমিকা রাখেন।

সমালোচনা ও বিতর্ক

বিশ্বব্যাপী অনেক ইসলামপন্থী দল ও চিন্তাবিদ ইমাম খোমেনীর এই তত্ত্বকে সাধুবাদ জানিয়েছেন, তবে কিছু সুন্নি চিন্তাবিদ ও ধর্মনিরপেক্ষ মহল এতে ‘ধর্মীয় শাসনের আধিপত্য’ দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অনেকেই প্রশ্ন তোলে: "কোন ফকীহকে কিভাবে জনগণের ওপর কর্তৃত্বের অধিকার দেওয়া যাবে?" আবার অনেকে বলেন, এই ব্যবস্থায় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে স্বৈরতান্ত্রিক ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

তবে ইরানের বাস্তবতা হলো, এই ব্যবস্থায় এখনো পর্যন্ত একটি স্বাধীন, স্বশাসিত রাষ্ট্র টিকে আছে, যা মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, যুদ্ধ, অভ্যন্তরীণ চাপ সত্ত্বেও নিজস্ব পথেই এগিয়ে যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক প্রভাব ও বিপ্লব রপ্তানি

ইমাম খোমেনী মনে করতেন, বেলায়াতে ফকীহ শুধু ইরানের জন্য নয়; বরং গোটা মুসলিম দুনিয়ার জন্য একটি আদর্শ মডেল হতে পারে। তাঁর এই বিপ্লবী চেতনা ছড়িয়ে পড়ে লেবাননে (হিজবুল্লাহ), ইরাকে, বাহরাইনে এবং ইয়েমেনে। ফলে এটি শুধু একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা নয় বরং একটি ইসলামি রাজনৈতিক জাগরণের নাম।

ইমাম খোমেনীর ‘বেলায়াতে ফকীহ’ শুধু একটি তাত্ত্বিক ধারণা নয়; এটি বাস্তবতায় পরীক্ষিত একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার নাম, যা আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে ইসলামি চিন্তাধারার সংমিশ্রণ ঘটায়। যেখানে আল্লাহর আইন এবং জনগণের মতামত দুটোকেই সম্মান দেওয়া হয়। আজও যখন মুসলিম বিশ্ব নেতৃত্বশূন্য, তখন খোমেনীর এই মডেল অনেকের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছে।

ফিলিস্তিন ও মজলুমদের পক্ষে অবস্থান

ইমাম খোমেনী ফিলিস্তিন ইস্যুকে শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং ঈমানের বিষয় বলে মনে করতেন। তিনি ১৯৭৯ সালে আল-কুদস দিবস ঘোষণা করে বলেছিলেন:

"যে কোনো মুসলমান যদি ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াই না করে, সে ইসলামের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে।"

তিনি সারা দুনিয়ার মজলুমদের পক্ষে কথা বলেছেন হোক তা আফ্রিকা, কাশ্মীর, বসনিয়া কিংবা লেবানন।

মৃত্যু ও উত্তরাধিকার

৩ জুন ১৯৮৯ সালে ইমাম খোমেনী ইন্তেকাল করেন। তাঁর জানাজায় অংশগ্রহণ করে প্রায় এক কোটি মানুষ। যা মানব ইতিহাসে অন্যতম বৃহত্তম সমাবেশ।

তাঁর উত্তরসূরি আয়াতুল্লাহ খামেনি আজও তাঁর দর্শন ও বিপ্লবের চেতনা ধরে রেখেছেন।

উপসংহার: খোমেনী চেতনা আজও প্রাসঙ্গিক

ইমাম খোমেনী কেবল একজন ধর্মীয় নেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন এক আদর্শ, এক বিপ্লবী চেতনা, এক মহান ঐতিহাসিক সত্তা। আজও যখন মুসলিম দুনিয়া দিকভ্রান্ত, তখন তাঁর সেই কণ্ঠস্বর আমাদের মনে করিয়ে দেয়: "আমরা আমেরিকা ও ইসরাইলকে রক্তচোষা বলি, কারণ তারা সত্যিই তাই।"

ইমাম খোমেনীর জীবন আমাদের শিখিয়েছে সত্যের পক্ষে একা দাঁড়ালেও তা ইতিহাস গড়ে।

(মরহুম ইমাম খোমেনীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে লেখা রচনা করেছে  ইতিহাস, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক সাইফুল খান)